১০:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
এশিয়ার কনটেন্ট হাব হতে ১৫৪ মিলিয়ন ডলারের নতুন ফিল্ম–টিভি তহবিল ঘোষণা সিঙ্গাপুরের ১০ জানুয়ারি থেকে কঠোর আন্দোলনের হুমকি সচিবালয় কর্মচারীদের জেডআই খান পান্নার নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেড়ে ৩৯১ জামায়াতের জন্য উপযুক্ত দল ছিল আওয়ামী লীগ: মির্জা আব্বাস বিদ্যুৎ লাইনে কাপড় পড়ে ১৫ মিনিট বন্ধ থাকে ঢাকার মেট্রোরেল খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় সহায়তা করতে ঢাকায় যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞ খালেদা জিয়া প্রাসাদে নয়, রাজপথে রাজনীতি করেছেন: মঈন খান প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সক্ষমতা বিকাশে সকলের যৌথ দায়িত্ব ঘূর্ণিঝড় দিতওয়া ও ভারত–শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক: পারস্পরিক কূটনীতির নতুন পাঠ

প্রতিশ্রুত ভূমির খোঁজে: ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির শেষ না হওয়া নির্বাসন

ডোরে লেকের ধারে পাতলা এক বনভূমি। জলের ভেতরে কুকুরের জিভের মতো বাঁক নিয়ে ঢুকে গেছে ছোট্ট উপদ্বীপটি। এখানেই একসময় ছিল আ্যাবেল বসামের শৈশবের বাড়ি। এখন তিনি গ্র্যান্ড কাউন্সিল অব দ্য ক্রিস–এর গ্র্যান্ড চিফ। চকচকে ড্রেস শু রেখে দাঁড়িয়ে আছেন সেই পুরোনো মাটিতে, যেখানে এক সময় ছিল তাঁর বাবা–মায়ের কাঠের ঘর। চারদিকে হাওয়ায় কাঁপছে বার্চ গাছের পাতারা, আর তাঁর মনে ফিরে আসছে বারবার উচ্ছেদের স্মৃতি।

এই ছিল ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির শেষ গ্রাম, যেখান থেকে সোনার খনি কোম্পানি ক্যাম্পবেল তাদের তুলে দেয়। কানাডার শিল্ডে মুনাফাযোগ্য খনিজের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে বারবার ভেঙে দেওয়া হয় তাদের গৃহ, তাদের নদী–হ্রদের পাশে বানানো ছোট ছোট বসতি। বাইবেলে ইসরায়েলিদের ৪০ বছরের বনবাসের কথা আছে; ওজে-বুগুমু ক্রি জাতি পাড়ি দিয়েছে boreal বনভূমির ভেতর প্রায় ৭০ বছরের পথ, চিবুগামো এলাকার কাছে ঝুপড়ি–বসতি, খনি–টেন্ট আর ট্র্যাপলাইন কেবিনে আশ্রয় নিয়ে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালে লেক ওপেমিস্কার তীরে তারা পায় নিজেদের স্থায়ী রিজার্ভ; কিন্তু সবার জন্য সেই নির্বাসন এখনও শেষ হয়নি।

বারবার উচ্ছেদ, বন-নদী জুড়ে এক দীর্ঘ নির্বাসন

১৯৫৫ সালে জন্ম আ্যাবেল বসামের, কাছের চিবুগামো লেকের ধারে। ডোরে লেক আর চিবুগামো লেকের মাঝের সরু ভূমিখণ্ড কাঁধে নৌকা তুলে হেঁটে যাওয়ার মতোই সঙ্কীর্ণ। মা লুসির ১১ সন্তানের বড় তিনি। লুসির বাবা–মা মেনে নেননি তাঁর জৈবিক বাবাকে, এক ফরাসি-কানাডিয়ান সিপিয়েন ক্যরঁ–কে। পরে লুসি বিয়ে করেন স্যাম নিপুশকে, যিনি আ্যাবেলের জীবনে প্রকৃত বাবার জায়গা নেন।

