০৬:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫
২০২৫-এর সেরা টিভি শো: কূটনীতি, যুদ্ধ, রহস্য ও সম্পর্কের অদ্ভুত সব গল্প মানুষকে খুশি রাখার ফাঁদ: কেন আমরা ‘হ্যাঁ’ বলতে বাধ্য হই এবং মুক্তির পথ কোথায় দারিয়াগঞ্জের মুঘল প্রাচীর ঃ শেষ প্রহরীর আর্তনাদ তানজানিয়ার সহিংস নির্বাচনেই অর্থনীতির ওপর ঘনিয়ে আসছে অনিশ্চয়তা পুরুষরা কি সত্যিই বেশি কষ্টে ভোগে? ‘ম্যান ফ্লু’ নিয়ে নতুন বৈজ্ঞানিক রহস্য উন্মোচন আফ্রিকার নীল-কার্বন বিপ্লব: উপকূল রক্ষায় কার্বন ক্রেডিট কি নতুন আশা? লিসার সাহসী লুক নিয়ে নতুন জল্পনা: লুই ভুঁইতোঁ ইভেন্টে নজর কাড়লেন কে-পপ তারকা মিষ্টি পানীয় কর থেকে প্লাস্টিক নিষেধাজ্ঞা—২০২৬ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসছে ছয়টি নতুন নিয়ম দুবাইয়ে মৃত্যুবরণ করলেন আমিরাতপ্রবাসী ভারতীয় ‘সুপারম্যান’ দেবেশ মিস্ত্রি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গুরুতর অনিয়মে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি বাতিল

দারিয়াগঞ্জের মুঘল প্রাচীর ঃ শেষ প্রহরীর আর্তনাদ

ওল্ড দিল্লির ঐতিহাসিক প্রাচীর আজ ভাঙন-সঙ্কটে। শাহজাহানের স্বপ্নের শহর শাহজাহানাবাদকে রক্ষার জন্য নির্মিত ১৩ মিটার উঁচু ও ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীর এখন কেবল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন স্মৃতি। দারিয়াগঞ্জের যে অংশটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত বলা হতো, সেটিও আজ দাঁড়িয়ে আছে চরম দুরবস্থায়—ঝরে পড়ছে পাথর, ভেঙে পড়ছে অংশবিশেষ, আর তার উপর চাপ সৃষ্টি করছে আধুনিক নগরজীবনের দৌরাত্ম্য।

মুঘল গৌরবের প্রাচীর আজ ভাঙনের মুখে

সপ্তদশ শতকে শাহজাহান যখন রাজধানী আগ্রা থেকে যমুনা তীরে সরালেন, তখন তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন এক শহর, যেটি সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখবে এবং একই সঙ্গে মুঘল শৌর্য প্রকাশ করবে। সেই উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল শাহজাহানাবাদ, চারদিকে বিশাল প্রাচীর, ১৩টি প্রধান দরজা ও ১৪টি ছোট গেটসহ।
কিন্তু আজ সেই প্রাচীরের বাকি অংশ ছড়ানো, চাপা ও ক্ষতবিক্ষত। ব্রিটিশ দখলদারির পর থেকেই শুরু হওয়া পতন আজ পৌর উদাসীনতা ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজে আরও দ্রুততর হয়েছে।

দারিয়াগঞ্জের প্রাচীরের সর্বশেষ লড়াই

এই ১.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশে ভাঙনের চিহ্ন সর্বত্র। কোথাও পাথর খসে পড়ে ক্ষতি করছে যানবাহনের, কোথাও প্রাচীরের তলদেশে জমছে আবর্জনা। পুরনো খিলানের নিচে গজিয়ে উঠেছে অস্থায়ী মন্দির, গেমিং ডেন, দোকান, হাসপাতালের অপেক্ষালয়—ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ওপরে যেন আধুনিক জীবনের পরজীবী দখল।
প্রিন্টিং ইউনিটের কর্মী রাজীব দুবে বলেন, “বৃষ্টি হলে বড় অংশ ভেঙে পড়েছিল। প্রাণহানি হয়নি সৌভাগ্যক্রমে। কিন্তু পরের অংশ যেকোনো সময় পড়তে পারে।” তিন মাস পরেও সেই ধ্বংসাবশেষ সরানো হয়নি।

