গত পনেরো বছরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অন্যতম সফল অংশীদার হিসেবে উঠে এসেছিল। প্রতিবেশী সহযোগিতা কীভাবে ফলপ্রসূ হতে পারে, তার একটি উদাহরণ তৈরি হয়েছিল এই সম্পর্কের মাধ্যমে। সীমান্ত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে, আর ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়ের বিরুদ্ধে ঢাকার কঠোর পদক্ষেপ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নত করতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে।

২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশে যা ঘটেছে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। অর্থনৈতিক সূচকগুলো উদ্বেগজনক। ২০২৩ সালে যেখানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ, সেখানে ২০২৫ অর্থবছরে তা নেমে আসার সম্ভাবনা ৩ দশমিক ৩ থেকে ৪ শতাংশে। আগের সরকারের সময় যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখানে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আনুমানিক ২১ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ তরুণ বেকার বা শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে অবস্থান করছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে আরও প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। এ ধরনের অর্থনৈতিক সংকট রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আদর্শগত উগ্রতার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।
২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক চার্টারের কারণে এসব সংগঠন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তারা কার্যত কোনো বাধা ছাড়াই সক্রিয়। এর সঙ্গে পাকিস্তান এবং তাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বাংলাদেশের প্রতি বাড়তে থাকা আগ্রহ যুক্ত হলে, তা বাংলা অঞ্চল ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

একই সময়ে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন থাকা আওয়ামী লীগকে পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের সরকারের প্রতিটি নীতি সমর্থন না করেও বলা যায়, বাংলাদেশের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দলকে কার্যত রাজনীতির ময়দান থেকে বাদ দেওয়া দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্যে এক গভীর পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি ভারতের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২৪ সালের ৪ থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নথি অনুযায়ী, সারা দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর ২ হাজার ১০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে প্রথম আলো-এর একটি স্বাধীন অনুসন্ধানে ৪৯টি জেলায় ১ হাজার ৬৮টি হামলার তথ্য উঠে আসে। পরবর্তী মাসগুলোতে ‘রিপোর্ট করা’ ঘটনার সংখ্যা কিছুটা কমলেও, কম সংখ্যায় হলেও ধারাবাহিকতা বজায় থাকা সংখ্যালঘু সুরক্ষার সাংবিধানিক অঙ্গীকার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করে। ১৯৭১ সালের শরণার্থী সংকটের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি সরাসরি তুলনাযোগ্য না হলেও, বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার একটি অংশের স্থানচ্যুতি হলেও তা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা উপেক্ষা করা যায় না। চলতি বছরের মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বেইজিং সফরের সময় চীন বাংলাদেশকে ঋণ, বিনিয়োগ ও অনুদান মিলিয়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়। গত এক দশকে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে এবং অবকাঠামো খাতে ২৪ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলে বিভিন্ন হিসাবে উঠে এসেছে।
ভারত বরাবরই বলে এসেছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক অংশীদার নির্বাচন তাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। তবে বন্দর, টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ও জ্বালানি স্থাপনার মতো কৌশলগত সম্পদ যদি ব্যাপকভাবে বহিরাগত অর্থায়নের আওতায় চলে যায়, তা ভারতের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ভারসাম্যপূর্ণ নিরাপত্তা কাঠামো বজায় রাখা ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটেই শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ প্রশ্নটি বিবেচনা করা উচিত, যদি বাংলাদেশের বর্তমান কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর ফেরত চায়। ভারত স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের অনুরোধ আইনগত ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পর্যালোচনা করবে। ভারত–বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিই এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক কাঠামো প্রদান করে। এটি কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত বা রাজনৈতিক সুবিধার বিষয় নয়; বরং আইনগত প্রক্রিয়া, চুক্তিগত দায়বদ্ধতা ও সার্বভৌম বিবেচনার প্রশ্ন। একই সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তিগুলো সাধারণত রাষ্ট্রকে বিশেষ বিবেচনার সুযোগ দেয়, বিশেষ করে রাজনৈতিক নিপীড়ন বা মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কা থাকলে, যেখানে মানবিক দিক, কূটনৈতিক প্রভাব এবং সর্বোপরি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রশ্ন জড়িত।

দেশগুলোর সুনাম গড়ে ওঠে শুধু সমন্বয়ের মুহূর্তে তাদের ভূমিকার মাধ্যমে নয়, বরং সংকটে অংশীদারদের পাশে তারা কীভাবে দাঁড়ায়, তার মাধ্যমেও। এই পরিস্থিতিতে ভারতের ভূমিকা কেবল ঢাকায় নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাজধানীতেও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
এ কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরেও ভারতের প্রতিক্রিয়ার তাৎপর্য রয়েছে। এটি নির্ভরযোগ্য আঞ্চলিক অংশীদার হিসেবে ভারতের ভাবমূর্তি এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও সম্পর্কের স্থায়িত্ব নিয়ে ধারণাকে প্রভাবিত করবে।
আগামী মাসগুলোতে ভারতের অবস্থান নির্ধারণে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল জরুরি। আইনসম্মত ও নীতিনিষ্ঠ, একই সঙ্গে কৌশলগতভাবে দূরদর্শী সম্পৃক্ততার ওপরই এ কৌশল দাঁড়ানো উচিত। পাশাপাশি বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার পরিবেশ তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন, কারণ বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ দলকে বাদ দেওয়া নির্বাচনের বৈধতা ও পরবর্তী স্থিতিশীলতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
অর্থনৈতিক বিষয়গুলোও কেন্দ্রে রাখতে হবে। বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও সামাজিক চাপ বাড়লে তা উগ্রতা ও অস্থিরতার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে, যার প্রভাব সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়া অনিবার্য।
সবশেষে, ভারতের আচরণে ধারাবাহিকতা ও নীতির স্পষ্ট বার্তা থাকা জরুরি। আইনগত দায়বদ্ধতার সঙ্গে মানবিক বিবেচনা, চুক্তিগত অঙ্গীকারের সঙ্গে কৌশলগত দূরদৃষ্টি এবং দ্বিপক্ষীয় সংবেদনশীলতার সঙ্গে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রয়োজন—এই সবকিছুর ভারসাম্যই হওয়া উচিত ভারতের লক্ষ্য।
পরিবর্তনশীল প্রতিবেশী অঞ্চলের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে তাৎক্ষণিক চাপ ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টির সমন্বয় থাকতে হবে। কারণ সংকটকালে আমরা অংশীদারদের যেভাবে দেখি ও আচরণ করি, স্থিতিশীলতার সময় ঠিক সেই অংশীদারিত্বই আমাদের সামনে নতুন সুযোগ তৈরি করে।
লেখক: হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা রাজ্যসভার সদস্য ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। (লেখাটি হিন্দুস্তান টাইমস থেকে অনূদিত)
হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা 



















