জীবনকথা
আমার দাদাজানের কাছে শুনিয়াছিলাম, কোনো অপরাধের জন্য বাবুই পাখিদের কে নাকি অভিসম্পাত করিয়াছিল, ‘এত সুন্দর বাসা বানাইলে কি হইবে? এই বাসায় তোরা থাকিতে পারিবি না।’ সেই অভিসম্পাতের জন্য এত যে নৈপুণ্য করিয়া বাবুই পাখিরা বাসা করে কিন্তু সেই বাসায় তাহারা বাস করিতে পারে না। ঝড়ে জলে রৌদ্রে বর্ষায় তাহারা বাসার উপরে বসিয়া থাকে। বাসার ভিতরে ছোট্ট কুঠুরিতে ডিম পাড়ে। দরকারমতো সেই ডিমে তা দেয়। ডিম ফুটিয়া বাচ্চা হইলে এধার ওধার হইতে আহার টুকাইয়া আনিয়া বাচ্চাদের খাওয়ায়।
বাচ্চারা উড়িতে শিখিয়া আর বাসায় থাকে না। মা-বাপের মতো বাসার উপরেই রাত্র যাপন করে। রাত্রে নিজেদের বাসায় আলো করিবার জন্য বাবুই পাখিরা চঞ্চুতে করিয়া একটু গোবর আনিয়া বাসার এক কোণে রাখে। সেই গোবরের গাদায় জোনাকি পোকা ধরিয়া আনিয়া আটকাইয়া দেয়। রাত্র হইলে সেই জোনাকি পোকার আলোকে সমস্ত বাসা আলোকিত হয়। তারই সলখে বাবুই পাখিরা বাসার ভিতরকার ডিম বা বাচ্চাগুলিকে রাতভর পাহারা দেয়। শত্রুর আনাগোনা নিরীক্ষণ করে। রাত্রে যখন বাতাস শোঁ শোঁ করে, বাবুই পাখির বাসায় জোনাকির বাতিগুলি অন্ধকারে ঝিকমিক করে। মনে হয় কে যেন একসঙ্গে অনেকগুলি মণিমাণিক্য লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছে।
এই তালগাছ দুটি বালককালে আমার নিকট অপূর্ব রহস্যে ভরা ছিল। আজ বড় হইয়া সেই রহস্যের দেশ হইতে অনেক দূরে চলিয়া আসিয়াছি। এখনও গ্রামে গেলে কখনও কখনও দেখিতে পাই কোনো রাখাল ছেলে দুগ্ধের কেড়ে হাতে লইয়া একদৃষ্টিতে তালগাছটির দিকে চাহিয়া আছে। বাজারের বেলা চলিয়া যাইতেছে, সেদিকে তাহার খেয়ালও নাই। এই পরিণত বয়সে সেই রাখাল ছেলেটির সঙ্গেই আবার সেই তালগাছটির দিকে চাহিয়া থাকি। হায়, গ্রাম্য রাখাল ছেলের চোখেমুখে এই বৃদ্ধ তালগাছ যে অপূর্ব রহস্যজাল মেলিয়া ধরে তার শতাংশের একাংশেরও ভাগী আমি যদি হইতে
পারিতাম! আমাদের বাড়ির সামনে ছিল একটা নদী। পদ্মা এখান হইতে চর ফেলিতে ফেলিতে চলিয়া যাইবার সময় এই জলরেখার চিহ্ন রাখিয়া গিয়াছিল। একে আমরা বলিতাম মরাগাঙ। এই গাঙে সাঁতার কাটা ছিল আমাদের ছেলেবেলার আর এক আকর্ষণ। বেলা নয়টা দশটা বাজিতেই আমরা দল বাঁধিয়া নদীতে নামিয়া পড়িতাম। গাঁয়ের আর সব ছেলেদের সঙ্গে হৈলডুবি, ঝাপড়ি প্রভৃতি নানা খেলা খেলিতাম। হৈলডুবি খেলা ছিল এইরূপ: একজন দূরে যাইয়া খানিকটা পানি হাতে লইয়া আর-আর সঙ্গীদের জিজ্ঞাসা করিত, আমার হাতে কি? তারা উত্তর করিত, দুধ। তখন সে হাতের পানি মাঝগাঙে ছড়াইয়া দিয়া বলিত, অতদূর যে যাইতে না পারিবে সে খাইবে কুত্তার মুত।
আমরা সকলে যখন সেই অতদূরে সাঁতরাইয়া যাইতাম সে তখন ডুব দিয়া অন্যত্র চলিয়া যাইত। যে তাহাকে সাঁতরাইয়া আগে ধরিতে পারিত তাহারই জিত হইত। সে পরবর্তীকালে পানি ছুড়িবার সুযোগ পাইত। ঝাপড়ি খেলার বেশ সুন্দর একটি ছড়া ছিল। ভালোমতো মনে নাই। আমরা গোল হইয়া একটি ছেলেকে ঘিরিয়া দাঁড়াইতাম। সে একটা কুটা লইয়া সে ঘেরের মাঝখানে ছাড়িয়া দিত। আমরা সকলে মিলিয়া পানি ওলটপালট করিতাম। তারপর সেই কুটাটি যে খুঁজিয়া পাইত তাহারই জিত হইত। পরবর্তী খেলায় সে আমাদের ঘেরের মধ্যে কুটা ছাড়িয়া দেওয়ার অধিকার পাইত।
(চলবে)……..
Leave a Reply