এই উপদ্বীপে এক সময় প্রায় ডজনখানেক লগ–ঘর ছিল, বৃত্তাকারে, সব দরজা খোলা ভেতরের দিকে। প্রথমে বানানো হতো ছোট্ট টিন–তাঁবুর মতো ঝুপড়ি, সঙ্গে ত্রিপল ঢাকা ছাদ। পাশের ডাম্প থেকে যা পাওয়া যায়, ধীরে ধীরে তাতে গেঁথে উঠত দেয়াল, ছাদ, জানালার কাচ; দুই–তিন বছরে তবেই বাড়ি সম্পূর্ণ হতো। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না, কিন্তু ওজে-বুগুমু ক্রি জাতি বিশ্বাস করত—সম্মানজনক, পরিপাটি একটা গ্রাম বানাতে পারলে সরকার তাদের থাকতে দেবে।

গ্রামের মাঝখানে ছিল ছোট্ট বল মাঠ, এখন সেখানেই বসে কারও ফায়ারপিট। এক বেকার নিয়মিত ভ্যানভর্তি রুটি আর ভাঁশোঁ কেক নিয়ে আসত; শিশুরা টাকা জমিয়ে কিনত ওই সামান্য বিলাসিতা। একদিন আ্যাবেল আর তার বন্ধুরা ঠিক করল কেক–ডাকাতি করবে। সবচেয়ে দ্রুত দৌড়োয় যে, এডি, সে হাতে একটা কেক নিয়ে দৌড় দেবে; বেকার তাকে তাড়া করবে; আর ওই সময় অন্যরা ভ্যান থেকে যত পারে তুলে নেবে। পরিকল্পনা সফল হয়, আর বেকার প্রচণ্ড রেগে যায়। এরপর থেকে সে আর বাচ্চাদের ভ্যানের কাছে ঘেঁষতে দিত না।

কয়েক মাস পরে একদিন আ্যাবেল দেখে, সেই বেকার ডাম্পে ফেলে দিচ্ছে ম মেয়াদপূর্তির মুখে দাঁড়ানো কেক। তখনই সে বুঝতে পারে—যে খাবারগুলো তারা সযত্নে টাকা জমিয়ে কিনত, সেগুলো আসলে শেষের নষ্ট হতে থাকা মাল। “ওটা কোনো উপকার ছিল না,” শান্ত গলায় বলেন আ্যাবেল।

ডোরে লেকের পেছনের ঢালে জন্মায় ব্লুবেরি আর রাস্পবেরি। হ্রদের নামই এসেছে ডোরে (ওয়াল–আই) মাছ থেকে। এই সবুজ–নীল জঙ্গল–হ্রদের মধ্যে একসময় সরকারি কর্মকর্তা এসে বলেছিলেন—এখানে তারা অনির্দিষ্টকাল থাকতে পারবে। ১৯৬৬ সালে কানাডিয়ান সেন্টেনিয়াল কমিশন ১,৭০০ ডলার অনুদান দেয়, যাতে টরন্টোর মতো দূর শহর থেকে আসা অ্যাঙ্গলিকান স্বেচ্ছাসেবীরা কাছের ক্যাশ বে–তে ১৫ মিটার লম্বা হল বানায়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর সভার জন্য। একই সঙ্গে ওটাই ছিল প্রধানের বাড়ি। নাম দেওয়া হয় “বিভার হাউজ।”

কিন্তু রাতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে হঠাৎ চারজন পুলিশ এসে অতিথিদের টেনে তুলতে থাকে গাড়িতে। কেউ জানত না অপরাধ কী। আ্যাবেল এখনো মনে করেন—কীভাবে খনি–শহরের ফরাসি শ্রমিক আর পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ চেপে বসেছিল ক্রি মানুষের জীবনে।

পুরো বিংশ শতাব্দী জুড়ে ক্রি জীবন ছিল এক অদ্ভুত দ্বৈত অর্থনীতির মাঝে—একদিকে ফরাসি ও ইংরেজ উপনিবেশকারীদের জন্য পশম, কাঠ আর খনিজ; অন্যদিকে প্রাচীন শিকার–জীবন। ১৯০৩ সালে প্রথম স্বর্ণের খোঁজ লাগে, তারপর একের পর এক বুম আর মন্দা, বিশ্ব অর্থনীতির ওঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ১৯৫০-এর দশকে সড়ক, স মিল আর কোম্পানি টাউন উঠে আসে চিবুগামো অঞ্চলে; গাছে ভরা স্প্রুস বন কাটতে নেমে পড়ে লগাররা।

