প্রযুক্তি দুনিয়ায় নতুন প্রতিযোগিতা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন প্রযুক্তি দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে—এই বিপুল বিনিয়োগ ও প্রচেষ্টার পেছনে আসলে কী লক্ষ্য রয়েছে? ওপেনএআই, গুগল, অ্যামাজন, মেটা কিংবা অ্যানথ্রপিক—সব প্রতিষ্ঠানই নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে চাইছে এআইকে ঘিরে। কেউ বলছে এটি মানবজাতির পরবর্তী বিপ্লব, কেউ বলছে এটি ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অস্ত্র।
ওপেনএআই-এর বিলিয়ন ডলারের অভিযান
ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান বলেছেন, তাদের প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে ডেটা সেন্টার নির্মাণে “ট্রিলিয়ন ডলার” ব্যয় করবে। তার ভাষায়, “অনেকে হয়তো বলবে এটি অযৌক্তিক ব্যয়, কিন্তু আমরা জানি আমরা কী করছি।”
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—কী তৈরি হচ্ছে এই বিপুল ব্যয়ের মাধ্যমে? মানবমস্তিষ্কের সমান বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র? নাকি শুধু উন্নত সংস্করণের চ্যাটবট ও বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্ম?
এআই-এর প্রতিশ্রুতি ১: উন্নত সার্চ ইঞ্জিন
চ্যাটবটগুলো এখন সার্চ ইঞ্জিনের বিকল্প হয়ে উঠছে। গুগলের মতো শুধু লিংক না দিয়ে তারা সরাসরি কথোপকথনের মাধ্যমে উত্তর দেয়। বর্তমানে প্রতি মাসে ৭০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে। তবে পেইড সাবস্ক্রাইবার মাত্র ৬ শতাংশেরও কম।
এই মডেল এখনো মুনাফার মুখ দেখেনি, কারণ এটি পরিচালনা ব্যয়সাপেক্ষ এবং গুগলের মতো বিজ্ঞাপননির্ভর রাজস্ব কাঠামো এখনো তৈরি হয়নি। তুলনায়, গুগল প্রতি ত্রৈমাসিকে ৫৪ বিলিয়ন ডলার বিজ্ঞাপন থেকে আয় করে।
এআই-এর প্রতিশ্রুতি ২: উৎপাদনশীলতার বিপ্লব
চ্যাটজিপিটি শুধু প্রশ্নের উত্তরই দেয় না, বরং প্রোগ্রাম লেখে, মিটিং সারসংক্ষেপ করে, ইমেল লেখে এমনকি সফটওয়্যার পরিচালনাও করতে পারে। মাইক্রোসফট, গুগল, ওপেনএআই ও অ্যামাজন যৌথভাবে প্রায় ৩২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে বিশাল ডেটা সেন্টার নির্মাণে।
তবে বাস্তবতা হলো, অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো এই প্রযুক্তির পূর্ণ সুবিধা পায়নি। মেকিন্সির গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ কোম্পানি জেনারেটিভ এআই ব্যবহার শুরু করেছে, কিন্তু বেশিরভাগই বলেছে এটি এখনো “উল্লেখযোগ্য আর্থিক প্রভাব” ফেলছে না।
এআই-এর প্রতিশ্রুতি ৩: ডিজিটাল সহকারী হিসেবে এআই
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এখন এআইকে স্মার্ট চশমা থেকে শুরু করে ঘরোয়া যন্ত্রে সংযুক্ত করছে। মেটা তাদের রে-বেন স্মার্ট গ্লাসে এআই সংযোজন করছে, আর অ্যামাজন তাদের অ্যালেক্সা ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্টে নতুন ফিচার যোগ করছে।
অ্যামাজনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রোহিত প্রসাদ বলেন, “এটি কোনো গবেষণার খেলা নয়, এআই সবকিছু বদলে দেবে।”
তবে এখনো এসব ডিভাইসের ব্যবহার সীমিত। অ্যালেক্সা জনপ্রিয় হলেও তা এখনো লাভজনক হয়নি।
এআই-এর প্রতিশ্রুতি ৪: ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব
মেটা, এক্সএআই (ইলন মাস্ক), ও ক্যারেক্টার.এআই-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ভার্চুয়াল সঙ্গী তৈরির দিকে এগোচ্ছে। ব্যবহারকারীরা এআই বটের সঙ্গে বন্ধুর মতো কথা বলতে পারছেন।
মার্ক জাকারবার্গের মতে, “মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সংযোগ চায়, আর এআই সেই সুযোগ দিচ্ছে।”
তবে সমালোচকেরা বলছেন, এটি মানুষকে বাস্তব সম্পর্ক থেকে দূরে সরিয়ে কৃত্রিম জগতে বন্দী করছে।
এআই-এর প্রতিশ্রুতি ৫: বৈজ্ঞানিক সাফল্য
অ্যানথ্রপিকের প্রধান নির্বাহী ডারিও আমোডেই বিশ্বাস করেন, কয়েক বছরের মধ্যেই এআই এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যেখানে এটি “ডেটা সেন্টারে একটি প্রতিভাশালী জাতির সমান কাজ করতে পারবে।”
তার মতে, এআই ভবিষ্যতে ক্যানসার নিরাময়, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে।
গুগলের আলফাফোল্ড ইতিমধ্যে ওষুধ আবিষ্কারে বিপ্লব এনেছে, যা রসায়নে নোবেল পুরস্কারও অর্জন করেছে।
এআই-এর প্রতিশ্রুতি ৬: মানবস্তরের বুদ্ধিমত্তা
গুগলের ডিপমাইন্ডের প্রধান ডেমিস হাসাবিস ও জাকারবার্গের মতো উদ্যোক্তারা এখন “আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স” বা এজিআই নিয়ে কাজ করছেন—একটি এমন যন্ত্র, যা মানুষের সমান বা তার চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান হতে পারে।
তবে বিজ্ঞানীরা এখনো মানব বুদ্ধিমত্তার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় একমত হতে পারেননি। বাস্তবে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে হয়তো আরও দশক লেগে যাবে।
অজানা ভবিষ্যৎ ও ঝুঁকির প্রশ্ন
ওরেন ইটজিওনি, অ্যালেন ইনস্টিটিউট ফর এআই-এর প্রতিষ্ঠাতা, বলেন, “এই প্রতিযোগিতার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে লোভ, আত্মঅহংকার এবং ভয়—বিশেষ করে ‘ফোমো’ (ফিয়ার অব মিসিং আউট)।”
স্যাম অল্টম্যানও স্বীকার করেছেন, “সবাই টিকে থাকতে পারবে না। কেউ কেউ বিপুল অর্থ হারাবে। এটাই পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়ম।”
প্রযুক্তি জগতের এই দৌড়ে এআই একদিকে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলছে, অন্যদিকে ছড়াচ্ছে উদ্বেগও।
মানবজাতির ভবিষ্যৎ গড়বে কি এআই, নাকি এটি হয়ে উঠবে অনিয়ন্ত্রিত শক্তি—এই প্রশ্নের উত্তরই এখন সময়ের অপেক্ষা।
#কৃত্রিমবুদ্ধিমত্তা #প্রযুক্তি #ওপেনএআই #গুগল #মেটা #অ্যামাজন #স্যামঅল্টম্যান #এজিআই #সারাক্ষণরিপোর্ট