০৩:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৫

নুরুল মজিদ হুমায়ূনের মৃত্যু ও আন্তর্জাতিক রেডক্রসের অধীনে কারাগার

  • স্বদেশ রায়
  • ০৮:০০:২৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫
  • 252

মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ূন কারাগারে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগের দিনও হাসপাতালের বেডে তাঁর হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলছেন, এটা পরিপূর্ণরূপে মানবাধিকার লঙ্ঘন, এমনকি তাঁর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়াকেও তিনি মানবাধিকার পরিপন্থী বা লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন।

সাংবাদিকতার কারণে নুরুল মজিদ হুমায়ূনকে কয়েকবার দেখেছি ও তার কথাও শুনেছি। তিনি তখন যুবলীগের সম্ভবত একটা বড় দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে যুবলীগের দায়িত্বে ছিলেন মোস্তফা মহসিন মন্টু। তাঁর জায়গায় ঠিক নুরুল মজিদ হুমায়ূনকে মেলাতে পারতাম না। তবে তাঁকে রাজনীতির মাঠে দেখার আগেই তাঁর সম্পর্কে একটি ঘটনা জানতাম নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুস সামাদ ভাইয়ের মাধ্যমে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরে বৃহত্তর ঢাকা জেলার সামাদ কমান্ডারকে বেশিরভাগ লোকই জানতেন। এবং ঢাকার আশেপাশে তার বাহিনীর যুদ্ধের কাহিনী শুনে মনে করতাম, তিনি খুবই একজন দুর্ধর্ষ মানুষ হবেন। কিন্তু সংবাদপত্রে তাঁর সহকর্মী হবার পরে দেখলাম তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত একজন মানুষ। একেবারে নরম ও বিনয়ী। কাজের ফাঁকে বিশেষ করে, আলাউদ্দিন আহম্মদ ভাই (কমিউনিস্ট পার্টি আলাউদ্দিন-মতিন) এর আলাউদ্দিন আহম্মদ- মাঝে মাঝে সামাদ ভাইকে মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনা বলার জন্যে উসকে দিতেন। তার ভেতর একদিন তিনি বলেন, নরসিংদি জেলা তাঁরা নভেম্বর মাসেই মুক্ত করেছিলেন। সে সময়ে তাঁরা বেশ কিছু পাকিস্তানি আর্মি তাদের কাছে সারেন্ডার করে  রাজাকার ও আলবদরদের সঙ্গে। ওই পাকিস্তান আর্মিদের একটি ছেলের বয়স ছিল ২০ বছরেরও কম। একেবারে নিষ্পাপ শিশুর মতো তার মুখ। আবদুস সামাদ বলেন, “হুমায়ূন তাকে আমার কাছে নিয়ে আসে। আমি উর্দু জানতাম না। হুমায়ূন জানতো। তাই পাকিস্তান আর্মির সৈন্য ওই ছেলেটির ভাঙা ভাঙা উর্দু বক্তব্য হুমায়ূন ইন্টারপ্রেট করে। তার মাধ্যমে বুঝতে পারি, ওই ছেলেটি বলতে চাচ্ছে, যুদ্ধে আসার আগে তাদেরকে বলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে সব কাফের ও কাফেরদের সহায়তা করছে ইন্ডিয়া তাই কাফের ও ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে তাদেরকে জিহাদ করতে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এখানে এসে সে দেখে, এখানে বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান এবং তারা তাদের দেশের মানুষের থেকে বেশি ধর্মপ্রাণ ও ধর্মপালন করে। আর ইন্ডিয়া কাফেরদেরকে নয়, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাহায্য করছে। তাই সত্যি অর্থে সে এই সাত মাস এখানে এসেছে কিন্তু নিজে কাউকে হত্যা করেনি। সে এখন তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চায়”।

হাসপাতালের বিছানায় নুরুল মজিদের হাতকড়া নিয়ে বিতর্ক, যা বলছেন মানবাধিকারকর্মীরা | প্রথম আলো