কিন্তু এই উন্নয়ন মানে ছিল ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির জন্য একটার পর একটা উচ্ছেদ। হ্যামেল আইল্যান্ড, সোয়াম্পি পয়েন্ট, ক্যাম্পবেল পয়েন্ট, সিডার বে—প্রতিটি জায়গায় কোনো না কোনো অজুহাতে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। কোথাও বলা হয়, হাইওয়ে বানাতে বালু লাগবে; কোথাও খনি–বিস্ফোরকের কাছে মানুষ থাকতে পারে না; কোথাও আবার স্যানিটেশন দেখিয়ে পাদ্রিরা তাড়িয়ে দেয়।

প্রতিবার যেতে হয়েছে নতুন জায়গায়, আবার গাছ কেটে জমি পরিষ্কার করে ঘর তুলতে হয়েছে। ক্যাম্পবেল পয়েন্ট ছাড়ার সময় পূর্বপুরুষদের কবরও তুলে নিতে হয়। অনেকেই দুঃখ ভোলার জন্য আশ্রয় নিয়েছেন মদের মধ্যে।

উন্নয়ন নাকি ধ্বংস: ব্ল্যাকরক খনি ও ভবিষ্যতের দ্বন্দ্ব

ডোরে লেক থেকে উচ্ছেদের পর যে পরিবারগুলোর গল্প আলাদা করে চোখে পড়ে, তার একটি ওয়াপাচি পরিবার। ম্যাগি ওয়াপাচি, এখন ৮৮, নিজের রান্নাঘরের টেবিলে উপুড় কাটা এক বিভার ছাড়াচ্ছেন—এ যেন কয়েক প্রজন্মের দক্ষতার সরাসরি সাক্ষী। স্বামী ম্যাথিউ বিভার ধরেছেন; ছেলে নরম্যান অনুবাদ করছেন, কারণ ম্যাগি কেবল ক্রি ভাষাতেই কথা বলেন।

ওদের বাড়ি চিবুগামো নদীর তীরে, চিবুচিবি এলাকায়। এখানেই সন্তানদের “ওয়াকিং–আউট সেরিমনি”—শিশুর প্রথম পদক্ষেপের আচার—হয়েছিল। মা–নানি ছোট মেয়েদের, বাবা–দাদা ছেলেদের নিয়ে হাঁটেন নদীর জলে, প্রতিশ্রুতি দেন—বাচ্চাদের ক্রি জীবনের পথ ধরে বড় করবেন।

ওয়াপাচি পরিবার এখন প্রায় ১৪০ জনের বিস্তৃত কুল–পরিবার। তাদের ট্র্যাপলাইন চলে গিয়েছে বহু ভেতরের বনে, লগিং রোড ২১০ ধরে সেই পাহাড় পর্যন্ত, যাকে তারা ক্রি ভাষায় বলে গাওয়াশেবুগিডনাজ—“স্বর্ণ” বা “উজ্জ্বল পাহাড়”—বার্চ গাছের সোনালি ঝকঝকে পাতার জন্য। এখানেই তারা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্যভাবে পায় মুজ।

এই জায়গাটাই এখন ব্ল্যাকরক মেটালস ইনক.–এর নজরে। কোম্পানি চায় পাহাড় চেঁছে খুলে ফেলা হাই–পিওরিটি আয়রন, টাইটানিয়াম আর ভ্যানাডিয়ামের বিশাল ওপেন পিট মাইন। ২০১৩ সালে গ্র্যান্ড কাউন্সিল আর ওজে-বুগুমু ক্রি জাতি ব্ল্যাকরকের সঙ্গে একটি ইমপ্যাক্ট বেনিফিটস এগ্রিমেন্ট সই করে—ব্যালি হাস্কি নামে এক পূর্বপুরুষের নামাঙ্কিত চুক্তি। এতে প্রতিশ্রুতি ছিল অর্থ, চাকরি, প্রশিক্ষণ, ব্যবসা আর পরিবেশ–মনিটরিংয়ের সুযোগের।

নরম্যান নিজেও কাজ করেছেন কোম্পানির কমিউনিটি রিলেশন সমন্বয়কারী হিসেবে। কিন্তু বছর গড়াতে গড়াতে খনিজের দামের অস্থিরতায় প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে, আর সেই সাথে প্রতিশ্রুতিগুলিও যেন ছোট হয়ে এসেছে। ওয়াপাচি পরিবারে অনেকে বলছেন—যে সংখ্যক চাকরি আর চুক্তি প্রথমে বলা হয়েছিল, বাস্তবে তার অনেক কমই মিলবে।