Barely standing: The Wall of Walled City | Latest News Delhi

১৮৫৭-পরবর্তী ধ্বংস ও মুছতে থাকা ঐতিহ্য

গেটগুলোর অনেকই আজ শুধু নাম হিসেবে বেঁচে আছে—মোরি, কাবুলি, লাহোরি। ১৮৫৭-র বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা প্রাচীরকে “হুমকি” মনে করে ধ্বংস শুরু করে। তারপর দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা নগরায়ণের চাপে ক্রমাগত হারিয়েছে আরো অংশ।
ইতিহাসবিদ নারায়ণী গুপ্তা ও সোহেল হাশমির গবেষণা দেখায়—নতুন রাস্তা, বাজার, রেললাইন, ছড়ানো বসতি—সবকিছুর নামেই মুছে গেছে মুঘল উত্তরাধিকার।

প্রাচীরের উপর আধুনিক শহরের চাপ

দারিয়াগঞ্জে প্রাচীরের গায়ে জন্মানো গাছের শেকড় পাথর ভেঙে দিচ্ছে ভেতর থেকে। কোথাও বর্জ্যের পাহাড়, কোথাও নর্দমার পানি চুঁইয়ে নষ্ট করছে মর্টার। আগস্টে দেয়াল সংলগ্ন ভবন ধসে তিন শ্রমিক মারা গেলে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে—যেটি এখনো মেরামতের অপেক্ষায়।
নিগমবোধ ঘাট, কাশ্মীরি গেট, আইএসবিটির পাশ দিয়ে প্রাচীরের অবশিষ্টাংশ যেভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে আছে, তাতে বোঝা যায় ঐতিহ্য রক্ষায় কার্যকর তদারকি কার্যত নেই।

প্রাচীর শুধু পাথর নয়—এক শহরের আত্মপরিচয়

মির্জা গালিবের সময়কার লেখকরা বলেছিলেন—এই প্রাচীর সংস্কৃতির ঢাল, শহরের আত্মা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি সৃষ্টি করেছিল এক অভিন্ন নাগরিক অভিজ্ঞতা, শ্রেণি-ধর্মের ভেদ ভুলিয়ে মানুষের মধ্যে গড়ে তুলেছিল দিল্লির প্রতি গভীর ভালোবাসা।
আজ ওই স্মৃতি ভাঙা পাথরের মতোই খণ্ডিত হলেও এটি এখনও মনে করিয়ে দেয়—দিল্লির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক এই প্রাচীরের স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে।

প্রশ্ন একটাই—এই প্রাচীর কি পরবর্তী শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকবে? তার উত্তর নির্ভর করছে আজকের আমাদের ইচ্ছা ও সুরক্ষা-চেষ্টার ওপর। আপাতত সেই ইচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না দারিয়াগঞ্জের ভাঙা প্রাচীরের ওপর ছড়িয়ে থাকা ধুলোর মাঝে।

জনপ্রিয় সংবাদ

২০২৫-এর সেরা টিভি শো: কূটনীতি, যুদ্ধ, রহস্য ও সম্পর্কের অদ্ভুত সব গল্প

দারিয়াগঞ্জের মুঘল প্রাচীর ঃ শেষ প্রহরীর আর্তনাদ

০৪:০০:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫

ওল্ড দিল্লির ঐতিহাসিক প্রাচীর আজ ভাঙন-সঙ্কটে। শাহজাহানের স্বপ্নের শহর শাহজাহানাবাদকে রক্ষার জন্য নির্মিত ১৩ মিটার উঁচু ও ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীর এখন কেবল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন স্মৃতি। দারিয়াগঞ্জের যে অংশটিকে সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত বলা হতো, সেটিও আজ দাঁড়িয়ে আছে চরম দুরবস্থায়—ঝরে পড়ছে পাথর, ভেঙে পড়ছে অংশবিশেষ, আর তার উপর চাপ সৃষ্টি করছে আধুনিক নগরজীবনের দৌরাত্ম্য।

মুঘল গৌরবের প্রাচীর আজ ভাঙনের মুখে

সপ্তদশ শতকে শাহজাহান যখন রাজধানী আগ্রা থেকে যমুনা তীরে সরালেন, তখন তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন এক শহর, যেটি সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখবে এবং একই সঙ্গে মুঘল শৌর্য প্রকাশ করবে। সেই উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল শাহজাহানাবাদ, চারদিকে বিশাল প্রাচীর, ১৩টি প্রধান দরজা ও ১৪টি ছোট গেটসহ।
কিন্তু আজ সেই প্রাচীরের বাকি অংশ ছড়ানো, চাপা ও ক্ষতবিক্ষত। ব্রিটিশ দখলদারির পর থেকেই শুরু হওয়া পতন আজ পৌর উদাসীনতা ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজে আরও দ্রুততর হয়েছে।