সামাদ ভাই বলেন, “হুমায়ূনের ইন্টারপ্রিটেশনের মাধ্যমে এ শোনার পরে আমারও মায়া লাগে ফুটফুটে ও কিশোর মুখটি দেখে। তখন হুমায়ূনের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘কী করা যায়, তুমি বলো, হুমায়ূন’। হুমায়ূন বলে, কমান্ডার আমি তো বলতে পারি না, তবে…,”। বলে হুমায়ূন নাকি মাথা নীচু করে দাঁড়ান, তখন আবদুস সামাদ বলেন, “ঠিক আছে, তোমার কথাই আমি রাখছি, ওকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিও না। ওকে জেলে রেখে দাও। পরবর্তীতে ওই ছেলে ৯৭ হাজার আত্মসমর্পণকারীদের সঙ্গে ভারত হয়ে দেশে ফিরে গেছে”।

এর পরে রাজনীতির মাঠে নুরুল মজিদ হুমায়ূনের চালচলন ও ৮৬ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলের ও বিএনপির পরাক্রমশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধে তাঁর স্বতন্ত্র নির্বাচনের সময় আচরণ ও কথাবার্তা শুনে বার বার মনে হতো, কমান্ডার সামাদ তাঁর সম্পর্কে যে নরম মনের ঘটনা বলেছিলেন সেটা। বোঝা যেত, সত্যি তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী বড় পরিবারের সন্তান।

যাহোক, রাজনীতির পালাবদলে জেলখানায় তাঁর অমানবিক মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়েছে। হয়তো তাঁর পরিবার বা শুভানুধায়ীদের মতো তিনি নিজে অতটা কষ্ট পাননি এ মৃত্যুতে। কারণ, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা তাঁর এক্সটেনশন লাইফ। বরং তিনি বেঁচে থেকে যদি এমন মৃত্যু দেখতেন, তাহলে তাঁদের সৃষ্ট দেশের অপমান দেখে হয়তো আরো বেশি কষ্ট পেতেন।

যাহোক, নুরুল মজিদ হুমায়ূন ব্যক্তিগতভাবে কী মনে করেছেন মারা যাবার আগে–বা বেঁচে থেকে এমন মৃত্যু দেখে কী মনে করতেন তা বড় কথা নয়। বরং এই মৃত্যুর পরে বর্তমান সরকারকে যে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে জেলখানায় আছেন–তাদের বিষয় ও জেলখানার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

International Human Rights Commission IHRC Corporation - "Explore the International Human Rights Commission IHRC Alliance

কারণ, সরকারের কাঠামোর ওপর সরকার যারা চালাচ্ছেন তাদের নিয়ন্ত্রণ কতটা আছে তা বড় কথা নয়, বর্তমান আমলের যে কোনো অঘটনের দায় কিন্তু ভবিষ্যতে এই সরকারে যারা আছেন তাদেরকেই বহন করতে হবে। আর বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে এই সরকারকে ক্ষমতায় আনার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যাকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মাহফুজ আলম কিন্তু বর্তমানে প্রকাশ্যে বলেছেন, সরকারের বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক দলগুলো ভাগাভাগি করে তাদের লোক বসিয়েছে। তিনি উপদেষ্টা হিসেবে আতঙ্কে আছেন, কখন তাকে চলে যেতে হয়। তাছাড়া তিনি আরো বলেছেন, বর্তমানে এই সরকারে তারা যারা নির্বাহী আছেন তাদের নির্দেশ সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না।

মাহফুজ আলমের এই বক্তব্য ও নুরুল মজিদ হুমায়ূনের মৃত্যুর পরে তাই স্বাভাবিকই জেলখানা নিয়ে একটা আতঙ্ক তৈরি করে। কারণ, এ তো সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারস্পরিক প্রতিহিংসা খুবই বেশি–অন্যান্য দেশের তুলনায়। বর্তমান সরকারের আমলেও এই প্রতিহিংসা প্রশমিত করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং অনেক ঘটনার ভেতর দিয়ে উসকে দেয়া হয়েছে।