ম Mining–ক্যাম্পের পাশের “র্যাবিট ক্যাম্পে” আমরা যখন বসে আগুনে মুজের মাংস সেঁকছি, নরম্যান কাঁধ ঝুলিয়ে বলেন—“উচ্ছেদ এখনো থামেনি। আমাদের মৌসুমি ক্যাম্পও সরাতে বলা হচ্ছে। বারবারই সরকার নতুন উন্নয়নের জন্য দরজা খুলে দেয়—আর আমাদের ট্র্যাপলাইন ছোট হতে থাকে।”

বৃদ্ধ ম্যাথিউ, প্রাক্তন ট্যালিম্যান, খনির বিরুদ্ধে; কিন্তু তাঁর সন্তানদের অনেকে হাল ছেড়েছেন—উন্নয়ন থামানো যাবে না, তাই যতটা পারা যায়, সুবিধা কুড়িয়ে নিতে হবে। নরম্যানের মতো কেউ কেউ কোম্পানিতে চাকরিও নিয়েছেন। এতে বাবার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে; কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই জানেন—পাহাড় ভেঙে গেলে, তাদের ইতিহাসের বড় অংশও উধাও হয়ে যাবে।

এই টানাপোড়েন কেবল ওয়াপাচি পরিবারের ভেতরেই নয়; পুরো ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে মানুষ। কেউ দেখছেন খনি মানে চাকরি আর ব্যবসা; কেউ দেখছেন, আরেক দফা নির্বাসন।

অন্যদিকে, অভিজ্ঞতা আর অবিচলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আ্যাবেল বসাম, সেই নেতা যিনি ওজে-বুগুমু ক্রি জাতিকে ১৯৮০–৯০-এর দশকে বারবার দরজা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তর্ক, গবেষণা, আন্দোলন আর ব্লকেডের মাধ্যমে এনে দাঁড় করালেন লেক ওপেমিস্কার তীরে নতুন গ্রামে—ওজে-বুগুমু, অর্থাৎ “যেখানে মানুষ জড়ো হয়।”

স্থপতি ডাগলাস কার্ডিনালের নকশায় শাপতাঁ-ঘরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই গ্রাম আজ স্বীকৃত—একটি আধুনিক, টেকসই, কিন্তু ক্রি ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে। কেন্দ্রীভূত হিটিং সিস্টেমে স্থানীয় স’মিলের কাঠের গুঁড়া জ্বলে গরম পানি সরবরাহ করে; ট্র্যাপলাইনের নামে নাম পায় রাস্তা—মুস্কুচি মেস্কিনো, গিনশওয়াগুমশি মেস্কিনো, ওউকাউ সাখেগুন।

আজ আ্যাবেলের ছেলে কার্টিস বসাম ওজে-বুগুমুর প্রধান। নিজের অফিসের জানালায় দাঁড়িয়ে তিনি এক নজরে দেখতে পান চার্চ, স্কুল, যুবকেন্দ্র, সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, লজ, শাপতাঁ আর তারও পরে হ্রদ–বন–পাহাড়। প্রতিটি সকালেই এই দৃশ্য তাঁকে মনে করিয়ে দেয়—ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির সামনে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সত্য: ভবিষ্যতের চাকরি আর ব্যবসার প্রয়োজন, আর সেই ভবিষ্যতের জন্যই বেঁচে থাকা বন–নদী–পাহাড়ের প্রয়োজন।

গাওয়াশেবুগিডনাজ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সিনথিয়া ওয়াপাচি দূরে তাকিয়ে থাকেন—চিবুগামো লেক, তারও পর ডোরে লেকের চিকন ঝিলিক। তাঁর পায়ের তলায় সেই পাহাড়ি পাথর, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুজের পদচিহ্নের পিছু নিয়েছে তাদের পরিবার। তিনি জানেন, বিনিয়োগকারীরা যদি জিতে যায়, তবে এই পাহাড় একসময় মিলিয়ে যাবে কিলোমিটার–লম্বা এক গর্তে, যার ভেতর থেকে তুলে নেওয়া খনিজ যাবে দূরের কারখানায়, অচেনা দেশে।

