০২:৩১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
পিরোজপুরে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে আগুন দিয়ে পুড়িয়েে দিয়েছে ঢাকায় কলেজ শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার বিশ্ব এগোচ্ছে, বাংলাদেশ ফিরছে পেছনে—সঙ্গীত শিক্ষায় এই ইউ-টার্নের কারণ কী? প্রকাশক ব্যারি কানিংহামের নতুন অধ্যায় ওয়ালমার্টের নতুন যুগ: এআই বিস্তারে নেতৃত্ব দেবেন জন ফার্নার যুক্তরাষ্ট্রে মাদকবিক্রেতাদের বিচার বর্হিভূত হত্যা সমর্থন করে মাত্র ২৯% আমেরিকান দুই বিচারকের পদত্যাগে পাকিস্তানে সাংবিধানিক সংকট তীব্রতর গভীর অতলে দেশের অর্থনীতি: ইনক্লুসিভ ইলেকশান ছাড়া বের হবার কোন পথ নেই বিশ্বজুড়ে স‍‍ংকট দেখা দিয়েছে রেয়ার আর্থের মূল ধাতু ইয়ট্রিয়ামের গাজীপুরে গৃহবধূর গলা-কাটা লাশ উদ্ধার; স্বামী আশঙ্কাজনক

গণভোট: প্রশ্নগুলো বুঝতে পারছেন না ভোটাররা

সংবিধান সংস্কার, জুলাই সনদ এসব প্রসঙ্গে গণভোট কীভাবে হবে তা নিয়ে অবশেষে একটা ধারণা পাওয়া গেছে ১৩ই নভেম্বর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মধ্য দিয়ে। ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তরে গণভোট নেওয়া হবে একটি প্রশ্নেই। তবে সেটি চারটি বিষয় ঘিরে হবে।

কিন্তু বিষয়গুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এখনো সেভাবে ওয়াকিবহাল না। তাছাড়া বুঝলেও এর মধ্যে কোনো বিষয়ে যদি ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিমত থাকে, তার সমাধান কীভাবে হবে সেটাও সেভাবে পরিষ্কার না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মতো সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

যেমন মমতা চৌধুরী, যিনি একজন গৃহিণী, তিনি গণভোটের বিষয়ে শুনলেও বিষয়গুলো সম্পর্কে সেভাবে এখনো অবগত নন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।

বিষয়গুলো পড়ে শোনানোর পর ‘সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি’ এই বিষয়টির ব্যাপারে তিনি আগ্রহী বলে জানান। অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি বিবিসিকে বলছেন, “উনারা যেভাবে বলতেসেন এগুলা কিছু তো বুঝি না। উনারা যে এত প্যাচায়-গুচায় কথা বলেন এগুলা বুঝি না”।

আবার গণভোটের প্রশ্নে যে বিষয়গুলো এসেছে সেগুলো ‘যৌক্তিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের শিক্ষার্থী মুশফিক।

“আমার কাছে অযৌক্তিক কোনো কিছু মনে হচ্ছে না যে চারটা বিষয় বলা হচ্ছে এখানে,” বলেন তিনি। এগুলোর মধ্য দিয়ে সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেকটা এগোনো যাবে বলে মনে করছেন তিনি।

মরিয়ম আক্তার নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলছেন “আমি যদি দুটি বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ মনে করি আর দুটি বিষয়ে ‘না’, তখন আমি কী করবো?”

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

মূলত যে চারটি বিষয় নিয়ে একবাক্যে হ্যাঁ বা না মতামত নেওয়া হবে সে বিষয়গুলো হচ্ছে-

১. নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।

২. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

৩. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকার-সহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।

৪. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের অন্যতম দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানায়।

প্রাথমিকভাবে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা “মূল দলিল থেকে বহু দূরে সরে গেছেন”। জুলাই সনদে বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রস্তাব যুক্ত করা হয়েছে এবং বাস্তবায়ন আদেশের গেজেটের সাথে সাক্ষরিত জুলাই সনদের তফাৎ থাকায় বিষয়গুলো ‘বিতর্কিত’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একটি প্রশ্নে চলে আসা একটা ‘জবরদস্তি’ এবং খোদ প্রধান উপদেষ্টা সাক্ষরিত জুলাই সনদের লঙ্ঘন করেছেন বলেও জানান মি. আহমদ।

