বিমান থেকে নেমে শহরে ঢুকতেই মনে হয়—কিছু একটা বদলে গেছে। পরিচিত রাস্তা, পুরোনো শপহাউস, সবুজ করিডর—সব যেন আলাদা আলোয় ধরা দিচ্ছে। কারণ, এ বছর সিঙ্গাপুর বায়েনাল ২০২৫ কেবল কোনো প্রদর্শনী নয়; পুরো শহরটাই হয়ে উঠেছে তার মঞ্চ, এক টানা পারফরম্যান্সের মতো।
দেশের ৬০ বছর পূর্তির প্রেক্ষাপটে SG60 সিগনেচার ইভেন্ট হিসেবে এই বায়েনাল যেন অতীত আর ভবিষ্যতের মাঝে এক চলমান সংলাপ—শহর কত দূর এসেছে, আর কোথায় যেতে চায়, সে হিসাব টানে নীরবে।
মিউজিয়াম থেকে মল—যেখানে-সেখানে শিল্পের অপ্রত্যাশিত আগমন
তানজং পাগার ডিস্ট্রিপার্কে সিঙ্গাপুর আর্ট মিউজিয়ামে পা রাখতেই বোঝা যায়, সিঙ্গাপুর বায়েনাল ২০২৫ শুধু গ্যালারির ভেতরের দেয়ালে আটকে নেই। পুরোনো বন্দর গুদাম এখন তিনতলা উঁচু এক পরীক্ষাগার—যেখানে ধাক্কা খাচ্ছে কল্পনা, স্মৃতি আর দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো দৃশ্য।
ভারতের আর্ট গ্রুপ CAMP–এর Metabolic Container–এ ভরা ২০ ফুট লম্বা কনটেইনার—৪০০ বাক্স, তাতে লেবেল সাঁটা সাধারণ জিনিস: সাম্বল, ক্র্যাকার, পারফিউম। এগুলো কোনো মৃত বস্তু নয়; এগুলো চলমান জীবনের প্রতীক—মানুষ, পণ্য আর স্মৃতির অদৃশ্য স্রোত।
অল্প দূরেই পল চ্যানের উজ্জ্বল রঙের ফোলানো ফিগার Khara En Tria—নীল, টিল আর হলুদ নরম দেহ একসঙ্গে দুলছে, যেন এক অদ্ভুত নাচের বৃত্ত। দেখতে খেলাচ্ছলে হলেও ভেতরে আছে টানাপোড়েন, একসাথে থাকার টান আর ভয়ের সুর।
গ্যালারির আরেক কোণে আলো, ধোঁয়া আর শব্দে তৈরি পিয়ের উইগের Offspring যেন জীবন্ত—দর্শকের চলাফেরা আর পরিবেশের সঙ্গে বদলে যায় তার রূপ। আলভারো উরবানোর Metallic Flora আলো–ছায়ায় তুলে আনে অর্কিড কূটনীতির ইঙ্গিত, আর মিং ওংয়ের Filem-Filem-Filem পুরোনো সিনেমা হলের পোলারয়েড ছবি দিয়ে ধুয়ে ওঠা স্মৃতিকে ধরে রাখে শেষ আলোটুকুতে।
আর মিউজিয়ামের ক্যাফেতেই, RRD–এর Gastrogeography খাবার, প্যাকেট, দেয়ালচিত্র আর রান্নার গল্প দিয়ে বোঝায়—স্বাদ আর গন্ধ কত সহজে মানুষকে যুক্ত করে মেক্সিকো থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত।
দুপুরের দিকে দৃশ্য বদল হয় অরচার্ড রোডে। ফার ইস্ট শপিং সেন্টার আর লাকি প্লাজার মতো ব্যস্ত মলগুলোও এখন সিঙ্গাপুর বায়েনাল ২০২৫–এর অংশ। যেখানে সাধারণত শপিং আর খাবারের ভিড়, সেখানেই আচমকা উঠে আসে শিল্প, স্মৃতির ল্যাবরেটরি আর অনিশ্চয়তার ছোট ছোট মঞ্চ।
ইউরি প্যাটিসনের Entropy Study–তে দেখানো হয় চীনা রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের ক্ষুদ্র মডেল—এক সময়ের ঝকঝকে স্বপ্ন এখন নীরব, আলোহীন। লুকানো গেইগার কাউন্টার অল্প রেডিয়েশন ধরলেই জানালায় টিমটিম আলো জ্বলে ওঠে, যেন স্নায়ুচাপের শহর। মাথার উপর কৃত্রিম আকাশ Cloud Gazing–এর চলমান মেঘ—অসংকেতপূর্ণ, অস্থির, অনিশ্চিত।