চোখের কোণে জল এসে জমে। তিনি চশমা খুলে মুছে বলেন—“এখানে অনেক ইতিহাস আছে। ভেবে দেখতে গেলে, এটাও হয়তো আরেকটা শুরুই হবে—আরেকটা সরে যাওয়ার শুরু।”

 

জনপ্রিয় সংবাদ

এশিয়ার কনটেন্ট হাব হতে ১৫৪ মিলিয়ন ডলারের নতুন ফিল্ম–টিভি তহবিল ঘোষণা সিঙ্গাপুরের

প্রতিশ্রুত ভূমির খোঁজে: ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির শেষ না হওয়া নির্বাসন

০৪:৩৫:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫

ডোরে লেকের ধারে পাতলা এক বনভূমি। জলের ভেতরে কুকুরের জিভের মতো বাঁক নিয়ে ঢুকে গেছে ছোট্ট উপদ্বীপটি। এখানেই একসময় ছিল আ্যাবেল বসামের শৈশবের বাড়ি। এখন তিনি গ্র্যান্ড কাউন্সিল অব দ্য ক্রিস–এর গ্র্যান্ড চিফ। চকচকে ড্রেস শু রেখে দাঁড়িয়ে আছেন সেই পুরোনো মাটিতে, যেখানে এক সময় ছিল তাঁর বাবা–মায়ের কাঠের ঘর। চারদিকে হাওয়ায় কাঁপছে বার্চ গাছের পাতারা, আর তাঁর মনে ফিরে আসছে বারবার উচ্ছেদের স্মৃতি।

এই ছিল ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির শেষ গ্রাম, যেখান থেকে সোনার খনি কোম্পানি ক্যাম্পবেল তাদের তুলে দেয়। কানাডার শিল্ডে মুনাফাযোগ্য খনিজের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে বারবার ভেঙে দেওয়া হয় তাদের গৃহ, তাদের নদী–হ্রদের পাশে বানানো ছোট ছোট বসতি। বাইবেলে ইসরায়েলিদের ৪০ বছরের বনবাসের কথা আছে; ওজে-বুগুমু ক্রি জাতি পাড়ি দিয়েছে boreal বনভূমির ভেতর প্রায় ৭০ বছরের পথ, চিবুগামো এলাকার কাছে ঝুপড়ি–বসতি, খনি–টেন্ট আর ট্র্যাপলাইন কেবিনে আশ্রয় নিয়ে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালে লেক ওপেমিস্কার তীরে তারা পায় নিজেদের স্থায়ী রিজার্ভ; কিন্তু সবার জন্য সেই নির্বাসন এখনও শেষ হয়নি।

বারবার উচ্ছেদ, বন-নদী জুড়ে এক দীর্ঘ নির্বাসন

১৯৫৫ সালে জন্ম আ্যাবেল বসামের, কাছের চিবুগামো লেকের ধারে। ডোরে লেক আর চিবুগামো লেকের মাঝের সরু ভূমিখণ্ড কাঁধে নৌকা তুলে হেঁটে যাওয়ার মতোই সঙ্কীর্ণ। মা লুসির ১১ সন্তানের বড় তিনি। লুসির বাবা–মা মেনে নেননি তাঁর জৈবিক বাবাকে, এক ফরাসি-কানাডিয়ান সিপিয়েন ক্যরঁ–কে। পরে লুসি বিয়ে করেন স্যাম নিপুশকে, যিনি আ্যাবেলের জীবনে প্রকৃত বাবার জায়গা নেন।

এই উপদ্বীপে এক সময় প্রায় ডজনখানেক লগ–ঘর ছিল, বৃত্তাকারে, সব দরজা খোলা ভেতরের দিকে। প্রথমে বানানো হতো ছোট্ট টিন–তাঁবুর মতো ঝুপড়ি, সঙ্গে ত্রিপল ঢাকা ছাদ। পাশের ডাম্প থেকে যা পাওয়া যায়, ধীরে ধীরে তাতে গেঁথে উঠত দেয়াল, ছাদ, জানালার কাচ; দুই–তিন বছরে তবেই বাড়ি সম্পূর্ণ হতো। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না, কিন্তু ওজে-বুগুমু ক্রি জাতি বিশ্বাস করত—সম্মানজনক, পরিপাটি একটা গ্রাম বানাতে পারলে সরকার তাদের থাকতে দেবে।