দারিয়াগঞ্জের প্রাচীরের সর্বশেষ লড়াই

এই ১.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশে ভাঙনের চিহ্ন সর্বত্র। কোথাও পাথর খসে পড়ে ক্ষতি করছে যানবাহনের, কোথাও প্রাচীরের তলদেশে জমছে আবর্জনা। পুরনো খিলানের নিচে গজিয়ে উঠেছে অস্থায়ী মন্দির, গেমিং ডেন, দোকান, হাসপাতালের অপেক্ষালয়—ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ওপরে যেন আধুনিক জীবনের পরজীবী দখল।
প্রিন্টিং ইউনিটের কর্মী রাজীব দুবে বলেন, “বৃষ্টি হলে বড় অংশ ভেঙে পড়েছিল। প্রাণহানি হয়নি সৌভাগ্যক্রমে। কিন্তু পরের অংশ যেকোনো সময় পড়তে পারে।” তিন মাস পরেও সেই ধ্বংসাবশেষ সরানো হয়নি।

Barely standing: The Wall of Walled City | Latest News Delhi

১৮৫৭-পরবর্তী ধ্বংস ও মুছতে থাকা ঐতিহ্য

গেটগুলোর অনেকই আজ শুধু নাম হিসেবে বেঁচে আছে—মোরি, কাবুলি, লাহোরি। ১৮৫৭-র বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা প্রাচীরকে “হুমকি” মনে করে ধ্বংস শুরু করে। তারপর দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা নগরায়ণের চাপে ক্রমাগত হারিয়েছে আরো অংশ।
ইতিহাসবিদ নারায়ণী গুপ্তা ও সোহেল হাশমির গবেষণা দেখায়—নতুন রাস্তা, বাজার, রেললাইন, ছড়ানো বসতি—সবকিছুর নামেই মুছে গেছে মুঘল উত্তরাধিকার।

প্রাচীরের উপর আধুনিক শহরের চাপ

দারিয়াগঞ্জে প্রাচীরের গায়ে জন্মানো গাছের শেকড় পাথর ভেঙে দিচ্ছে ভেতর থেকে। কোথাও বর্জ্যের পাহাড়, কোথাও নর্দমার পানি চুঁইয়ে নষ্ট করছে মর্টার। আগস্টে দেয়াল সংলগ্ন ভবন ধসে তিন শ্রমিক মারা গেলে বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছে—যেটি এখনো মেরামতের অপেক্ষায়।
নিগমবোধ ঘাট, কাশ্মীরি গেট, আইএসবিটির পাশ দিয়ে প্রাচীরের অবশিষ্টাংশ যেভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে আছে, তাতে বোঝা যায় ঐতিহ্য রক্ষায় কার্যকর তদারকি কার্যত নেই।

প্রাচীর শুধু পাথর নয়—এক শহরের আত্মপরিচয়

মির্জা গালিবের সময়কার লেখকরা বলেছিলেন—এই প্রাচীর সংস্কৃতির ঢাল, শহরের আত্মা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি সৃষ্টি করেছিল এক অভিন্ন নাগরিক অভিজ্ঞতা, শ্রেণি-ধর্মের ভেদ ভুলিয়ে মানুষের মধ্যে গড়ে তুলেছিল দিল্লির প্রতি গভীর ভালোবাসা।
আজ ওই স্মৃতি ভাঙা পাথরের মতোই খণ্ডিত হলেও এটি এখনও মনে করিয়ে দেয়—দিল্লির ইতিহাসের প্রতিটি বাঁক এই প্রাচীরের স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে।

প্রশ্ন একটাই—এই প্রাচীর কি পরবর্তী শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকবে? তার উত্তর নির্ভর করছে আজকের আমাদের ইচ্ছা ও সুরক্ষা-চেষ্টার ওপর। আপাতত সেই ইচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না দারিয়াগঞ্জের ভাঙা প্রাচীরের ওপর ছড়িয়ে থাকা ধুলোর মাঝে।