তাই যখন প্রশাসন সরকারের কথা শুনছে না সে সময়ে প্রতিহিংসা যে জেলখানা অবধি যাবে না–তার নিশ্চয়তা কিন্তু কম থাকে স্বাভাবিকভাবে। এবং এর উদাহরণও এ দেশে আছে। পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ স্থান জেলখানাতেও এদেশে ঘটেছে নির্মম হত্যাকাণ্ড।

জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কারণ কী ছিল

আর এই হত্যাকাণ্ড কে বা কারা ঘটালো তা কিন্তু আজো পরিষ্কার নয়। ১৯৯১ এ ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস নিয়ে আতাউস সামাদ ভাই আমাকে দিয়ে একটা রিপোর্ট করান। ওই রিপোর্ট করতে গিয়ে আমি কর্নেল ফারুক (অব.) কে ফোন করে কীভাবে এবং কারা জেল হত্যা ঘটালো এ বিষয়ে তাকে নানান প্রশ্ন করতে থাকলে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “৩ নভেম্বরের জেল হত্যা কীভাবে ঘটলো এ নিয়ে আপনার মতো আমারও প্রশ্ন, কারা এটা ঘটালো, কারণ ওই ঘটনায় আমার ফুপাও মারা যান”।

কর্নেল ফারুক শতভাগ সত্য বলেছিলেন কিনা সেটা বলা উচিত নয়। তবে এর পাশাপাশি আরো একটি ঘটনা সাংবাদিকতা করতে গিয়ে জেনেছি, ১৯৭৫ এর অক্টোবরে প্রথম দিকেই তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিন দেখা করতে গেলে তিনি তাঁকে দিয়ে বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতির প্রেসিডেন্ট ময়েজউদ্দিন আহমদকে সংবাদ পাঠান, ময়েজউদ্দিন যেন আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে অবিলম্বে বাংলাদেশের জেলখানা রেডক্রসের আন্ডারে নিতে বলেন। এবং জোহরা তাজউদ্দিন অক্টোবরে শেষ সপ্তাহে যখন দেখা করতে যান তখন জোহরা তাজউদ্দিনকে তাজউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, তুমি ময়েজউদ্দিনকে বলো এক সপ্তাহের ভেতর কিছু করতে অর্থাৎ জেলখানা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের অধীনে নিতে -তা নহলে আমরা খুব শীঘ্রই নিহত হবো। ময়েজউদ্দিন আহমদের কাছেও ঘটনার সত্যতা জেনেছি এবং তিনি বলেন, সরকারের সহায়তা না পাবার কারণে তিনি সেটা করতে পারেননি।

International Committee of the Red Cross (ICRC) | World Economic Forum

বর্তমান সরকার শুরু থেকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা জুলাই ও আগস্টের ১৫ তারিখ অবধি যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন দিয়ে তদন্ত করিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিষয়েও জাতিসংঘকে ইনভলভ করার সব ধরনের চেষ্টা করছে।

তাই নুরুল মজিদ হুমায়ূনের মৃত্যু ও মাহফুজ আলমের এ বক্তব্যের পরে বাস্তবতা মেনে নিয়ে বর্তমান সরকার, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য মানবাধিকার কমিশনকে জেলখানার বন্দীদের নিরাপত্তা ও তাঁদের চিকিৎসা নিয়ে বাস্তবভিত্তিক চিন্তা করতে হবে। সেক্ষেত্রে জেলখানাকে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের আন্ডারে নেয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। আর সেটাই মনে হয় সরকারের জন্যে ভবিষ্যতে জেলখানায় যাতে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে–তা থেকে রক্ষা পাবার সঠিক পথ হবে।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