গ্রামের মাঝখানে ছিল ছোট্ট বল মাঠ, এখন সেখানেই বসে কারও ফায়ারপিট। এক বেকার নিয়মিত ভ্যানভর্তি রুটি আর ভাঁশোঁ কেক নিয়ে আসত; শিশুরা টাকা জমিয়ে কিনত ওই সামান্য বিলাসিতা। একদিন আ্যাবেল আর তার বন্ধুরা ঠিক করল কেক–ডাকাতি করবে। সবচেয়ে দ্রুত দৌড়োয় যে, এডি, সে হাতে একটা কেক নিয়ে দৌড় দেবে; বেকার তাকে তাড়া করবে; আর ওই সময় অন্যরা ভ্যান থেকে যত পারে তুলে নেবে। পরিকল্পনা সফল হয়, আর বেকার প্রচণ্ড রেগে যায়। এরপর থেকে সে আর বাচ্চাদের ভ্যানের কাছে ঘেঁষতে দিত না।

কয়েক মাস পরে একদিন আ্যাবেল দেখে, সেই বেকার ডাম্পে ফেলে দিচ্ছে ম মেয়াদপূর্তির মুখে দাঁড়ানো কেক। তখনই সে বুঝতে পারে—যে খাবারগুলো তারা সযত্নে টাকা জমিয়ে কিনত, সেগুলো আসলে শেষের নষ্ট হতে থাকা মাল। “ওটা কোনো উপকার ছিল না,” শান্ত গলায় বলেন আ্যাবেল।

ডোরে লেকের পেছনের ঢালে জন্মায় ব্লুবেরি আর রাস্পবেরি। হ্রদের নামই এসেছে ডোরে (ওয়াল–আই) মাছ থেকে। এই সবুজ–নীল জঙ্গল–হ্রদের মধ্যে একসময় সরকারি কর্মকর্তা এসে বলেছিলেন—এখানে তারা অনির্দিষ্টকাল থাকতে পারবে। ১৯৬৬ সালে কানাডিয়ান সেন্টেনিয়াল কমিশন ১,৭০০ ডলার অনুদান দেয়, যাতে টরন্টোর মতো দূর শহর থেকে আসা অ্যাঙ্গলিকান স্বেচ্ছাসেবীরা কাছের ক্যাশ বে–তে ১৫ মিটার লম্বা হল বানায়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান আর সভার জন্য। একই সঙ্গে ওটাই ছিল প্রধানের বাড়ি। নাম দেওয়া হয় “বিভার হাউজ।”

কিন্তু রাতে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে হঠাৎ চারজন পুলিশ এসে অতিথিদের টেনে তুলতে থাকে গাড়িতে। কেউ জানত না অপরাধ কী। আ্যাবেল এখনো মনে করেন—কীভাবে খনি–শহরের ফরাসি শ্রমিক আর পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ চেপে বসেছিল ক্রি মানুষের জীবনে।

পুরো বিংশ শতাব্দী জুড়ে ক্রি জীবন ছিল এক অদ্ভুত দ্বৈত অর্থনীতির মাঝে—একদিকে ফরাসি ও ইংরেজ উপনিবেশকারীদের জন্য পশম, কাঠ আর খনিজ; অন্যদিকে প্রাচীন শিকার–জীবন। ১৯০৩ সালে প্রথম স্বর্ণের খোঁজ লাগে, তারপর একের পর এক বুম আর মন্দা, বিশ্ব অর্থনীতির ওঠানামার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ১৯৫০-এর দশকে সড়ক, স মিল আর কোম্পানি টাউন উঠে আসে চিবুগামো অঞ্চলে; গাছে ভরা স্প্রুস বন কাটতে নেমে পড়ে লগাররা।

কিন্তু এই উন্নয়ন মানে ছিল ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির জন্য একটার পর একটা উচ্ছেদ। হ্যামেল আইল্যান্ড, সোয়াম্পি পয়েন্ট, ক্যাম্পবেল পয়েন্ট, সিডার বে—প্রতিটি জায়গায় কোনো না কোনো অজুহাতে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। কোথাও বলা হয়, হাইওয়ে বানাতে বালু লাগবে; কোথাও খনি–বিস্ফোরকের কাছে মানুষ থাকতে পারে না; কোথাও আবার স্যানিটেশন দেখিয়ে পাদ্রিরা তাড়িয়ে দেয়।

