০৭:২৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
সাকিব ও মাশরাফি ছাড়া পারফরম্যান্স, শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজের পর পথ কি? রাষ্ট্রে কখন ও কেন সংখ্যালঘুরা সংগঠিত ধর্ষণের শিকার হয় আরব আমিরাত, মরুভূমি শহরে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মুরাদনগরে সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ: ‘এরপর সরকার ক্ষমতায় থাকার যোগ্য নয়’—জাপা চেয়ারম্যান ইরান ও পাকিস্তান থেকে আফগানদের গণনির্বাসনে উদ্বেগ স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যে নতুন নিষেধাজ্ঞা ভারতের, প্রভাব কেমন হবে ইরানে চীনা বিনিয়োগ অনিশ্চিত, তবু মধ্যপ্রাচ্যের আহ্বান অটুট একজন চীনা আন্টি, ৫টি অ্যাপ, ৬০টি প্রথম ডেট জুলাই যাদুঘরে কি “ মুরাদনগরের দ্রৌপদী” স্থান পাবে? প্রতিদিন একটি রুমাল (পর্ব-২১)

সহজ জীবনের যাকারিয়া

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • 17
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ ও অক্লান্ত গবেষণা করেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (১ অক্টোবর ১৯১৮-২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। বেঁচে থাকতে আটানব্বই বছর বয়সেও তাঁর স্মৃতিশক্তি এবং কর্মক্ষমতা অনেকের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ নামে তাঁর লেখা গবেষণাধর্মী বইটিকে এ বিষয়ে একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি (দুই খণ্ড), নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস, কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, প্রশ্নোত্তরে বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি (দুই খণ্ড)-সহ আরো অনেক মূল্যবান বই লেখার পাশাপাশি ফারসি ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছেন তবকাত-ই-নাসিরি, তারিখ-ই-বঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙ্গী, মোযাফফর নামা, সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন ইত্যাদি।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে অবিভক্ত বাংলার প্রতিযোগিতামূলক বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে সে সময়ের অতি দুর্লভ সরকারি চাকরিতে যোগ দেন ইনডিয়া ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসর নেন ১৯৭৬ সালে। প্রশাসনিক কাজের বাইরে তিনি তাঁর পুরো জীবন উৎসর্গ করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নসম্পদ অন্বেষণে। বর্তমান সময়ে আলোচিত উয়ারী বটেশ্বর প্রতœস্থানটির বিষয়ে স্থানীয় গবেষক হানীফ পাঠানকে সহযোগিতা করা এবং দেশের ইতিহাসবিদদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রথম উদ্যোগ নেন তিনি। সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারসহ অসংখ্য প্র ত্বস্থান তিনি অবিষ্কার এবং খননের ব্যবস্থা করেছেন। দিনাজপুর জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত। ইতিহাস চর্চার পাশাপাশি প্রাচীন সাহিত্য নিয়ে গবেষণা এবং কবিতা ও উপন্যাস লেখেন তিনি। লেখালেখির বাইরে এখন তিনি সময় কাটান বাগান করে। ১ অক্টোবর তার ১০৬তম জন্মদিন। ৯৮ বছরের কর্মময় জীবন কাটানোর রহস্য তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সহজ ভাষায় তিনি বলেছিলেন সেই সিক্রেটস।
দীর্ঘজীবন প্রাপ্তিতে খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে সহজাত হাসি হেসে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, ‘আমার জীবনে কোনো বদ অভ্যাস নেই। মাংস সবসময়ই কম খাই। মাছ ও সবজি বেশি খাই। আমি স্বল্পাহারি। এক সময় সিগারেট পাইপ খেতাম। ১৯৮৭ সালে ছেড়ে দিই। আর ধরিনি। ১৯৫৮ সালে শেষ বারের মতো চা খাই। কফি সারা জীবনে একবার খেয়েছি। সারাদিনে খাবারের তালিকায় আছে অল্প ভাত, দুটো পাতলা রুটি। একটি ডিম। সবজি। সারাজীবনে কখনো মদ খাইনি। তবে বাগান থেকে কাজ শেষ করে দুটো বিসকিট দিয়ে হরলিক্স খেয়ে থাকি। এটা মানসিক কারণেই।’