জনপ্রিয় সংবাদ

নুরুল মজিদ হুমায়ূনের মৃত্যু ও আন্তর্জাতিক রেডক্রসের অধীনে কারাগার

০৮:০০:২৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫

মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ূন কারাগারে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগের দিনও হাসপাতালের বেডে তাঁর হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলছেন, এটা পরিপূর্ণরূপে মানবাধিকার লঙ্ঘন, এমনকি তাঁর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পাওয়াকেও তিনি মানবাধিকার পরিপন্থী বা লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন।

সাংবাদিকতার কারণে নুরুল মজিদ হুমায়ূনকে কয়েকবার দেখেছি ও তার কথাও শুনেছি। তিনি তখন যুবলীগের সম্ভবত একটা বড় দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে যুবলীগের দায়িত্বে ছিলেন মোস্তফা মহসিন মন্টু। তাঁর জায়গায় ঠিক নুরুল মজিদ হুমায়ূনকে মেলাতে পারতাম না। তবে তাঁকে রাজনীতির মাঠে দেখার আগেই তাঁর সম্পর্কে একটি ঘটনা জানতাম নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুস সামাদ ভাইয়ের মাধ্যমে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ও পরে বৃহত্তর ঢাকা জেলার সামাদ কমান্ডারকে বেশিরভাগ লোকই জানতেন। এবং ঢাকার আশেপাশে তার বাহিনীর যুদ্ধের কাহিনী শুনে মনে করতাম, তিনি খুবই একজন দুর্ধর্ষ মানুষ হবেন। কিন্তু সংবাদপত্রে তাঁর সহকর্মী হবার পরে দেখলাম তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত একজন মানুষ। একেবারে নরম ও বিনয়ী। কাজের ফাঁকে বিশেষ করে, আলাউদ্দিন আহম্মদ ভাই (কমিউনিস্ট পার্টি আলাউদ্দিন-মতিন) এর আলাউদ্দিন আহম্মদ- মাঝে মাঝে সামাদ ভাইকে মুক্তিযুদ্ধের নানান ঘটনা বলার জন্যে উসকে দিতেন। তার ভেতর একদিন তিনি বলেন, নরসিংদি জেলা তাঁরা নভেম্বর মাসেই মুক্ত করেছিলেন। সে সময়ে তাঁরা বেশ কিছু পাকিস্তানি আর্মি তাদের কাছে সারেন্ডার করে  রাজাকার ও আলবদরদের সঙ্গে। ওই পাকিস্তান আর্মিদের একটি ছেলের বয়স ছিল ২০ বছরেরও কম। একেবারে নিষ্পাপ শিশুর মতো তার মুখ। আবদুস সামাদ বলেন, “হুমায়ূন তাকে আমার কাছে নিয়ে আসে। আমি উর্দু জানতাম না। হুমায়ূন জানতো। তাই পাকিস্তান আর্মির সৈন্য ওই ছেলেটির ভাঙা ভাঙা উর্দু বক্তব্য হুমায়ূন ইন্টারপ্রেট করে। তার মাধ্যমে বুঝতে পারি, ওই ছেলেটি বলতে চাচ্ছে, যুদ্ধে আসার আগে তাদেরকে বলা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে সব কাফের ও কাফেরদের সহায়তা করছে ইন্ডিয়া তাই কাফের ও ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে তাদেরকে জিহাদ করতে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু এখানে এসে সে দেখে, এখানে বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান এবং তারা তাদের দেশের মানুষের থেকে বেশি ধর্মপ্রাণ ও ধর্মপালন করে। আর ইন্ডিয়া কাফেরদেরকে নয়, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাহায্য করছে। তাই সত্যি অর্থে সে এই সাত মাস এখানে এসেছে কিন্তু নিজে কাউকে হত্যা করেনি। সে এখন তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চায়”।

হাসপাতালের বিছানায় নুরুল মজিদের হাতকড়া নিয়ে বিতর্ক, যা বলছেন মানবাধিকারকর্মীরা | প্রথম আলো