দিনশেষে অবশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এবং গণভোট একই দিনে আয়োজনের ঘোষণা দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানায় বিএনপি।

অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দাবি করে আসছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

এর মাঝে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থি আটদলের তরফ থেকে অসন্তোষ ও নিন্দা প্রকাশ করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে কিছু ক্ষেত্রে সাধুবাদ জানান, আবার কিছু বিষয় নিয়ে সমালোচনার দিকও তুলে ধরেন।

যেমন সংস্কার কমিশনের এক সেট বা প্যাকেজে হ্যাঁ/না ভোট হওয়ার কথা থাকলেও সেটিকে চারটা ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, যেটা জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটাই জটিলতার ভেতরে ফেলে দেবে- বলছেন তিনি।

কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, দেশের মানুষের “এতগুলো পয়েন্টে বিশ্লেষণ করে তাদের মত স্থির করা কঠিন হবে এবং একটা জটিলতা তৈরি হবে”।

অনেক ক্ষেত্রেই বিএনপির দাবির প্রতিফলন দেখা যাওয়ার কথাও বলা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

বর্তমান সরকারের আচরণ থেকে “এ সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়…। নির্বাচন অবাধ হওয়ার ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট শঙ্কা এবং আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে” এমনটাও বলেন মি. তাহের।

এর আগে বৃহস্পতিবার জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের ঘোষণায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি।

“গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে আয়োজন করা গেলে জুলাই সনদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো। এছাড়া যেসব বিষয়ে ওপর গণভোটের প্রশ্ন নির্ধারণের কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন সেটাও বিশ্লেষণ করা জরুরি,” বলেছিলেন তিনি।

জুলাই আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও গণভোট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

দলটির কার্যালয়ে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, গণভোট ইস্যূকে কয়েকটি আলাদা প্রশ্নে ভাগ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সংস্কারের সব বিষয়কে একরকম গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিছু বিষয়কে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলের বিবেচনাধীন করে ফেলা হয়েছে।

জটিলতা কি বাড়লো?

গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হবে নাকি নির্বাচনের দিন হবে সেই জটিলতার সিদ্ধান্ত আসাকে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখলেও এই বিষয়গুলোকে ফলপ্রসূ করতে খুব দ্রুত সরকারকে গণভোটের পক্ষে প্রচারণা শুরু করতে হবে বলছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক।

“গণভোটের প্রশ্নটা তো বেশ জটিল। একটার মধ্যে চারটা প্রশ্ন, চারটার মধ্যেও সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত অনেকগুলো ব্যাপার আছে। এটা নিয়ে যদি সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা না হয় জনগণের বোঝার জন্য, তাহলে আমার আশঙ্কা ভোটের দিন সবাই সংসদ নির্বাচনের ব্যালটায় ভোট দেবে, আর গণভোটের ব্যালটটা হয়তো খালি থেকে যাবে,” বলছেন তিনি।

আবার চারটি প্রশ্নে আলাদাভাবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এর সুযোগ না দিয়ে একটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ রেখে মতামতের জায়গাকে সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে বলে মনে করছেন সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ।

জুলাই সনদের যেসব প্রসঙ্গে দ্বিমত বা নোট অফ ডিসেন্টের জায়গা ছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রে কী হবে, গণভোটে ‘হ্যাঁ’ হলেও দ্বিমত থাকা বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন সংসদের উপর বাধ্যতামূলক হবে কি না, আবার সই করা জুলাই সনদের পরবর্তীতে পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সরকারে যারা আসবে তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ গুরুত্ব দেবে কি না, সে বিষয়গুলোও পরিষ্কার হয়নি এবং এসব নিয়ে “মতবিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং নির্বাচনের পরেও গড়াবে” মনে করছেন মি. আহমদ।

আবার জুলাই সনদ ঘিরে যেসব বিষয় আসছে সেগুলোর অনেক কিছু বর্তমান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে বর্ণনা করছেন শাহদীন মালিক।