এই দীর্ঘজীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে আসতে হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন জানতে চাইলে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, ‘আমার ব্যক্তি জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট এসেছে। আমি যে নীতিটি মেনে চলি তা হলো যতোটা সম্ভব সহজভাবে বিষয়টি গ্রহণ করতে। যে জিনিসের প্রতিকার নেই তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে কোনো সমাধান আসবে না। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ পেয়েছি আমার ছোট ছেলে মাশফিকের মৃত্যুতে। যতো বড় দুঃখ আসুক চেষ্টা করতে হবে তাকে এড়িয়ে যেতে। এমনও দিন গিয়েছে আমার দিন রাত ঘুম হয়নি। কিন্তু তারপর চেষ্টা করেছি তা কাটিয়ে উঠতে। কারণ এটা সম্ভব না হলে জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে উঠবে। কোনো কিছুকেই অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। যতোটা সম্ভব ভুলে থাকা এবং ক্ষমা করে দেয়ার চেষ্টা করা। ক্ষমা করাটা কঠিন। প্রতিশোধ নেয়া যতো সহজ, ক্ষমা করা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি কঠিন। কিন্তু এটার চেষ্টা করা প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন পরচর্চা বা পরনিন্দা থেকে দূরে সরে থাকতে। কারণ মানুষ হিসাবে আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে। আমাদের চেষ্টা করা উচিত সেই দায়িত্ব পালন করা। মানুষের নিন্দা না করে, সুযোগ পেলে প্রশংসা করা প্রয়োজন। অনেক অপ্রিয় বিষয় এড়িয়ে যেতে হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘মানুষের প্রতি সিনসিয়ার হওয়া প্রয়োজন। মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো চরিত্র। টাকা, সম্পদের চেয়েও এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্র বললে শুধু এক দুটি বিষয় নিয়ে নয়। মানবিক গুণাবলীকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। মানুষ হিসাবে মানুষকে ভালোবাসার সদিচ্ছা থাকতে হবে। ক্ষমতা হয়তো সব সময় থাকে না। তবুও হিংসা, বিদ্বেষ বাদ দিয়ে যতোটা সম্ভব মানুষকে ভালোবাসার চেষ্টা করতে হবে।’
প্রতিদিনের রুটিন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনের রুটিন একই। আমি একটু দেরিতে উঠি। প্রথমে খবরের কাগজ পড়ে নাস্তা করি। দুপুরে গোসলের আগে পনের বিশ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করি। এটা আমি প্রতিদিন করি, যদি না কোনো বড় অসুখ থাকে। দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাগানে যাই। সেখানে দেড় দুই ঘণ্টা কাজ করি। তারপর লেখালেখি করি। আগে সারা রাত কাজ করতাম। এখন অতোটা পারি না। রাত একটার মধ্যে শুয়ে পড়ি।’
কলাবাগানের লেক সার্কাসে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার পুরানো তিন তলা বাড়ির পুরো ছাদ জুড়ে বিশাল বাগান ছিল। বাড়িটি সময়ের প্রয়োজনে তার সন্তানেরা ডেভেলপারকে দিয়ে বহুতল বিল্ডিং করেছেন। পুরানো বাড়ির ছাদে অনেক ধরনের গাছ ছিল। নিয়ম করে গাছ লাগানো এবং তার পরিচর্যা করতেন তিনি নিজে। তার বাগানে আছে পেয়ারা, পেঁপে, বাতাবি লেবু, বড়ই, তাল, কলা, করমচা, বেল, আনারস, আমসহ বিভিন্ন ধরনের অনেক ফলগাছ। সবজির মধ্যে আছে লেবু, করল্লা, লাউ, বেগুন, বরবটি, টমাটোসহ অনেক ধরনের শবজি। থানকুনি পাতা, তুলসি পাতা, পুদিনা পাতাসহ আরো অনেক প্রয়োজনীয় গাছ আছে। সারা বাগান জুড়ে আছে অসংখ্য ফুলের গাছ।
বাগান নিয়ে কর্মসূচি কী তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শীতের সবজি করবো। ব্রুকলি এবং ক্যাপসিকামের ওপর জোর দেবো। লাউ গাছ লাগিয়েছি এরই মধ্যে। ফুলের মধ্যে ক্রিসেন থেমাম লাগাবো। টমেটো করবো। বেগুন করে ফেলেছি। আরো শীতের সবজি করবো।’