প্রতিবার যেতে হয়েছে নতুন জায়গায়, আবার গাছ কেটে জমি পরিষ্কার করে ঘর তুলতে হয়েছে। ক্যাম্পবেল পয়েন্ট ছাড়ার সময় পূর্বপুরুষদের কবরও তুলে নিতে হয়। অনেকেই দুঃখ ভোলার জন্য আশ্রয় নিয়েছেন মদের মধ্যে।

উন্নয়ন নাকি ধ্বংস: ব্ল্যাকরক খনি ও ভবিষ্যতের দ্বন্দ্ব

ডোরে লেক থেকে উচ্ছেদের পর যে পরিবারগুলোর গল্প আলাদা করে চোখে পড়ে, তার একটি ওয়াপাচি পরিবার। ম্যাগি ওয়াপাচি, এখন ৮৮, নিজের রান্নাঘরের টেবিলে উপুড় কাটা এক বিভার ছাড়াচ্ছেন—এ যেন কয়েক প্রজন্মের দক্ষতার সরাসরি সাক্ষী। স্বামী ম্যাথিউ বিভার ধরেছেন; ছেলে নরম্যান অনুবাদ করছেন, কারণ ম্যাগি কেবল ক্রি ভাষাতেই কথা বলেন।

ওদের বাড়ি চিবুগামো নদীর তীরে, চিবুচিবি এলাকায়। এখানেই সন্তানদের “ওয়াকিং–আউট সেরিমনি”—শিশুর প্রথম পদক্ষেপের আচার—হয়েছিল। মা–নানি ছোট মেয়েদের, বাবা–দাদা ছেলেদের নিয়ে হাঁটেন নদীর জলে, প্রতিশ্রুতি দেন—বাচ্চাদের ক্রি জীবনের পথ ধরে বড় করবেন।

ওয়াপাচি পরিবার এখন প্রায় ১৪০ জনের বিস্তৃত কুল–পরিবার। তাদের ট্র্যাপলাইন চলে গিয়েছে বহু ভেতরের বনে, লগিং রোড ২১০ ধরে সেই পাহাড় পর্যন্ত, যাকে তারা ক্রি ভাষায় বলে গাওয়াশেবুগিডনাজ—“স্বর্ণ” বা “উজ্জ্বল পাহাড়”—বার্চ গাছের সোনালি ঝকঝকে পাতার জন্য। এখানেই তারা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্যভাবে পায় মুজ।

এই জায়গাটাই এখন ব্ল্যাকরক মেটালস ইনক.–এর নজরে। কোম্পানি চায় পাহাড় চেঁছে খুলে ফেলা হাই–পিওরিটি আয়রন, টাইটানিয়াম আর ভ্যানাডিয়ামের বিশাল ওপেন পিট মাইন। ২০১৩ সালে গ্র্যান্ড কাউন্সিল আর ওজে-বুগুমু ক্রি জাতি ব্ল্যাকরকের সঙ্গে একটি ইমপ্যাক্ট বেনিফিটস এগ্রিমেন্ট সই করে—ব্যালি হাস্কি নামে এক পূর্বপুরুষের নামাঙ্কিত চুক্তি। এতে প্রতিশ্রুতি ছিল অর্থ, চাকরি, প্রশিক্ষণ, ব্যবসা আর পরিবেশ–মনিটরিংয়ের সুযোগের।

নরম্যান নিজেও কাজ করেছেন কোম্পানির কমিউনিটি রিলেশন সমন্বয়কারী হিসেবে। কিন্তু বছর গড়াতে গড়াতে খনিজের দামের অস্থিরতায় প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে, আর সেই সাথে প্রতিশ্রুতিগুলিও যেন ছোট হয়ে এসেছে। ওয়াপাচি পরিবারে অনেকে বলছেন—যে সংখ্যক চাকরি আর চুক্তি প্রথমে বলা হয়েছিল, বাস্তবে তার অনেক কমই মিলবে।