“এখনকার যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে- যদি এমন হয় যে বর্তমান সংবিধান থাকবে, তাহলে এগুলো এমনি এমনি বাদ পড়ে যাবে। আর এগুলো যদি সংবিধানে অফসিল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হয় তাহলে বিদ্যমান সংবিধানকে বাদ দিতে হবে,” বলছেন তিনি।

মি. মালিক বিদ্যমান এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের জায়গায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উদাহরণ দিয়ে বলছেন, “দুইটা পরস্পর এতটা বিরোধী যেটা এভাবে গোঁজামিল দিয়ে একই আইনের মধ্যে এক জায়গায় থাকবে এককক্ষবিশিষ্ট, আরেক জায়গায় থাকবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, এক জায়গায় থাকবে অ্যাডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ (সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার), অন্য জায়গায় থাকবে পিআর–– এগুলো তো দুটা একসাথে সম্ভব না”।

এমন সাংঘর্ষিক দিকগুলোর সমাধান কী হবে সে বিষয়গুলো পরিষ্কার না বলেই মনে করছেন তিনি।

তবে জাতীয় নির্বাচনের এক রকম রোডম্যাপ যেখানে চলে এসেছে, সেখানে গণভোট প্রসঙ্গে মানুষের মধ্যে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করার চ্যালেঞ্জের জায়গাও রয়েছে। আবার যদি গণভোটে কোনোভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘না’ হয়ে যায় তাহলে পুরো কর্মযজ্ঞই অনেকটা অকার্যকর হয়ে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী সরকার পরিচালনার জায়গা তৈরি হতে পারে।

এখন জটিলতার যেসব জায়গা রয়ে গেল, দ্বিমত থাকা বিষয়গুলোর কী হবে বা সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বিষয়গুলো কীভাবে পৌঁছানো হবে সে প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ–সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রীয়াজ আমেরিকায় অবস্থান করায় বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

অবশ্য এর আগে ১৩ই অক্টোবরে নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আলী রীয়াজ গণভোট প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেছিলেন “একটা রাজনৈতিক দলকে যখন মানুষ ভোট দেয় তখন তার প্রত্যেকটা নীতি, আদর্শ কি দেখেন আসলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে? কিন্তু তারা মোটাদাগে বুঝতে পারেন যে এই রাজনৈতিক দলকে যদি আমি ক্ষমতায় দেই তাহলে তারা এই এই কাজ করবে। সব কাজ কিন্তু তাদের আবার পছন্দও হয় না। তারপরও সে একটা দলকে ভোট দেয়। কাজেই সিদ্ধান্ত জনগণ নেয়, নিতে পারে”।

BBC News বাংলা

জনপ্রিয় সংবাদ

পিরোজপুরে জুলাই স্মৃতিস্তম্ভে আগুন দিয়ে পুড়িয়েে দিয়েছে

গণভোট: প্রশ্নগুলো বুঝতে পারছেন না ভোটাররা

১১:১১:৫৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

সংবিধান সংস্কার, জুলাই সনদ এসব প্রসঙ্গে গণভোট কীভাবে হবে তা নিয়ে অবশেষে একটা ধারণা পাওয়া গেছে ১৩ই নভেম্বর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের মধ্য দিয়ে। ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উত্তরে গণভোট নেওয়া হবে একটি প্রশ্নেই। তবে সেটি চারটি বিষয় ঘিরে হবে।

কিন্তু বিষয়গুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এখনো সেভাবে ওয়াকিবহাল না। তাছাড়া বুঝলেও এর মধ্যে কোনো বিষয়ে যদি ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিমত থাকে, তার সমাধান কীভাবে হবে সেটাও সেভাবে পরিষ্কার না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মতো সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

যেমন মমতা চৌধুরী, যিনি একজন গৃহিণী, তিনি গণভোটের বিষয়ে শুনলেও বিষয়গুলো সম্পর্কে সেভাবে এখনো অবগত নন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।

বিষয়গুলো পড়ে শোনানোর পর ‘সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি’ এই বিষয়টির ব্যাপারে তিনি আগ্রহী বলে জানান। অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে তিনি বিবিসিকে বলছেন, “উনারা যেভাবে বলতেসেন এগুলা কিছু তো বুঝি না। উনারা যে এত প্যাচায়-গুচায় কথা বলেন এগুলা বুঝি না”।

আবার গণভোটের প্রশ্নে যে বিষয়গুলো এসেছে সেগুলো ‘যৌক্তিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের শিক্ষার্থী মুশফিক।

“আমার কাছে অযৌক্তিক কোনো কিছু মনে হচ্ছে না যে চারটা বিষয় বলা হচ্ছে এখানে,” বলেন তিনি। এগুলোর মধ্য দিয়ে সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেকটা এগোনো যাবে বলে মনে করছেন তিনি।

মরিয়ম আক্তার নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী বলছেন “আমি যদি দুটি বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ মনে করি আর দুটি বিষয়ে ‘না’, তখন আমি কী করবো?”