বই পড়া এবং গান শোনার প্রতি তার সবসমই আগ্রহ ছিল। তার কাজের রুমটি ভরে ছিল দুর্লভ বইয়ে। শেলফে, খাটে সব খানেই বই। তিনি বলেন, ‘বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ছেলেবেলা থেকেই। নিজের চেষ্টায় পড়ার চেষ্টা করেছি। কারণ শিক্ষকদের অনেকের মধ্যেও সীমাবদ্ধতা ছিল। পরবর্তী সময়ে যতোবার বিদেশ গিয়েছি প্রচুর বই কিনে এনেছি।’
গান তার খুবই প্রিয়। তিনি বলেন, ‘গানের মধ্যে রবীন্দ্র সঙ্গীত, ক্লাসিকাল মিউজিক ও পল্লীগীতি আমার পছন্দ। রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনেক গান আমার মুখস্থ। কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পংকজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান আমার বেশি পছন্দ। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন, ‘এই করেছো ভালো নিঠুর’ ইত্যাদি গান খুবই প্রিয়। পল্লীগীতির ক্ষেত্রে আব্বাসউদ্দীনের গান আমার খুব প্রিয়। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। আমার প্রচুর লংপ্লে রেকর্ড ছিল। আমেরিকা থেকে রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে এসেছিলাম। গান শুনে শুয়ে শুয়ে লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি। আমার ছোটবেলা থেকেই এভাবে পড়ছি এবং লিখছি। এটা কাউকে দেখে শেখা নয়। এখন মাঝে মাঝে টিভি অনুষ্ঠান দেখি। এটা অনেকটা রিলিফ দেয়।’
নতুনদের প্রতি কী উপদেশ দেবেন এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সাফল্যের জন্য কোনো শর্টকার্ট পথ নেই। পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। আমার অধিকাংশ বইই কমপক্ষে তিনবার করে লেখা।’
নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে বললে তিনি বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘যতোক্ষণ সময় পাই ততোক্ষণ লিখি। আমার পক্ষে যতোদিন সম্ভব কাজ করে যাবো। আমি মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও কাজ করতে চাই।’
দেশ নিয়ে আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের দুর্দিন নিশ্চয়ই কেটে যাবে। এখন কঠিন সময় যাচ্ছে। তবে মূল্যবোধ ফিরে আসবে। সুন্দর দিনের স্বপ্ন দেখি আমি।’
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক।

সাকিব ও মাশরাফি ছাড়া পারফরম্যান্স, শ্রীলঙ্কা টেস্ট সিরিজের পর পথ কি?

সহজ জীবনের যাকারিয়া

০৮:০০:২২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪
মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ ও অক্লান্ত গবেষণা করেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া (১ অক্টোবর ১৯১৮-২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। বেঁচে থাকতে আটানব্বই বছর বয়সেও তাঁর স্মৃতিশক্তি এবং কর্মক্ষমতা অনেকের কাছে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ নামে তাঁর লেখা গবেষণাধর্মী বইটিকে এ বিষয়ে একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি (দুই খণ্ড), নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস, কুমিল্লা জেলার ইতিহাস, প্রশ্নোত্তরে বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তি (দুই খণ্ড)-সহ আরো অনেক মূল্যবান বই লেখার পাশাপাশি ফারসি ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করেছেন তবকাত-ই-নাসিরি, তারিখ-ই-বঙ্গালা-ই-মহব্বত জঙ্গী, মোযাফফর নামা, সিয়ার-উল-মুতাখখিরিন ইত্যাদি।