বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ, বিপুল বিনিয়োগ এবং প্রচুর প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সরকারি জরিপ ও স্বাধীন গবেষণার তথ্য বলছে, কর্মক্ষেত্রে এআই ব্যবহারের হার আশানুরূপ বাড়ছে না; বরং কিছু ক্ষেত্রে কমছে। এই মন্থরতা বৈশ্বিক উৎপাদনশীলতা, করপোরেট বিনিয়োগ এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর বড় প্রশ্ন তুলছে।
এআই ব্যবহারের হার কমার সাম্প্রতিক প্রমাণ
নভেম্বর ২০ তারিখে মার্কিন সেনসাস ব্যুরো তাদের নতুন জরিপের ফল প্রকাশ করে। দেখা যায়, গত দুই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে এআই ব্যবহারকারীর হার কর্মসংস্থান-ওজনভিত্তিক হিসাবে কমে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে। সবচেয়ে বড় পতন দেখা গেছে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে, যেখানে ২৫০ জনের বেশি কর্মী কাজ করেন। জেনারেটিভ এআই বিপ্লব শুরু হওয়ার তিন বছর পরও প্রযুক্তির চাহিদা এতটা দুর্বল হওয়া অনেককে বিস্মিত করছে।
এআই গ্রহণের ধীরগতির বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রভাব
এআইকে বৈশ্বিক উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা হলেও বাস্তবে সেই অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সাধারণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিনের কাজে এআই যথেষ্ট হারে অন্তর্ভুক্ত না করতে পারলে প্রত্যাশিত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। একই সঙ্গে এটি নির্ধারণ করবে বিশ্ব বর্তমানে এআই-বুদবুদের মধ্যে আছে কি না।
২০২৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে এআই সেবা সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়তে। এই বিনিয়োগে লাভ আনতে প্রতিবছর প্রায় ৬৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের প্রয়োজন হবে, যা বর্তমানে মাত্র প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। ব্যক্তিগত জীবনে এআই ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা থাকায় প্রকৃত চাহিদার বড় অংশই আসতে হবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
অন্য গবেষণাতেও একই চিত্র
সেনসাস ব্যুরোর তথ্য একমাত্র নয়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানও দেখছে যে এআই গ্রহণের হার প্রত্যাশার তুলনায় কম এবং বাড়ছে খুব ধীরগতিতে।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকারি জরিপের ভাষা কিছুটা সীমিত—“পণ্য বা সেবা উৎপাদনে এআই ব্যবহার”—এটি কর্মী বা ব্যবস্থাপকের কাছে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে। অন্যদিকে, সরকারি সংস্থার সমর্থকেরা মনে করেন, তাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্কই দেশের সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করে, শুধু প্রযুক্তিনির্ভর নয়।
তবুও বেশিরভাগ অনানুষ্ঠানিক গবেষণাতেও স্থবিরতার প্রমাণ মিলছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জন হার্টলি ও তাঁর সহকর্মীরা দেখিয়েছেন, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে কর্মক্ষেত্রে জেনারেটিভ এআই ব্যবহারকারীর হার ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে, যা জুনে ছিল ৪৬ শতাংশ।
সেন্ট লুইস ফেডের গবেষণায় দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্টে যেখানে ১২.১ শতাংশ কর্মক্ষম বয়সী মানুষ প্রতিদিন কর্মস্থলে এআই ব্যবহার করতেন, এক বছর পরে সেই হার দাঁড়ায় ১২.৬ শতাংশে। ফিনটেক প্রতিষ্ঠান র্যাম্প দেখেছে, ২০২৫ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোতে এআই ব্যবহার ৪০ শতাংশে উঠলেও পরে তা আর বাড়েনি।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট—এআই গ্রহণের গতি সত্যিই কমছে।
সম্ভাব্য কারণ: অনিশ্চয়তা ও প্রযুক্তি বিস্তারের ধীর ইতিহাস
এআই গ্রহণের স্থবিরতার একটি বড় কারণ বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। বাণিজ্যযুদ্ধ, কম অভিবাসন এবং সুদের হার নিয়ে অস্থিরতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন বিনিয়োগে দ্বিধায় ফেলছে।
এ ছাড়া প্রযুক্তি বিস্তারের ইতিহাস বলছে, নতুন প্রযুক্তি সাধারণত ধাপে ধাপে ছড়ায়। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে মার্কিন ঘরোয়া কম্পিউটার ব্যবহারের হার কমে গিয়েছিল সাময়িকভাবে; কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
