০৫:৪২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

জীবন আমার বোন (পর্ব-১৩)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ মে ২০২৪
  • 16

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

মাথায় সপসপে চুলে লাল গামছা জড়িয়ে রোদ থেকে তোলা গুচ্ছের কাপড় পাঁজা ক’রে নীলাভাবী ঘরে ঢুকতেই সবকিছু বদলে গেল। কি স্নিগ্ধ নীলাভাবীর মুখ। নাকি গোসল করার পর সবাইকেই অমন মনে হয়। দেশটাকে খোলামকুচির মতো হাতে পেলে পুরো ঢাকা শহরটাকেই একটা হামামখানা বানিয়ে দেওয়া যায়, মনে মনে পরিকল্পনা তৈরি করে খোকা।

‘খুব বুঝি দেশোদ্ধার ক’রে বেড়াচ্ছো?’

‘কই আর’

‘কেন, এখন তো সকলের ঐ একই কাজ!’

‘তুমি তো জানোই নীলাভাবী, আমি সকলের দলে পড়ি না’

‘পড়ো ঠিকই, জানতে পারো না! সারা দেশ কিভাবে গজরাচ্ছে!”

রান্নাঘর থেকে সিদ্দিকাভাবীর গলা শোনা গেল, ‘এক গ্লাস শরবত তৈরি ক’রে দাও ওকে’

‘একটু বোসো, চটপট গোছগাছ ক’রে নি, তারপর তোমার শরবত’ খোকা খ’চে উঠলো। বললে, ‘নিকুচি করি তোমার শরবতের, দিনটাই আজ মাঠে মারা গেল। এই এক জঞ্জালে জীব মেয়েলোক! আজ বরং চলি।’

‘একেবারে ঘোড়ায় চ’ড়ে এসেছো দেখছি, ব্যাপার কি?’

‘কোথায় একটু ফ্রি থাকবে, আড্ডা মেরে ঘচাং ক’রে কেটে পড়বো, তা’ নয়, যত্তোসব উড়ো ঝক্কি। চুড়ি বাজিয়ে গোসল করা, শুকনো কাপড় ভাঁজ করা, চুলঝাড়া, রাবিশ রাবিশ!’

নীলাভাবী হেসে বললে, ‘তুমি এসেছো বুঝেই চুড়ি বাজাচ্ছিলাম, কি বুঝলে?’

‘বুঝেছি’

‘কচু বুঝেছো, যা একখানা মাথা তোমার! যাও, আমার ঘরে গিয়ে পাখা ছেড়ে দিয়ে আরাম ক’রে বোসোগে, চটপট সব সেরে আমি এই এলাম ব’লে-”শালার বাড়িটা যেন পাখার একটা জীবন্ত বিজ্ঞাপন- ‘খটটাই মেজাজে বললে খোকা।

নীলাভাবীর ঘরটা এ বাড়ির ভিতর একেবারেই স্বতন্ত্র। কোথাও কোনো খুঁত নেই, পরিপাটি ক’রে সাজানো-গোছানো, চকচকে- তকতকে, সামান্য একটু আঁচড়ও পড়েনি দেয়ালের কোথাও। মনে হয় এই ঘরটার সঙ্গে বক্কে থাকা বাড়িটার কোনো সম্বন্ধ নেই; থাকলেও তা এমনই জটিল এমনই গোলমেলে যে সে সম্পর্ক নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। বরং ঘুরিয়ে বললে বাড়িটাই একটি স্ববিরোধ হ’য়ে যায়।

এ ঘরে অধিষ্ঠান যার, সে যেন সহসা কোনো সুদূর নক্ষত্রালোক থেকে রহস্যময় কারণে পৃথিবীতে আবির্ভূত; কিলবিলে থুকথুকে নোংরা আশ্রয়কে সে স্বপ্নের ভিতরে নিয়ে যায়। বিছানাটা দেখলে বোদলেয়রের সেই ‘প্রবল-মধুর’ আলস্যময় বিড়াল কবিতাগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

‘ধরো– পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরে নীলাভাবী। বললে, ‘খালি চিনি কিন্তু, ঘরে লেবু নেই–‘

‘নিকুচি করি আমি লেবুর! এবার থেকে টিকিট কেটে দেখা করতে আসবো তোমার সঙ্গে!’

‘এতদিন বিনা টিকিটে আসছিলে, না পাশে?’

‘খচড়ামি রেখে খাওয়াটা সেরে এলেই খুশি হতাম!’

‘তবে কি?’ নীলাভাবী একগাল হেসে বললে, ‘তোমার জন্যে ব’সে

আছি নাকি পেটে পাথর বেঁধে? পুরুষমানুষের গোসল করা আর মেয়েমানুষের খাওয়া–সময় বেশি নিলেই অখ্যাতি। পাঁচ মিনিটের বেশি কখনোই আমার লাগে না!’