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির একজন মেধাবী ছাত্র হিসাবে অবিভক্ত বাংলার প্রতিযোগিতামূলক বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস বা বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে সে সময়ের অতি দুর্লভ সরকারি চাকরিতে যোগ দেন ইনডিয়া ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার সময়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অবসর নেন ১৯৭৬ সালে। প্রশাসনিক কাজের বাইরে তিনি তাঁর পুরো জীবন উৎসর্গ করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নসম্পদ অন্বেষণে। বর্তমান সময়ে আলোচিত উয়ারী বটেশ্বর প্রতœস্থানটির বিষয়ে স্থানীয় গবেষক হানীফ পাঠানকে সহযোগিতা করা এবং দেশের ইতিহাসবিদদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রথম উদ্যোগ নেন তিনি। সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারসহ অসংখ্য প্র ত্বস্থান তিনি অবিষ্কার এবং খননের ব্যবস্থা করেছেন। দিনাজপুর জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত। ইতিহাস চর্চার পাশাপাশি প্রাচীন সাহিত্য নিয়ে গবেষণা এবং কবিতা ও উপন্যাস লেখেন তিনি। লেখালেখির বাইরে এখন তিনি সময় কাটান বাগান করে। ১ অক্টোবর তার ১০৬তম জন্মদিন। ৯৮ বছরের কর্মময় জীবন কাটানোর রহস্য তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সহজ ভাষায় তিনি বলেছিলেন সেই সিক্রেটস।
দীর্ঘজীবন প্রাপ্তিতে খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত জানতে চাইলে সহজাত হাসি হেসে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, ‘আমার জীবনে কোনো বদ অভ্যাস নেই। মাংস সবসময়ই কম খাই। মাছ ও সবজি বেশি খাই। আমি স্বল্পাহারি। এক সময় সিগারেট পাইপ খেতাম। ১৯৮৭ সালে ছেড়ে দিই। আর ধরিনি। ১৯৫৮ সালে শেষ বারের মতো চা খাই। কফি সারা জীবনে একবার খেয়েছি। সারাদিনে খাবারের তালিকায় আছে অল্প ভাত, দুটো পাতলা রুটি। একটি ডিম। সবজি। সারাজীবনে কখনো মদ খাইনি। তবে বাগান থেকে কাজ শেষ করে দুটো বিসকিট দিয়ে হরলিক্স খেয়ে থাকি। এটা মানসিক কারণেই।’
এই দীর্ঘজীবনে অনেক ঘাত প্রতিঘাত পার হয়ে আসতে হয়েছে। এই বিষয়গুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন জানতে চাইলে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেন, ‘আমার ব্যক্তি জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট এসেছে। আমি যে নীতিটি মেনে চলি তা হলো যতোটা সম্ভব সহজভাবে বিষয়টি গ্রহণ করতে। যে জিনিসের প্রতিকার নেই তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে কোনো সমাধান আসবে না। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ পেয়েছি আমার ছোট ছেলে মাশফিকের মৃত্যুতে। যতো বড় দুঃখ আসুক চেষ্টা করতে হবে তাকে এড়িয়ে যেতে। এমনও দিন গিয়েছে আমার দিন রাত ঘুম হয়নি। কিন্তু তারপর চেষ্টা করেছি তা কাটিয়ে উঠতে। কারণ এটা সম্ভব না হলে জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে উঠবে। কোনো কিছুকেই অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। যতোটা সম্ভব ভুলে থাকা এবং ক্ষমা করে দেয়ার চেষ্টা করা। ক্ষমা করাটা কঠিন। প্রতিশোধ নেয়া যতো সহজ, ক্ষমা করা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি কঠিন। কিন্তু এটার চেষ্টা করা প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন পরচর্চা বা পরনিন্দা থেকে দূরে সরে থাকতে। কারণ মানুষ হিসাবে আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে। আমাদের চেষ্টা করা উচিত সেই দায়িত্ব পালন করা। মানুষের নিন্দা না করে, সুযোগ পেলে প্রশংসা করা প্রয়োজন। অনেক অপ্রিয় বিষয় এড়িয়ে যেতে হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘মানুষের প্রতি সিনসিয়ার হওয়া প্রয়োজন। মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো চরিত্র। টাকা, সম্পদের চেয়েও এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্র বললে শুধু এক দুটি বিষয় নিয়ে নয়। মানবিক গুণাবলীকে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। মানুষ হিসাবে মানুষকে ভালোবাসার সদিচ্ছা থাকতে হবে। ক্ষমতা হয়তো সব সময় থাকে না। তবুও হিংসা, বিদ্বেষ বাদ দিয়ে যতোটা সম্ভব মানুষকে ভালোবাসার চেষ্টা করতে হবে।’