ম Mining–ক্যাম্পের পাশের “র্যাবিট ক্যাম্পে” আমরা যখন বসে আগুনে মুজের মাংস সেঁকছি, নরম্যান কাঁধ ঝুলিয়ে বলেন—“উচ্ছেদ এখনো থামেনি। আমাদের মৌসুমি ক্যাম্পও সরাতে বলা হচ্ছে। বারবারই সরকার নতুন উন্নয়নের জন্য দরজা খুলে দেয়—আর আমাদের ট্র্যাপলাইন ছোট হতে থাকে।”

বৃদ্ধ ম্যাথিউ, প্রাক্তন ট্যালিম্যান, খনির বিরুদ্ধে; কিন্তু তাঁর সন্তানদের অনেকে হাল ছেড়েছেন—উন্নয়ন থামানো যাবে না, তাই যতটা পারা যায়, সুবিধা কুড়িয়ে নিতে হবে। নরম্যানের মতো কেউ কেউ কোম্পানিতে চাকরিও নিয়েছেন। এতে বাবার সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে; কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই জানেন—পাহাড় ভেঙে গেলে, তাদের ইতিহাসের বড় অংশও উধাও হয়ে যাবে।

এই টানাপোড়েন কেবল ওয়াপাচি পরিবারের ভেতরেই নয়; পুরো ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে মানুষ। কেউ দেখছেন খনি মানে চাকরি আর ব্যবসা; কেউ দেখছেন, আরেক দফা নির্বাসন।

অন্যদিকে, অভিজ্ঞতা আর অবিচলতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আ্যাবেল বসাম, সেই নেতা যিনি ওজে-বুগুমু ক্রি জাতিকে ১৯৮০–৯০-এর দশকে বারবার দরজা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও তর্ক, গবেষণা, আন্দোলন আর ব্লকেডের মাধ্যমে এনে দাঁড় করালেন লেক ওপেমিস্কার তীরে নতুন গ্রামে—ওজে-বুগুমু, অর্থাৎ “যেখানে মানুষ জড়ো হয়।”

স্থপতি ডাগলাস কার্ডিনালের নকশায় শাপতাঁ-ঘরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই গ্রাম আজ স্বীকৃত—একটি আধুনিক, টেকসই, কিন্তু ক্রি ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে। কেন্দ্রীভূত হিটিং সিস্টেমে স্থানীয় স’মিলের কাঠের গুঁড়া জ্বলে গরম পানি সরবরাহ করে; ট্র্যাপলাইনের নামে নাম পায় রাস্তা—মুস্কুচি মেস্কিনো, গিনশওয়াগুমশি মেস্কিনো, ওউকাউ সাখেগুন।

আজ আ্যাবেলের ছেলে কার্টিস বসাম ওজে-বুগুমুর প্রধান। নিজের অফিসের জানালায় দাঁড়িয়ে তিনি এক নজরে দেখতে পান চার্চ, স্কুল, যুবকেন্দ্র, সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, লজ, শাপতাঁ আর তারও পরে হ্রদ–বন–পাহাড়। প্রতিটি সকালেই এই দৃশ্য তাঁকে মনে করিয়ে দেয়—ওজে-বুগুমু ক্রি জাতির সামনে একসাথে দাঁড়িয়ে থাকা দুই সত্য: ভবিষ্যতের চাকরি আর ব্যবসার প্রয়োজন, আর সেই ভবিষ্যতের জন্যই বেঁচে থাকা বন–নদী–পাহাড়ের প্রয়োজন।

গাওয়াশেবুগিডনাজ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সিনথিয়া ওয়াপাচি দূরে তাকিয়ে থাকেন—চিবুগামো লেক, তারও পর ডোরে লেকের চিকন ঝিলিক। তাঁর পায়ের তলায় সেই পাহাড়ি পাথর, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুজের পদচিহ্নের পিছু নিয়েছে তাদের পরিবার। তিনি জানেন, বিনিয়োগকারীরা যদি জিতে যায়, তবে এই পাহাড় একসময় মিলিয়ে যাবে কিলোমিটার–লম্বা এক গর্তে, যার ভেতর থেকে তুলে নেওয়া খনিজ যাবে দূরের কারখানায়, অচেনা দেশে।

চোখের কোণে জল এসে জমে। তিনি চশমা খুলে মুছে বলেন—“এখানে অনেক ইতিহাস আছে। ভেবে দেখতে গেলে, এটাও হয়তো আরেকটা শুরুই হবে—আরেকটা সরে যাওয়ার শুরু।”