বিশ্বে আদর্শের বিভাজন
পৃথিবীর সব দেশই প্রায় দুটো আইডিওলজিতে বিভক্ত—উদার ও রক্ষণশীল । বাংলাদেশে এই উদার ও রক্ষণশীল আইডিওলজি ভিন্ন নামে পরিচিত—মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি। অন্য দেশে এই দুই আইডিওলজি পরস্পর আদর্শগতভাবে বিরোধী হলেও দেশকে রক্তাক্ত করে না।
বাংলাদেশে গত ৫৫ বছরে এই দুই পক্ষের সংঘাতে দেশ প্রায় সময় রক্তাক্ত থাকে। আর রক্তাক্ত সাগরে বা রেড সি-তে কখনও ওল্ড ম্যান থাকে, কখনও ইয়াং ম্যান থাকে। তবে ধারণা করার কোনো কারণ নেই যে ওল্ড ম্যান সি-কে আরও বেশি রেড করার জন্য ইয়াং ম্যানের থেকে কম পারদর্শী। বরং কখনও কখনও ওল্ড ম্যান ইয়াং ম্যানকে ছাড়িয়ে যায়।
পরিবারভিত্তিক প্রভাব
অন্য দেশেও এই আইডিওলজি পরিবারভিত্তিক হয়। তবে ওই দেশগুলোতে পরিবারভিত্তিক হলেও সে আইডিওলজি কখনও দেশের সংবিধান বিরোধী হয় না, দেশের ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি বিরোধী হয় না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির আইডিওলজি সব সময়ই মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে দেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক যে সংবিধান তৈরি হয়েছে তার পক্ষে। আর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা সব সময়ই এই সংবিধানের পরিবর্তনের জন্য একটি রিসেট বাটন হাতে নিয়ে ঘোরে।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দ্বন্দ্ব
এই বিভক্তি ১৯৭১ সালের পর থেকে শুরু হয়নি। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে প্রগতিশীল বাঙালি হওয়ার পথে যাত্রা শুরু হয়, সে সময়ে যাদের পিতা বা পিতামহরা ওই প্রগতিশীল যাত্রার পক্ষে ছিলেন না, তাদের বংশধররা এখনও প্রগতিশীল বাঙালিত্বের বিপক্ষে। আর যারা ওই প্রগতিশীল বাঙালিত্বের পক্ষে যাত্রা করেছিলেন, তাদের উত্তরাধিকারীরা এখনও বাঁচা-মরার লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে ওই প্রগতিশীলতার পক্ষে।
আইয়ুব খানের আমলে এ দেশের যে বুদ্ধিজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে ছিলেন—যাদের পূর্ণ তালিকা ও বিবরণ লেখক আবদুল হকের প্রকাশিত ডায়েরিতে পাওয়া যায়—তাদের সন্তানরা ছলে, কৌশলে ও অসীম প্রজ্ঞা ব্যবহার করে অতি চমৎকার খোলস পরে সেই অবস্থানেই আছে। আধুনিকতার খোলসকে কাজে লাগিয়ে সেই অবস্থানকে আরও এগিয়ে নেবার চেষ্টা করছে।
আবার ১৯৭১ সালে যাদের পিতা বা পিতামহ রাজাকার, আলবদর, আল-শামস ছিল, বা যাদের ভাই বা অন্যরা এই পথে ছিল, তারা এখনও হাতে ওই রিসেট বাটনটি নিয়ে ঘুরছে—যদি কোনোভাবে চাপ দিয়ে আলাদিনের দৈত্যকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭১ সালে যে আশা করেছিল তা পূর্ণ করা যায়। অনেকখানি যে করতে পেরেছে সে সাফল্যকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবু তো, পতাকা, সংবিধান, জাতীয় স্মৃতিসৌধ এখনও আছে। এগুলো তাদের জন্য যন্ত্রণা।
উত্তরাধিকার ও আদর্শের ধারা
যাদের পিতা বা পিতামহ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, বা দেশের ভেতর থেকেও মুক্তিযুদ্ধের জন্য জীবনপণ করেছিলেন, নিজেদের একটি দেশ চেয়েছিলেন—তারা এখনও সেই ধারা বহন করে।