প্রতিদিনের রুটিন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনের রুটিন একই। আমি একটু দেরিতে উঠি। প্রথমে খবরের কাগজ পড়ে নাস্তা করি। দুপুরে গোসলের আগে পনের বিশ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করি। এটা আমি প্রতিদিন করি, যদি না কোনো বড় অসুখ থাকে। দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাগানে যাই। সেখানে দেড় দুই ঘণ্টা কাজ করি। তারপর লেখালেখি করি। আগে সারা রাত কাজ করতাম। এখন অতোটা পারি না। রাত একটার মধ্যে শুয়ে পড়ি।’
কলাবাগানের লেক সার্কাসে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার পুরানো তিন তলা বাড়ির পুরো ছাদ জুড়ে বিশাল বাগান ছিল। বাড়িটি সময়ের প্রয়োজনে তার সন্তানেরা ডেভেলপারকে দিয়ে বহুতল বিল্ডিং করেছেন। পুরানো বাড়ির ছাদে অনেক ধরনের গাছ ছিল। নিয়ম করে গাছ লাগানো এবং তার পরিচর্যা করতেন তিনি নিজে। তার বাগানে আছে পেয়ারা, পেঁপে, বাতাবি লেবু, বড়ই, তাল, কলা, করমচা, বেল, আনারস, আমসহ বিভিন্ন ধরনের অনেক ফলগাছ। সবজির মধ্যে আছে লেবু, করল্লা, লাউ, বেগুন, বরবটি, টমাটোসহ অনেক ধরনের শবজি। থানকুনি পাতা, তুলসি পাতা, পুদিনা পাতাসহ আরো অনেক প্রয়োজনীয় গাছ আছে। সারা বাগান জুড়ে আছে অসংখ্য ফুলের গাছ।
বাগান নিয়ে কর্মসূচি কী তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শীতের সবজি করবো। ব্রুকলি এবং ক্যাপসিকামের ওপর জোর দেবো। লাউ গাছ লাগিয়েছি এরই মধ্যে। ফুলের মধ্যে ক্রিসেন থেমাম লাগাবো। টমেটো করবো। বেগুন করে ফেলেছি। আরো শীতের সবজি করবো।’
বই পড়া এবং গান শোনার প্রতি তার সবসমই আগ্রহ ছিল। তার কাজের রুমটি ভরে ছিল দুর্লভ বইয়ে। শেলফে, খাটে সব খানেই বই। তিনি বলেন, ‘বই পড়ার প্রতি আগ্রহ ছেলেবেলা থেকেই। নিজের চেষ্টায় পড়ার চেষ্টা করেছি। কারণ শিক্ষকদের অনেকের মধ্যেও সীমাবদ্ধতা ছিল। পরবর্তী সময়ে যতোবার বিদেশ গিয়েছি প্রচুর বই কিনে এনেছি।’
গান তার খুবই প্রিয়। তিনি বলেন, ‘গানের মধ্যে রবীন্দ্র সঙ্গীত, ক্লাসিকাল মিউজিক ও পল্লীগীতি আমার পছন্দ। রবীন্দ্র সঙ্গীতের অনেক গান আমার মুখস্থ। কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পংকজ মল্লিক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রিজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গান আমার বেশি পছন্দ। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন, ‘এই করেছো ভালো নিঠুর’ ইত্যাদি গান খুবই প্রিয়। পল্লীগীতির ক্ষেত্রে আব্বাসউদ্দীনের গান আমার খুব প্রিয়। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। আমার প্রচুর লংপ্লে রেকর্ড ছিল। আমেরিকা থেকে রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে এসেছিলাম। গান শুনে শুয়ে শুয়ে লিখতে এবং পড়তে পছন্দ করি। আমার ছোটবেলা থেকেই এভাবে পড়ছি এবং লিখছি। এটা কাউকে দেখে শেখা নয়। এখন মাঝে মাঝে টিভি অনুষ্ঠান দেখি। এটা অনেকটা রিলিফ দেয়।’
নতুনদের প্রতি কী উপদেশ দেবেন এই প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘সাফল্যের জন্য কোনো শর্টকার্ট পথ নেই। পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। আমার অধিকাংশ বইই কমপক্ষে তিনবার করে লেখা।’
নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে বললে তিনি বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘যতোক্ষণ সময় পাই ততোক্ষণ লিখি। আমার পক্ষে যতোদিন সম্ভব কাজ করে যাবো। আমি মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও কাজ করতে চাই।’
দেশ নিয়ে আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের দুর্দিন নিশ্চয়ই কেটে যাবে। এখন কঠিন সময় যাচ্ছে। তবে মূল্যবোধ ফিরে আসবে। সুন্দর দিনের স্বপ্ন দেখি আমি।’
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক।