“কীভাবে এত তাড়াতাড়ি আবার বছর শেষ হয়ে গেল?”—প্রশ্নটা আগে শুনতাম শুধু বড়দের মুখে। এখন নিজেই বারবার বলে ফেলি। কখনও ডিনারের টেবিলে, কখনও অফিসের ভিড়ে, আবার কখনও সিগনালের লাল আলোয় থেমে থাকা গাড়ির ভেতর। মনে হয়, আরেকটা মাস নীরবে হারিয়ে গেল।
আজকাল এই অনুভূতি প্রায় সবার। সবাই আধা-হাসি, আধা-দুঃখের সুরে বলে, “সময় কেমন উড়ে যাচ্ছে।” কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকে ছোট্ট একটা হাহাকার—আমরা যেন এক বাসের পেছনে দৌড়াচ্ছি, যে সবসময় একটু দূরেই থেকে যায়।
শৈশবের দিকে তাকালে সময়কে আলাদা লাগে। স্কুলের ছুটি টান টান লম্বা, বিকেলের খেলাধুলা, রুটি–ওয়ালার হর্নের অপেক্ষা, দুপুরের গরমে অলস ঘুম—সব যেন ধীরে চলা এক পৃথিবী। দিনগুলো ছিল হাওয়ায় ভরা, ফাঁকা আর প্রশস্ত।
তখন আমাদের মস্তিষ্ক ভরে উঠছিল “প্রথম” দিয়ে—প্রথম বন্ধু, প্রথম পড়ে যাওয়া, প্রথম ভ্রমণ, প্রথম ভয়, প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ। নতুনত্ব আমাদের মনকে পুরোপুরি জাগিয়ে রাখত। আর মন যখন পুরো উপস্থিত থাকে, তখন স্মৃতিও গাঢ় হয়।
এ কারণেই শৈশব এত লম্বা বলে মনে হয়। দিনগুলো আসলে বড় ছিল না, বড় ছিল গভীরতা। দাদীর রান্নাঘরের গন্ধ, টিনের চালায় বৃষ্টির শব্দ—আজও যেন স্পষ্ট শোনা যায়।
শৈশবের দীর্ঘ দিন, প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের ছোট সময়
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জীবনে চুপচাপ ঢুকে পড়েছে রুটিন।
ঘুম থেকে ওঠা, কাজ, যাতায়াত, মেসেজের জবাব, তাড়াহুড়া করে ডিনার, ক্লান্ত শরীর বিছানায় ফেলেই আবার পরের দিনের প্রস্তুতি—এভাবেই চলতে থাকে।

একসময় বুঝতেই পারিনি, আমরা ধীরে ধীরে “অটোপাইলট”–এ চলে গেছি। দিনগুলো একে অন্যের কপি হয়ে উঠেছে। বিস্ময়ের জায়গা নিয়েছে অভ্যাস। আনন্দ পর্যন্তকে আমরা সময় মাপে ভাগ করে নিয়েছি।
যত কম অনুভব করি, সময় তত দ্রুত যায়। এটাই অস্বস্তিকর সত্যি।
যে আনন্দগুলো একসময় উত্তেজনা দিত, সেগুলোও এখন পরিচিত। মস্তিষ্ক আর আগের মতো মনোযোগ দেয় না, কারণ নতুনত্ব কমে গেছে। তখনই দিনগুলো ঝাপসা হতে শুরু করে। মাসগুলো একটার ভেতরে আরেকটা ভাঁজ হয়ে যায়, আর আমরা হাঁফ ছেড়ে বলি, “এখনই আবার ডিসেম্বর?”
এর সঙ্গে যোগ হয় আধুনিক জীবনের চাপ—ডেডলাইন, অসুস্থ বা বয়স্ক বাবা–মা, পারিবারিক দায়িত্ব, সামাজিক আড্ডা, ডজন ডজন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অবিরাম শব্দ। আমরা দিনগুলো বাঁচি না, কোনো রকমে টিকে থাকি।
এভাবে ব্যস্ততা সময়কে চেপে ধরে, সঙ্কুচিত করে। আর উপস্থিতি, মনোযোগ—সময়কে প্রসারিত করে। এখানেই এসে দাঁড়ায় মূল প্রশ্ন: আমরা কি সত্যিই সময়ের পেছনে ছুটছি, নাকি নিজেরাই খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছি? হয়তো আমাদের দরকার সময়কে ধীরে নেওয়া।
ছোট ছোট উপস্থিতি, দীর্ঘতর দিন
আমি যখনই ভাবি, সময়কে কীভাবে একটু ফিরে পাওয়া যায়, তখন দেখি—সমাধানটা বিশাল কোনো বদল নয়। বরং ছোট ছোট সচেতন সিদ্ধান্ত।
সকালে এক কাপ কফি, পাশে ফোন না রেখে।
ডিনারের পর ছোট্ট হাঁটা।
সপ্তাহে একদিন হালকা ছুটি, শুধু নিজের জন্য।
মেসেজের উত্তর দেওয়ার আগে দুই সেকেন্ড থেমে নিঃশ্বাস নেওয়া।
এই সামান্য কাজগুলোই দিনকে নোঙর দেয়। মুহূর্তগুলো আবার মনে থাকার মতো হয়। আমরা তখন একটু একটু করে সময়কে ধীরে নেওয়া–র অনুশীলন করি। সময় কমে না, কিন্তু পালিয়ে যাওয়াটাও বন্ধ হয়।
মাঝেমধ্যে কোনো অপ্রত্যাশিত ফোনকল, অপ্রস্তুত বিদায়, বা হঠাৎ পাওয়া ক্ষুদ্র আনন্দ সবকিছু থামিয়ে দেয়। তখন আমরা সময়ের ওজন আবার টের পাই। অদ্ভুতভাবে, যে ঘটনাগুলো আমাদের ভেঙে দেয়, আর যে ঘটনাগুলো আমাদের সারিয়ে তোলে—দুটোই সময়কে থামিয়ে দিতে পারে।

সত্যি বলতে, সময় এখন দ্রুত মনে হয় কারণ আমরা আরও বেশি ব্যস্ত, আরও বেশি বিভ্রান্ত। ছোট ছোট খুঁটিনাটি—আলো, গন্ধ, কারও হাসি—এসবের দিকে তাকানো আমরা কমিয়ে দিয়েছি।
সময় তো বদলায়নি, একই গতিতে বয়ে যাচ্ছে। বদলেছে আমাদের মনোযোগ।
আমরা যত কম মনোযোগ দিই, জীবন তত দ্রুত সরে যায়। হয়তো বড় হওয়া মানে নতুন করে হাঁটা শেখা—ধীরে, সচেতনভাবে, চারপাশে তাকিয়ে।
হয়তো এর মানে, আমরা আবার অনুশীলন করব সময়কে ধীরে নেওয়া—সকালের আলোর দিকে একটু বেশি তাকিয়ে থাকা, প্রিয়জনের হাতের উষ্ণতা অনুভব করা, সাধারণ দিনের মাঝেও লুকিয়ে থাকা মিষ্টতা খুঁজে নেওয়া।
যখন আমরা নিজের জীবনে ফিরে আসি, দৌড় ধীর হয়, ঝাপসা কমে যায়। দিনগুলো আবার একটু লম্বা লাগে। লম্বা হলো বলে নয়, বরং আমরা আবার এখানে আছি—সময়কে সত্যি সত্যিই অনুভব করছি, একটু করে সময়কে ধীরে নেওয়া শিখে নিচ্ছি।
#সময় #Time #SlowLiving #Mindfulness #Lifestyle #Sarakhon #ThePresentWorld
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















