নতুন ঋতু, নতুন যাত্রা
শরতের হিমেল সকালে বিমানের চাকা মাটিতে ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখিকার মনে জেগে উঠল এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া। যে দেশে একসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলেন, এখন সেই দেশেই নিজের ছেলেকে পড়াশোনার জন্য নিয়ে এসেছেন। সময় যেন এক অদ্ভুত চক্রে ঘুরে আবার শুরুতে ফিরে এসেছে—তবে এবার ভূমিকা বদলে গেছে।
অভিভাবক থেকে পথপ্রদর্শক
ত্রিশ বছর আগে যে পথ তিনি একা পাড়ি দিয়েছিলেন, আজ সেটি পাড়ি দিচ্ছেন তার সন্তান। শীতের কাপড়, ওষুধ আর ইনস্ট্যান্ট নুডলস ভরা ব্যাগ হাতে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তায় ভরা সেই পরিচিত অনুভূতিই আবার ফিরে এসেছে, তবে এবার নিজের জন্য নয়—ছেলের জন্য।
বিছানার চাদর, মুদি সামগ্রী, এমনকি কোন কম্বলটি কেনা হবে—এইসব ছোটখাটো প্রস্তুতির মধ্য দিয়েই কাটল তাদের প্রথম কয়েকটি দিন। তুচ্ছ মনে হলেও এগুলোই বিদেশে একা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অপরিহার্য প্রস্তুতি।
স্বাধীনতার প্রথম পাঠ
ছেলেকে দেখে লেখিকা বুঝলেন, সে এখন নিজের জীবনের প্রথম বড় ধাপে পা রাখছে। বাজেট তৈরি, নিজের পড়ার কোণ সাজানো, নতুন বন্ধু তৈরি—সবকিছুই তার স্বাধীনতার পথে সূচনা। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেও ছিল এক মৃদু বেদনা—সন্তান যখন নিজের পৃথিবীতে প্রবেশ করে, তখন পিতামাতা ধীরে ধীরে প্রেক্ষাপটের আড়ালে চলে যায়।

অতীতের স্মৃতিচারণা
ছেলেকে নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে দেখে লেখিকার নিজের ছাত্রজীবনের স্মৃতি ফিরে আসে—অচেনা রাস্তা, ফুলে ভরা পার্ক, হঠাৎ আসা একাকীত্ব। তখন হয়তো তিনি উপলব্ধি করেননি, তার বাবা-মাও ঠিক এমনই নীরবে উদ্বেগ ও ভালোবাসায় ভরা দিন কাটাতেন। এখন তিনি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই আবেগ অনুভব করছেন।
স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব শেখা
তিনি উপলব্ধি করলেন, স্বাধীনতা আসে না বড় কোনো সিদ্ধান্তে, বরং ছোট ছোট দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে—নিজে রান্না করা, সময়মতো বাস ধরা, টাকাপয়সা হিসাব রাখা, একা থেকেও একাকিত্ব না বোধ করা। এই অভিজ্ঞতাই তরুণদের গড়ে তোলে।
একাধিক প্রস্থান, একাধিক সূচনা
এই বছর লেখিকার পরিবারের জন্য একাধিক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে। এক সন্তান বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা রেখেছে, অন্যজন কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। দুই দিকেই চলছে স্বাবলম্বী হওয়ার পথচলা—একজন শিখছে অচেনা মানুষদের সঙ্গে থাকা, অন্যজন কাজের দুনিয়ায় দায়িত্ব ও প্রতিযোগিতা সামলানো।

পিতামাতার নীরব শিক্ষা
এই পরিবর্তনের সময়ে পিতামাতার শিক্ষাও নতুন রূপ নেয়। তারা শিখে যান—কীভাবে পেছনে দাঁড়িয়ে গর্বের সঙ্গে সন্তানদের বেড়ে ওঠা দেখা যায়, তাদের ভুল করার জায়গা দেওয়া যায়, এবং বিশ্বাস রাখা যায় যে একদিন তারাই নিজেদের শক্তিতে দাঁড়াবে।
বিদায়ের মুহূর্ত
বিদায়ের সময় কিছু অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল—তবে শুধু মায়ের চোখে। বৃষ্টির গন্ধ আর শরতের পাতাঝরার মাঝে তিনি বুঝলেন, এই বিদায় আসলে জীবনেরই এক অনিবার্য রূপান্তর। একসময় তিনি নিজেই ছিলেন সেই তরুণ শিক্ষার্থী, আর এখন তার সন্তান সেই স্বপ্নের পথে পা রাখছে।
ভালোবাসার দীর্ঘ বিশ্বাস
লেখিকা উপলব্ধি করেন—পিতৃত্ব-মাতৃত্ব এক দীর্ঘ বিশ্বাসের যাত্রা। আপনি ভালোবাসা বুনে দেন, জানেন না তা কখন বা কীভাবে ফুলে-ফলে ফলবে। সন্তানের জীবনে নিজের স্থান ছেড়ে দিতে পারা মানেই তাকে উড়তে দেখা—এটাই সবচেয়ে বড় গর্ব, সবচেয়ে গভীর আনন্দ।

জীবনের চক্র
টি. এস. এলিয়ট যেমন লিখেছিলেন, “আমাদের অনুসন্ধানের শেষ লক্ষ্য হলো ফিরে আসা সেই জায়গায়, যেখানে শুরু করেছিলাম—কিন্তু এবার তা নতুন করে জানা।”
এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবনের চক্রাকার সৌন্দর্য—যেখানে প্রতিটি প্রস্থান আসলে এক নতুন সূচনা।
#পিতামাতা #সন্তান #স্বাধীনতা #জীবনেরচক্র #বিদেশেপড়া #পারিবারিকসম্পর্ক #অনুভূতি #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