অন্য দেশে যেহেতু বিষয়টি আদর্শগত দ্বন্দ্ব, তাই রেড সি সৃষ্টি হয় না। সেখানে বিষয়টি রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে সংঘাতটি যেহেতু একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার মতো—কখনো কখনো রিসেট বাটন চেপে একেবারে আলাদিনের দৈত্য দিয়ে ভস্ম করে দেবার মতো—তাই যেখানে বিষয়টি যত সংঘাতপূর্ণ হয়, ততই সেটা মানুষের মনে কঠিন বা শক্তিশালী অবস্থান নেয়।
কাল্ট ও মানসিক শক্তি
বাংলাদেশে উভয় পক্ষে সেটাই ঘটেছে। এবং তা অনেকটা ধর্মের মতো রূপ নিয়েছে। যখন কোনো কিছু ধর্মের মতো রূপ নেয়, তখন হিসেব করতে হয় কোন পক্ষে কত বড় মাপের কাল্ট আছে। যে পক্ষে যত বড় কাল্ট থাকে, ওই পক্ষের মানসিক শক্তি তত শক্তিশালী হয়।
বাংলাদেশে যেহেতু এই আদর্শ বংশগতিতে চলে গেছে, তাই যখনই নিপীড়ন হয় তখনই এর স্ফুরণ ঘটে বেশি। কাল্ট অনুসারীরা অনেকটা রক্তবীজের মতো—নিপীড়ন তাদের জন্য নতুন করে জন্ম নেবার সুযোগ করে দেয়।
পুরাণকথায়ও দেখা যায়, দেবতাদের আক্রমণেও মানুষের রক্ত থেকে একের পর রক্তবীজের জন্ম হতে থাকে এবং তারা দেবতাদের পরাজিত করে। সব মিথোলজিতে এ ধরনের কাহিনী পাওয়া যায়। মিথোলজিগুলো মূলত কোনো না কোনো সময়ের ইতিহাসের হয়তো একটু অতিরঞ্জিত বা কমরঞ্জিত সাহিত্য ছাড়া আর কিছু নয়।
ভোটের বাস্তবতা
বাংলাদেশে যে সকল প্রকৃত প্রতিষ্ঠান বা প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তির অধীনে নির্বাচন বা আদর্শগত সমর্থন নিয়ে জরিপ হয়েছে, তাতে দেখা গেছে বংশগতির এই অনুসারীর ধারা যাদের কাল্ট সবচেয়ে বড়, তাদেরই বেশি। তাদের মূল ভোটের ৪০ ভাগের বেশি আসে বংশগতির ধারা থেকে। বাকিরা ছোট ছোট কাল্টের কারণে এত বড় বংশগত ভোট তৈরি করতে পারেনি। তাদেরকে অর্থ দিয়ে কর্মীবাহিনী পালাতে হয়।
তাই এ দেশে যদি কারো বিশ্বাস হয় যে কোনো বড় কাল্টের পক্ষে লাখ লোকও নেই—সেটা সত্য নয়। বরং কোটি-তে গিয়ে গুনতে হবে। যেহেতু বিষয়টা অনেকটা ধর্মের মতো মনে ও আচরণে জড়িয়ে গেছে।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতা
একজন ষাটের দশকের রবীন্দ্র বিরোধীর সন্তান সকল শিক্ষা-দীক্ষার পরেও বাঙালিত্বের মূল ধারায় প্রবেশ করতে পারেনি বা করেনি। বিপরীতটাও ঠিক তেমনি—সকল নিপীড়নের পরেও বারবার দেখা গেছে, হঠাৎ রমনা বটমূল, রাজপথ বা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বর ভরে উঠেছে। তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়-
বাঁধন যতই শক্ত হবে, ততই বাঁধন টুটবে। অথবা—“এখনও দুধের দাঁত ওঠেনি, এর ভেতর আইয়ুব খানের দাঁত দেখাচ্ছো।”
সফট পাওয়ারের প্রয়োজনীয়তা
কিন্তু এই টু আইডিওলজি বাস্তবে সব দেশে যেমন সফট পাওয়ার থাকে তেমনি হতে হবে। হার্ড পাওয়ার দিয়ে—অর্থাৎ হত্যা, মৃত্যু, জেল, জুলুম দিয়ে তো আর আইডিওলজি স্থাপন করা যাবে না।
এই ধারা থেকে বের হয়ে ভদ্র ও উন্নত দেশের মানুষের মতো আইডিওলজিকে প্রকৃত সফট পাওয়ারে পরিণত করতে হবে। যাতে দেশ সবুজ, শ্যামল ও বিশাল আকাশের থাকে। সেটা বারবার রেড সি না হয়।
আর সেই রেড সি-তে যেন বারবার ওল্ড ম্যান বা ইয়াং ম্যান নামতে না পারে। কারণ সাধারণ সাগরের ওল্ড ম্যান, ইয়াং ম্যান জীবিকার জন্য মৎস্যশিকার করে। কিন্তু বিভক্তির সংঘাতে তৈরি রেড সি-তে ওল্ড ম্যান, ইয়াং ম্যান যা কিছু করে—সবই লোভ ও লালসা থেকে।
লেখক পরিচিতি
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.