সামাদ ভাই বলেন, “হুমায়ূনের ইন্টারপ্রিটেশনের মাধ্যমে এ শোনার পরে আমারও মায়া লাগে ফুটফুটে ও কিশোর মুখটি দেখে। তখন হুমায়ূনের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘কী করা যায়, তুমি বলো, হুমায়ূন’। হুমায়ূন বলে, কমান্ডার আমি তো বলতে পারি না, তবে…,”। বলে হুমায়ূন নাকি মাথা নীচু করে দাঁড়ান, তখন আবদুস সামাদ বলেন, “ঠিক আছে, তোমার কথাই আমি রাখছি, ওকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দিও না। ওকে জেলে রেখে দাও। পরবর্তীতে ওই ছেলে ৯৭ হাজার আত্মসমর্পণকারীদের সঙ্গে ভারত হয়ে দেশে ফিরে গেছে”।

এর পরে রাজনীতির মাঠে নুরুল মজিদ হুমায়ূনের চালচলন ও ৮৬ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলের ও বিএনপির পরাক্রমশালী প্রার্থীর বিরুদ্ধে তাঁর স্বতন্ত্র নির্বাচনের সময় আচরণ ও কথাবার্তা শুনে বার বার মনে হতো, কমান্ডার সামাদ তাঁর সম্পর্কে যে নরম মনের ঘটনা বলেছিলেন সেটা। বোঝা যেত, সত্যি তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী বড় পরিবারের সন্তান।

যাহোক, রাজনীতির পালাবদলে জেলখানায় তাঁর অমানবিক মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়েছে। হয়তো তাঁর পরিবার বা শুভানুধায়ীদের মতো তিনি নিজে অতটা কষ্ট পাননি এ মৃত্যুতে। কারণ, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা তাঁর এক্সটেনশন লাইফ। বরং তিনি বেঁচে থেকে যদি এমন মৃত্যু দেখতেন, তাহলে তাঁদের সৃষ্ট দেশের অপমান দেখে হয়তো আরো বেশি কষ্ট পেতেন।

যাহোক, নুরুল মজিদ হুমায়ূন ব্যক্তিগতভাবে কী মনে করেছেন মারা যাবার আগে–বা বেঁচে থেকে এমন মৃত্যু দেখে কী মনে করতেন তা বড় কথা নয়। বরং এই মৃত্যুর পরে বর্তমান সরকারকে যে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে জেলখানায় আছেন–তাদের বিষয় ও জেলখানার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

International Human Rights Commission IHRC Corporation - "Explore the International Human Rights Commission IHRC Alliance

কারণ, সরকারের কাঠামোর ওপর সরকার যারা চালাচ্ছেন তাদের নিয়ন্ত্রণ কতটা আছে তা বড় কথা নয়, বর্তমান আমলের যে কোনো অঘটনের দায় কিন্তু ভবিষ্যতে এই সরকারে যারা আছেন তাদেরকেই বহন করতে হবে। আর বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, মেটিকুলাস ডিজাইনের মাধ্যমে এই সরকারকে ক্ষমতায় আনার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যাকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মাহফুজ আলম কিন্তু বর্তমানে প্রকাশ্যে বলেছেন, সরকারের বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক দলগুলো ভাগাভাগি করে তাদের লোক বসিয়েছে। তিনি উপদেষ্টা হিসেবে আতঙ্কে আছেন, কখন তাকে চলে যেতে হয়। তাছাড়া তিনি আরো বলেছেন, বর্তমানে এই সরকারে তারা যারা নির্বাহী আছেন তাদের নির্দেশ সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না।

মাহফুজ আলমের এই বক্তব্য ও নুরুল মজিদ হুমায়ূনের মৃত্যুর পরে তাই স্বাভাবিকই জেলখানা নিয়ে একটা আতঙ্ক তৈরি করে। কারণ, এ তো সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারস্পরিক প্রতিহিংসা খুবই বেশি–অন্যান্য দেশের তুলনায়। বর্তমান সরকারের আমলেও এই প্রতিহিংসা প্রশমিত করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং অনেক ঘটনার ভেতর দিয়ে উসকে দেয়া হয়েছে।

তাই যখন প্রশাসন সরকারের কথা শুনছে না সে সময়ে প্রতিহিংসা যে জেলখানা অবধি যাবে না–তার নিশ্চয়তা কিন্তু কম থাকে স্বাভাবিকভাবে। এবং এর উদাহরণও এ দেশে আছে। পৃথিবীর সব থেকে নিরাপদ স্থান জেলখানাতেও এদেশে ঘটেছে নির্মম হত্যাকাণ্ড।

জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কারণ কী ছিল

আর এই হত্যাকাণ্ড কে বা কারা ঘটালো তা কিন্তু আজো পরিষ্কার নয়। ১৯৯১ এ ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবস নিয়ে আতাউস সামাদ ভাই আমাকে দিয়ে একটা রিপোর্ট করান। ওই রিপোর্ট করতে গিয়ে আমি কর্নেল ফারুক (অব.) কে ফোন করে কীভাবে এবং কারা জেল হত্যা ঘটালো এ বিষয়ে তাকে নানান প্রশ্ন করতে থাকলে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “৩ নভেম্বরের জেল হত্যা কীভাবে ঘটলো এ নিয়ে আপনার মতো আমারও প্রশ্ন, কারা এটা ঘটালো, কারণ ওই ঘটনায় আমার ফুপাও মারা যান”।

কর্নেল ফারুক শতভাগ সত্য বলেছিলেন কিনা সেটা বলা উচিত নয়। তবে এর পাশাপাশি আরো একটি ঘটনা সাংবাদিকতা করতে গিয়ে জেনেছি, ১৯৭৫ এর অক্টোবরে প্রথম দিকেই তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিন দেখা করতে গেলে তিনি তাঁকে দিয়ে বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতির প্রেসিডেন্ট ময়েজউদ্দিন আহমদকে সংবাদ পাঠান, ময়েজউদ্দিন যেন আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে অবিলম্বে বাংলাদেশের জেলখানা রেডক্রসের আন্ডারে নিতে বলেন। এবং জোহরা তাজউদ্দিন অক্টোবরে শেষ সপ্তাহে যখন দেখা করতে যান তখন জোহরা তাজউদ্দিনকে তাজউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, তুমি ময়েজউদ্দিনকে বলো এক সপ্তাহের ভেতর কিছু করতে অর্থাৎ জেলখানা আন্তর্জাতিক রেডক্রসের অধীনে নিতে -তা নহলে আমরা খুব শীঘ্রই নিহত হবো। ময়েজউদ্দিন আহমদের কাছেও ঘটনার সত্যতা জেনেছি এবং তিনি বলেন, সরকারের সহায়তা না পাবার কারণে তিনি সেটা করতে পারেননি।

International Committee of the Red Cross (ICRC) | World Economic Forum

বর্তমান সরকার শুরু থেকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা জুলাই ও আগস্টের ১৫ তারিখ অবধি যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন দিয়ে তদন্ত করিয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিষয়েও জাতিসংঘকে ইনভলভ করার সব ধরনের চেষ্টা করছে।

তাই নুরুল মজিদ হুমায়ূনের মৃত্যু ও মাহফুজ আলমের এ বক্তব্যের পরে বাস্তবতা মেনে নিয়ে বর্তমান সরকার, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য মানবাধিকার কমিশনকে জেলখানার বন্দীদের নিরাপত্তা ও তাঁদের চিকিৎসা নিয়ে বাস্তবভিত্তিক চিন্তা করতে হবে। সেক্ষেত্রে জেলখানাকে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের আন্ডারে নেয়ার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। আর সেটাই মনে হয় সরকারের জন্যে ভবিষ্যতে জেলখানায় যাতে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে–তা থেকে রক্ষা পাবার সঠিক পথ হবে।

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.