 

জীবন আমার বোন (পর্ব-১২)

জীবন আমার বোন (পর্ব-১২)

জীবন আমার বোন (পর্ব-১৩)

১১:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ মে ২০২৪

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

মাথায় সপসপে চুলে লাল গামছা জড়িয়ে রোদ থেকে তোলা গুচ্ছের কাপড় পাঁজা ক’রে নীলাভাবী ঘরে ঢুকতেই সবকিছু বদলে গেল। কি স্নিগ্ধ নীলাভাবীর মুখ। নাকি গোসল করার পর সবাইকেই অমন মনে হয়। দেশটাকে খোলামকুচির মতো হাতে পেলে পুরো ঢাকা শহরটাকেই একটা হামামখানা বানিয়ে দেওয়া যায়, মনে মনে পরিকল্পনা তৈরি করে খোকা।

‘খুব বুঝি দেশোদ্ধার ক’রে বেড়াচ্ছো?’

‘কই আর’

‘কেন, এখন তো সকলের ঐ একই কাজ!’

‘তুমি তো জানোই নীলাভাবী, আমি সকলের দলে পড়ি না’

‘পড়ো ঠিকই, জানতে পারো না! সারা দেশ কিভাবে গজরাচ্ছে!”

রান্নাঘর থেকে সিদ্দিকাভাবীর গলা শোনা গেল, ‘এক গ্লাস শরবত তৈরি ক’রে দাও ওকে’

‘একটু বোসো, চটপট গোছগাছ ক’রে নি, তারপর তোমার শরবত’ খোকা খ’চে উঠলো। বললে, ‘নিকুচি করি তোমার শরবতের, দিনটাই আজ মাঠে মারা গেল। এই এক জঞ্জালে জীব মেয়েলোক! আজ বরং চলি।’

‘একেবারে ঘোড়ায় চ’ড়ে এসেছো দেখছি, ব্যাপার কি?’

‘কোথায় একটু ফ্রি থাকবে, আড্ডা মেরে ঘচাং ক’রে কেটে পড়বো, তা’ নয়, যত্তোসব উড়ো ঝক্কি। চুড়ি বাজিয়ে গোসল করা, শুকনো কাপড় ভাঁজ করা, চুলঝাড়া, রাবিশ রাবিশ!’

নীলাভাবী হেসে বললে, ‘তুমি এসেছো বুঝেই চুড়ি বাজাচ্ছিলাম, কি বুঝলে?’

‘বুঝেছি’

‘কচু বুঝেছো, যা একখানা মাথা তোমার! যাও, আমার ঘরে গিয়ে পাখা ছেড়ে দিয়ে আরাম ক’রে বোসোগে, চটপট সব সেরে আমি এই এলাম ব’লে-”শালার বাড়িটা যেন পাখার একটা জীবন্ত বিজ্ঞাপন- ‘খটটাই মেজাজে বললে খোকা।

নীলাভাবীর ঘরটা এ বাড়ির ভিতর একেবারেই স্বতন্ত্র। কোথাও কোনো খুঁত নেই, পরিপাটি ক’রে সাজানো-গোছানো, চকচকে- তকতকে, সামান্য একটু আঁচড়ও পড়েনি দেয়ালের কোথাও। মনে হয় এই ঘরটার সঙ্গে বক্কে থাকা বাড়িটার কোনো সম্বন্ধ নেই; থাকলেও তা এমনই জটিল এমনই গোলমেলে যে সে সম্পর্ক নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। বরং ঘুরিয়ে বললে বাড়িটাই একটি স্ববিরোধ হ’য়ে যায়।

এ ঘরে অধিষ্ঠান যার, সে যেন সহসা কোনো সুদূর নক্ষত্রালোক থেকে রহস্যময় কারণে পৃথিবীতে আবির্ভূত; কিলবিলে থুকথুকে নোংরা আশ্রয়কে সে স্বপ্নের ভিতরে নিয়ে যায়। বিছানাটা দেখলে বোদলেয়রের সেই ‘প্রবল-মধুর’ আলস্যময় বিড়াল কবিতাগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।

‘ধরো– পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরে নীলাভাবী। বললে, ‘খালি চিনি কিন্তু, ঘরে লেবু নেই–‘

‘নিকুচি করি আমি লেবুর! এবার থেকে টিকিট কেটে দেখা করতে আসবো তোমার সঙ্গে!’

‘এতদিন বিনা টিকিটে আসছিলে, না পাশে?’

‘খচড়ামি রেখে খাওয়াটা সেরে এলেই খুশি হতাম!’

‘তবে কি?’ নীলাভাবী একগাল হেসে বললে, ‘তোমার জন্যে ব’সে

আছি নাকি পেটে পাথর বেঁধে? পুরুষমানুষের গোসল করা আর মেয়েমানুষের খাওয়া–সময় বেশি নিলেই অখ্যাতি। পাঁচ মিনিটের বেশি কখনোই আমার লাগে না!’

 

জীবন আমার বোন (পর্ব-১২)

জীবন আমার বোন (পর্ব-১২)