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

মূলত যে চারটি বিষয় নিয়ে একবাক্যে হ্যাঁ বা না মতামত নেওয়া হবে সে বিষয়গুলো হচ্ছে-

১. নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।

২. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

৩. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকার-সহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।

৪. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।

প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের অন্যতম দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অসন্তোষ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানায়।

প্রাথমিকভাবে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা “মূল দলিল থেকে বহু দূরে সরে গেছেন”। জুলাই সনদে বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রস্তাব যুক্ত করা হয়েছে এবং বাস্তবায়ন আদেশের গেজেটের সাথে সাক্ষরিত জুলাই সনদের তফাৎ থাকায় বিষয়গুলো ‘বিতর্কিত’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একটি প্রশ্নে চলে আসা একটা ‘জবরদস্তি’ এবং খোদ প্রধান উপদেষ্টা সাক্ষরিত জুলাই সনদের লঙ্ঘন করেছেন বলেও জানান মি. আহমদ।

দিনশেষে অবশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এবং গণভোট একই দিনে আয়োজনের ঘোষণা দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে ধন্যবাদ জানায় বিএনপি।

অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দাবি করে আসছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

এর মাঝে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থি আটদলের তরফ থেকে অসন্তোষ ও নিন্দা প্রকাশ করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।

শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে কিছু ক্ষেত্রে সাধুবাদ জানান, আবার কিছু বিষয় নিয়ে সমালোচনার দিকও তুলে ধরেন।

যেমন সংস্কার কমিশনের এক সেট বা প্যাকেজে হ্যাঁ/না ভোট হওয়ার কথা থাকলেও সেটিকে চারটা ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, যেটা জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটাই জটিলতার ভেতরে ফেলে দেবে- বলছেন তিনি।

কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, দেশের মানুষের “এতগুলো পয়েন্টে বিশ্লেষণ করে তাদের মত স্থির করা কঠিন হবে এবং একটা জটিলতা তৈরি হবে”।

অনেক ক্ষেত্রেই বিএনপির দাবির প্রতিফলন দেখা যাওয়ার কথাও বলা হয় সংবাদ সম্মেলনে।

বর্তমান সরকারের আচরণ থেকে “এ সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়…। নির্বাচন অবাধ হওয়ার ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট শঙ্কা এবং আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে” এমনটাও বলেন মি. তাহের।

এর আগে বৃহস্পতিবার জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোটের ঘোষণায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি।

“গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে আয়োজন করা গেলে জুলাই সনদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো। এছাড়া যেসব বিষয়ে ওপর গণভোটের প্রশ্ন নির্ধারণের কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন সেটাও বিশ্লেষণ করা জরুরি,” বলেছিলেন তিনি।

জুলাই আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকা ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও গণভোট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

দলটির কার্যালয়ে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, গণভোট ইস্যূকে কয়েকটি আলাদা প্রশ্নে ভাগ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সংস্কারের সব বিষয়কে একরকম গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিছু বিষয়কে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলের বিবেচনাধীন করে ফেলা হয়েছে।

জটিলতা কি বাড়লো?

গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হবে নাকি নির্বাচনের দিন হবে সেই জটিলতার সিদ্ধান্ত আসাকে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখলেও এই বিষয়গুলোকে ফলপ্রসূ করতে খুব দ্রুত সরকারকে গণভোটের পক্ষে প্রচারণা শুরু করতে হবে বলছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক।

“গণভোটের প্রশ্নটা তো বেশ জটিল। একটার মধ্যে চারটা প্রশ্ন, চারটার মধ্যেও সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত অনেকগুলো ব্যাপার আছে। এটা নিয়ে যদি সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচারণা না হয় জনগণের বোঝার জন্য, তাহলে আমার আশঙ্কা ভোটের দিন সবাই সংসদ নির্বাচনের ব্যালটায় ভোট দেবে, আর গণভোটের ব্যালটটা হয়তো খালি থেকে যাবে,” বলছেন তিনি।

আবার চারটি প্রশ্নে আলাদাভাবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এর সুযোগ না দিয়ে একটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ রেখে মতামতের জায়গাকে সংকীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে বলে মনে করছেন সংসদ বিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদ।

জুলাই সনদের যেসব প্রসঙ্গে দ্বিমত বা নোট অফ ডিসেন্টের জায়গা ছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রে কী হবে, গণভোটে ‘হ্যাঁ’ হলেও দ্বিমত থাকা বিষয়গুলোর বাস্তবায়ন সংসদের উপর বাধ্যতামূলক হবে কি না, আবার সই করা জুলাই সনদের পরবর্তীতে পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সরকারে যারা আসবে তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ গুরুত্ব দেবে কি না, সে বিষয়গুলোও পরিষ্কার হয়নি এবং এসব নিয়ে “মতবিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং নির্বাচনের পরেও গড়াবে” মনে করছেন মি. আহমদ।

আবার জুলাই সনদ ঘিরে যেসব বিষয় আসছে সেগুলোর অনেক কিছু বর্তমান সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে বর্ণনা করছেন শাহদীন মালিক।

“এখনকার যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে- যদি এমন হয় যে বর্তমান সংবিধান থাকবে, তাহলে এগুলো এমনি এমনি বাদ পড়ে যাবে। আর এগুলো যদি সংবিধানে অফসিল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হয় তাহলে বিদ্যমান সংবিধানকে বাদ দিতে হবে,” বলছেন তিনি।

মি. মালিক বিদ্যমান এককক্ষবিশিষ্ট সংসদের জায়গায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের উদাহরণ দিয়ে বলছেন, “দুইটা পরস্পর এতটা বিরোধী যেটা এভাবে গোঁজামিল দিয়ে একই আইনের মধ্যে এক জায়গায় থাকবে এককক্ষবিশিষ্ট, আরেক জায়গায় থাকবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট, এক জায়গায় থাকবে অ্যাডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ (সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার), অন্য জায়গায় থাকবে পিআর–– এগুলো তো দুটা একসাথে সম্ভব না”।

এমন সাংঘর্ষিক দিকগুলোর সমাধান কী হবে সে বিষয়গুলো পরিষ্কার না বলেই মনে করছেন তিনি।

তবে জাতীয় নির্বাচনের এক রকম রোডম্যাপ যেখানে চলে এসেছে, সেখানে গণভোট প্রসঙ্গে মানুষের মধ্যে পরিষ্কার ধারণা তৈরি করার চ্যালেঞ্জের জায়গাও রয়েছে। আবার যদি গণভোটে কোনোভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘না’ হয়ে যায় তাহলে পুরো কর্মযজ্ঞই অনেকটা অকার্যকর হয়ে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী সরকার পরিচালনার জায়গা তৈরি হতে পারে।

এখন জটিলতার যেসব জায়গা রয়ে গেল, দ্বিমত থাকা বিষয়গুলোর কী হবে বা সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বিষয়গুলো কীভাবে পৌঁছানো হবে সে প্রসঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ–সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আলী রীয়াজ আমেরিকায় অবস্থান করায় বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

অবশ্য এর আগে ১৩ই অক্টোবরে নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক আলী রীয়াজ গণভোট প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলেছিলেন “একটা রাজনৈতিক দলকে যখন মানুষ ভোট দেয় তখন তার প্রত্যেকটা নীতি, আদর্শ কি দেখেন আসলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে? কিন্তু তারা মোটাদাগে বুঝতে পারেন যে এই রাজনৈতিক দলকে যদি আমি ক্ষমতায় দেই তাহলে তারা এই এই কাজ করবে। সব কাজ কিন্তু তাদের আবার পছন্দও হয় না। তারপরও সে একটা দলকে ভোট দেয়। কাজেই সিদ্ধান্ত জনগণ নেয়, নিতে পারে”।

BBC News বাংলা