কম সুখকর ব্যাখ্যা: প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও এআই সম্পর্কে সংশয়
এআই গ্রহণ কমার আরেকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কাঠামোতে। শীর্ষ নির্বাহীরা এআই নিয়ে প্রবল আশাবাদে কথা বললেও—সম্প্রতি এসঅ্যান্ডপি ৫০০ কোম্পানির দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাহী আয় প্রতিবেদন আলোচনায় এআই উল্লেখ করেছেন—বাস্তবে যাঁদের এআই প্রয়োগ করতে হবে, সেই ব্যবস্থাপক ও কর্মীরা ততটা উৎসাহী নন।
ডেফোর্সের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, নির্বাহীদের ৮৭ শতাংশ এআই ব্যবহার করেন, ব্যবস্থাপকদের ৫৭ শতাংশ এবং কর্মীদের মাত্র ২৭ শতাংশ এটি ব্যবহার করছেন। অনেক ক্ষেত্রে মাঝারি পর্যায়ের ব্যবস্থাপকরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্তুষ্ট করতে এআই কর্মসূচি শুরু করলেও পরে নীরবে তা বন্ধ করে দেন।
এ ছাড়া এআই-এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে, কারণ বর্তমান প্রজন্মের মডেল এখনো বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা রূপান্তরের মতো শক্তিশালী নয়। বর্তমান ব্যবহারকারীরা যদি মনে করেন যে এআই পর্যাপ্ত রিটার্ন দিচ্ছে না, সম্ভাব্য নতুন ব্যবহারকারীরাও পিছিয়ে থাকতে পারেন।
শেয়ারবাজারের প্রতিক্রিয়া
গোল্ডম্যান স্যাকস একটি বিশেষ সূচক তৈরি করেছে, যেখানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন কোম্পানি যারা এআই ব্যবহারের মাধ্যমে বেশি আয়ের সম্ভাবনা রাখে—যেমন ফোর্ড, এইচঅ্যান্ডআর ব্লক এবং নিউজ কর্প। দীর্ঘদিন এই সূচক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেও সাম্প্রতিক সময়ে তা পিছিয়ে পড়েছে।
অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা এখনো বিশ্বাস করছেন না যে এআই বাস্তবে কোম্পানির মুনাফা বা প্রবৃদ্ধি বাড়াচ্ছে।
নির্বাহী জরিপ
ডেলয়েট এবং হংকং ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর এআই, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অর্গানাইজেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, নির্বাহীদের ৪৫ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের এআই প্রকল্প প্রত্যাশার চেয়ে কম ফল দিয়েছে। মাত্র ১০ শতাংশ জানিয়েছেন প্রত্যাশা ছাড়িয়েছে।
ম্যাককিনসের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক মুনাফায় এআই এখনো বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি।
অর্থনৈতিক গবেষণা
স্বল্পমেয়াদে এআই প্রয়োগ উল্টো উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে। নতুন আইটি সিস্টেম ও কর্মপ্রবাহ সাজাতে সময় লাগে, যা প্রথমে দক্ষতা কমায়—একে বলা হয় “প্রোডাক্টিভিটি জে-কার্ভ”।
সাংহাই টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়িভন চেন ও সহকর্মীদের গবেষণায় উঠে এসেছে “জেনএআই মিডিওক্রিটি ট্র্যাপ” ধারণা, যেখানে দেখা গেছে এআই কম দক্ষ কর্মীদের সাহায্য করলেও দক্ষ কর্মীরা “যা আছে যথেষ্ট” ভেবে কম উদ্যমে কাজ করতে পারেন, ফলে সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং সতর্ক সংকেত
যদিও এআই গ্রহণে বর্তমানে স্থবিরতা রয়েছে, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলো সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তিকে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে শিখবে, আর এআই মডেলও ক্রমাগত উন্নত হবে।
কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতার দৃশ্যমান উন্নতি দেখা দিলে প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝতে পারবে—এআই ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়।
তবুও বর্তমান বিরতি ইঙ্গিত দেয় যে এআই থেকে অর্থনৈতিক সুফল আসবে ধীরে, অসমভাবে এবং বর্তমানে যে বিনিয়োগ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে তার তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়ে। এআই গ্রহণ দ্রুত না বাড়লে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মূলধনী ব্যয়ের যৌক্তিকতা অর্জন কঠিন হয়ে উঠবে।
#টেক #এআই #ব্যবসা #অর্থনীতি #উৎপাদনশীলতা
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