মুহূর্তের জন্য মনে হয়, এই মল আর মল নেই—এ এক ছোট পরীক্ষাগার, যেখানে ভেঙে পড়া অর্থনীতি, অদৃশ্য ঝুঁকি আর মানবস্বপ্নের ভঙ্গুরতা একসঙ্গে জেগে ওঠে।

সবুজ পাহাড়, পুরোনো স্কুল, শপহাউস—শহরের ভিতরে আরেক শহর
দ্বিতীয় দিনের সকাল শুরু হয় ফোর্ট ক্যানিং পার্কে। একসময় মালয় শাসকদের আসন, পরে ব্রিটিশ সামরিক ঘাঁটি—এই পাহাড় এখন শান্ত সবুজ, কিন্তু নিচে জমে আছে ইতিহাসের স্তর। সেখানে কাপওয়ানি কিওয়াঙ্গার Flowers for Africa: Rwanda–এর বিজয়-তোড়ণ দাঁড়িয়ে আছে শুকিয়ে যেতে থাকা ইউক্যালিপটাস পাতায় মোড়া। বিজয়ের চেয়ে এখানে বেশি ঘন শোক, অদৃশ্য ক্ষত আর স্মৃতির ওজন।
জ্যাকলিন কিয়োমি গোরকের HNZF IV—সামরিক এয়ারোস্পেসের স্ক্র্যাপ দিয়ে বানানো ফোয়ারা—শুরুতে স্রেফ পানির শব্দ শোনায়, তারপর ধীরে ধীরে শব্দ ভেঙে যায় শোরগোলে; পরিচিত সুর একসময়ে হয়ে ওঠে অস্বস্তিকর, যেন শান্তি আর হুমকির মাঝের সূক্ষ্ম রেখা মুছে যাচ্ছে।
ওয়েসেক্স এস্টেটে পুরোনো ঔপনিবেশিক বাড়িগুলো ভেতরে ভেতরে গ্লোবাল কথোপকথনের ঘর। ব্লেনহাইম কোর্টে জেসি জোনসের The White Cave–এ ঝিনুক হয়ে ওঠে নারীবাদী দরজা; প্রাগৈতিহাসিকতা আর ভূতত্ত্ব গেঁথে যায় স্বপ্নময় ভিডিও ভাষায়। পাশের কক্ষে ইক্কিবাউইক্র্রের Seaweed Story–এ জেজুর সমুদ্র-নারীদের fading ঐতিহ্য—ভিডিও আর সি–উইডের ভাস্কর্যে বোনা থাকে সাগরের পানি, শ্রম আর নারীর অদৃশ্য ইতিহাস।
ট্যাংলিন হল্টের পুরোনো পাবলিক হাউজিং আর শপহাউসগুলোতে সিনেমা, নীরব বিপ্লব আর ক্ষুদ্র অঙ্গভঙ্গির রাজনীতি। অ্যাড্রিয়ান ওংয়ের With Hate from Hong Kong পুরোনো হংকং সিনেমার সেট, প্রপ আর দৃশ্য দিয়ে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় আরেক যুগে—যেখানে নারী চরিত্রই এবার উল্টে দেয় পুরুষ-নির্ভর অ্যাকশন ট্রোপ।
জু চুন লিনের কাজ The laugh laughs at the laugh, The song sings at the song–এ কাগজ, কাঠ, প্লাস্টিক আর বেলুন–ভিত্তিক অবজেক্ট বারবার গড়ে ওঠে, ভেঙে পড়ে, আবার গড়ে ওঠে। যেন দেখিয়ে দেয়—ছোট ছোট পুনরাবৃত্তি, মেরামত আর যত্নও কাঠামো বদলে দিতে পারে, জায়গাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলতে পারে।
শেষ বিকেলে মনে হয়—শহর আসলে শুধু বিল্ডিং আর যানজটের নাম নয়। শহর মানে স্মৃতি আর শোক, কৌতূহল আর নীরবতা, কমিউনিটি আর নিশ্বাসের শব্দ।
সিঙ্গাপুর বায়েনাল ২০২৫ কোনো চূড়ান্ত উত্তর দেয় না; বরং জায়গা করে দেয় ভাবার জন্য। যেন বলে—শহর কখনোই স্থির নয়, সে এক চলমান মানচিত্র; যেখানে প্রতিদিন নতুনভাবে লেখা হয় স্মৃতি আর সম্ভাবনার গল্প।
#SingaporeBiennale2025 #Singapore #Art #Sarakhon #ThePresentWorld #Exhibition #SoutheastAsia #Culture
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















