তাই পোতে শোক, ক্ষোভ আর অসহায়তা
হংকংয়ের তাই পো এলাকার ওয়াং ফুক কোর্ট আবাসিক টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এক সপ্তাহ পর ধীরে ধীরে বাসিন্দারা নিজেদের ফেলে আসা জিনিসপত্র তুলতে ফিরছেন। পুড়ে যাওয়া করিডর, গলে যাওয়া লিফট দরজা আর সিঁড়িতে জমে থাকা ছাই পেরিয়ে অনেকেই কাঁপা পায়ে উঠছেন ওপরতলায়, সঙ্গে রয়েছে পুলিশ ও দমকলের সদস্যরা। অস্থায়ীভাবে খোলা হয়েছে পরামর্শকেন্দ্র, যেখানে মনোবিজ্ঞানী আর স্বেচ্ছাসেবকেরা আতঙ্কগ্রস্ত পরিবারগুলোকে মানসিক সহায়তা দিতে বসে আছেন। কেউ প্রতিবেশী হারিয়েছেন, কেউ আবার পরিবারের একাধিক সদস্যকে; অনেকেই এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে এত দ্রুত সবকিছু বদলে গেল।
তবে এই প্রত্যাবর্তন শুধুই আবেগের কারণে নয়, বাস্তব প্রয়োজনও আছে। পাসপোর্ট, শিক্ষা সনদ, জুয়েলারি, পুরনো অ্যালবাম—যা বাঁচানো যায়, তা নিয়ে বেরোনোর জন্য মানুষ আসছেন খালি ব্যাগ ও ট্রলি নিয়ে। বয়স্ক বাসিন্দাদের জিনিস নামিয়ে দিতে তরুণ স্বেচ্ছাসেবকেরা হাত বাড়াচ্ছেন, আর পাশের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছে দিচ্ছেন ত্রাণের খাবার ও প্রয়োজনীয় ওষুধ। অনেকে বলছেন, রাতের সেই দমবন্ধ করা ধোঁয়া, অগ্নিসirেনের আওয়াজ আর সিঁড়িঘরে হুড়োহুড়ির দৃশ্য বারবার মনে ভেসে উঠছে; ঘুমালেও যেন আগুনের গন্ধ নাকে লেগে থাকে।

এটি কয়েক দশকের মধ্যে হংকংয়ের সবচেয়ে প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ড, যা ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অননুমোদিত সংস্কার আর জরুরি সেবার কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন তুলেছে। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন তলায় বাড়তি কক্ষ বানানো, করিডরে মালপত্র জমিয়ে রাখা এবং পুরনো বৈদ্যুতিক সংযোগ আগুনের গতি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। নিহতদের পরিবার ও বাসিন্দারা বিচার বিভাগের নেতৃত্বে খোলামেলা জন শুনানিসহ স্বাধীন তদন্তের দাবি তুলেছেন, যাতে ভবন কোড, অনুমোদন প্রক্রিয়া ও উদ্ধার তৎপরতার প্রতিটি ধাপ খতিয়ে দেখা যায়। সরকারের পক্ষ থেকে বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিশেষ তদন্ত কমিটির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যদিও অনেকেই এখনও সন্দিহান।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি শহরের পুরনো আবাসিক এলাকাগুলোর ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘদিনের এক উদ্বেগকে সামনে এনে দিয়েছে। সীমিত জায়গায় গাদাগাদি করে থাকা বাসিন্দা, অনানুষ্ঠানিক দেয়াল তোলা ঘর, সরু সিঁড়ি আর পুরনো বৈদ্যুতিক তার—সব মিলিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদেরা। বিভিন্ন চ্যারিটি ও এনজিওতে ফোন করে এখন অনেকেই জানতে চাইছেন কীভাবে বাড়িওলাদের সঙ্গে বিরোধ না বাড়িয়ে ঝুঁকির কথা জানানো যায়। একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলছেন, কেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আগেই সতর্কবার্তা পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি।
নির্বাচন এগোলেও ভোটারদের মন এখনও আগুনেই আটকে
এই শোক ও অনিশ্চয়তার মধ্যেই শহরটি এগোচ্ছে আইনসভা পরিষদের নতুন নির্বাচনের দিকে, যেখানে কেবল আগেই যাচাই করা ‘দেশপ্রেমিক’ প্রার্থীরাই অংশ নিতে পারবেন। সরকার বলছে, সময়মতো নির্বাচন না হলে আইন প্রণয়নকারী সংস্থায় শূন্যতা সৃষ্টি হবে এবং সেটা শহরের স্থিতিশীলতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণেই ভোট স্থগিত না করে সামনের দিকে এগোনোকে তারা দায়িত্বশীল পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরছে। তবে এবার প্রচারপর্ব অনেকটাই স্বল্পপ্রচার ও নীরব; অনেক প্রার্থী জাঁকজমক কমিয়ে সরাসরি বাড়ি গিয়ে দেখা করা, ছোট ছোট বৈঠক আর অনলাইন প্রচারে জোর দিচ্ছেন।
নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিরোধী শিবিরের অনেক পুরনো মুখই এখন অনুপস্থিত। সমালোচকদের মতে, রাজনৈতিক মতবিরোধের পরিসর এতটাই সংকুচিত হয়েছে যে সাধারণ ভোটারদের আলোচনার ক্ষেত্রও ছোট হয়ে গেছে। তাই পোতে যাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকছেন বা অস্থায়ীভাবে আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন, তাঁদের কাছে ভোট এখন দ্বিতীয় অগ্রাধিকার; প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা। এলাকায় কাজ করা সমাজকর্মীরা ধারণা করছেন, উপস্থিত ভোটারের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম হতে পারে।

সরকারঘনিষ্ঠ রাজনীতিকেরা অবশ্য যুক্তি দিচ্ছেন, নির্বাচনও এই মুহূর্তে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার একটি উপায়। তাঁদের দাবি, প্রভাবশালী আইনপ্রণেতারা নির্বাচিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দ্রুত বাজেট ও প্রকল্প টেনে আনা সম্ভব হবে, পুরনো আবাসিক টাওয়ারগুলোর নিরাপত্তা দ্রুত জোরদার করা যাবে। একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতিনির্ধারণে ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মাঝেও হংকং তার বাণিজ্যিক মর্যাদা ধরে রাখতে পারবে।
তবু মাঠের ছবিতে ক্লান্তি আর অবিশ্বাস স্পষ্ট। অনেক বাসিন্দা বলছেন, তাঁরা হয়তো ভোট দিতে যাবেন না, কিংবা গেলেও নামমাত্র ভোট দেবেন; তাঁদের কাছে বিচার, স্বচ্ছতা আর নিরাপদ বাসস্থানের প্রতিশ্রুতি অনেক বেশি জরুরি। তাই পো’র সিঁড়িঘর থেকে এখনো ধোঁয়ার গন্ধ পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি, আর সেই গন্ধই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে—কাগজে-কলমে নির্বাচন যতই নিয়মমাফিক হোক, আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

















