মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, বিশ্বতত্ত্ববিদ, জ্যোর্তিবিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদ ড. জামাল নজরুল ইসলাম (১৯৩৯-২০১৩) জন্মেছেন ঝিনাইদহ জেলায়। সে সময় তার বাবা খান মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন ঝিনাইদহের মুন্সেফ। তাদের বাড়ি চট্টগ্রাম। তার মা কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক রাহাত আরা বেগম। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকের উর্দু অনুবাদ করেন। রাহাত আরার কাজিন ছিলেন সাহিত্যিক ও রবীন্দ্র গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুব। মাত্র দশ বছর বয়সে মাকে হারান জামাল নজরুল ইসলাম। তার এক ভাই কামাল জিয়াউল ইসলাম যিনি কে. জেড ইসলাম নামে পরিচিত ছিলেন, তার উদ্যোগে আয়োজিত হয় ‘নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট প্রতিযোগিতা’। বাংলাদেশ জাতীয় দলের অনেক খেলোয়াড়ের সৃষ্টি হয়েছিল এই আয়োজনের মাধ্যমে।
জামাল নজরুল ইসলামের পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল পার্টিক্যাল ফিজিক্স বা মৌলিক কণার ওপর। ছাত্র অবস্থায় তিনি ‘ফেইনম্যান ডায়াগ্রাম’ নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি যখন ক্যামব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ে ফ্লুইড ডাইনামিকস বা তরল গতিবিদ্যা নিয়ে কাজ করেন তখন তার সাথে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর পরিচয় ঘটে। যা পরে পারিবারিক বন্ধুত্বে পরিণত হয়। দু’জনের সন্তানেরা এক সাথে খেলাধূলা করতেন। জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে স্টিফেন হকিং বলেন, ‘জে. এন ইসলাম আমার রুমমেট, বন্ধু এবং আমরা একে অপরের শিক্ষক ছিলাম।’
মহাবিশ্বের ভবিষ্যত কী হবে, কী হবে চূড়ান্ত পরিণতি এবং কখন ও কীভাবে এই পরিণতি ঘটবে- এ বিষয়ে গবেষণা করেন জামাল নজরুল ইসলাম। ১৯৮৩ সালে তার যুগান্তকারী বই ‘দি আলটিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স প্রকাশ করে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। তার গবেষণার ফল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, অবস্থান, বিন্যাস এবং পরিণতি নিয়ে অতীতের অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীর ভাবনা ও গবেষণাকে বদলে দেয়। বইটি প্রকাশের পরপরই তা জাপানিজ, ফরাসি, রুশ, চায়নিজ, হিব্রু, পর্তুগিজসহ ত্রিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়। এই বইটি ক্যামব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, প্রিন্সটনসহ পৃথিবীর প্রভাবশালী শতাধিক বিশবিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়।
তিনি যে সময় এই গবেষণায় মনোযোগী হন তখন স্টিফেন হকিং, জয়ন্ত নারলিকর-এর মতো কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ বিজ্ঞানীই আর্থিক প্রাপ্তি তেমন না থাকায় মহাকাশ গবেষণায় আগ্রহী ছিলেন না। জামাল নজরুল ইসলামের ‘দি আলটিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স বইটি প্রকাশের পাঁচ বছর পর ১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিং প্রকাশ করেন তার আলোচিত বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’। এই বইয়ের ওপর জামাল নজরুল ইসলামের বইয়ের প্রভাব ছিল। স্টিফেন হকিং দেখিয়েছেন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের শুরু আর জামাল নজরুল ইসলাম তার আগেই দেখিয়েছেন কীভবে শেষ তা। দুই বন্ধু মিলে একটি সার্কল পূরণ করেন। স্টিফেন হকিংয়ের মতো বিজ্ঞানীরা শুধু নন, অনেক জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখকও জামাল নজরুল ইসলামের বই পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। জামাল নজরুল ইসলামের আরো ছয়টি বই ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়; ‘ব্রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’, ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিকাল কসমোলজি’, ‘ক্লাসিকাল জেনারেল রিলেটিভিটি’, ‘দি ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স, ‘স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ’ এবং তার ১৭ বছরের গবেষণার ফল ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিকাল ইকোনমিক্স অ্যান্ড সোশাল চয়েস’। অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে ‘কনফাইনমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিংগার ইকুয়েশন ফর গাউস থিওরিস। তিনি মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে উৎসাহিত করতেন। তার লেখা বাংলা বই ‘কৃষ্ণবিবর’, ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ’, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ’ এবং ‘সমাজ দর্শন বিজ্ঞান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’।
জামাল নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তার কাছের মানুষেরা ‘দেশপ্রেমিক, মানবদরদী, পরোপকারী, সমাজসেবক, ছড়াকার, চিত্রশিল্পী, আবৃত্তিকার, বাগ্মী, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগঠক’-সহ নানা পরিচয়ে পরিচিত করেন। তিনি পিয়ানো এবং সেতার বাজাতে পারতেন। ক্যামব্রিজে তিনি তার শিক্ষক ও সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন বিশ্ববরেণ্য অসংখ্য বিজ্ঞানীকে যাদের অনেকেই নোবেলজয়ী। বিজ্ঞানী আবদুস সালাম, জন টেইলর, ওয়েনবার্গ, জোসেফসন, ফ্রিম্যান ডাইসন, রিচার্ড ফাইনম্যান, এস চন্দ্রশেখর, অমর্ত্য সেন, অমিয় বাগচী, জয়ন্ত নরলিকর, জিম মার্লিস, স্টিফেন হকিং, গ্যাভিন রেইথ, রজার পেনরোজ, জ্যা আন্দুজ, মার্টিন রিজ, ঝ্যাজ ওয়ান, লুইস জনসন, সুসানা ইয়োগানা, মাসাহিতো-সহ আরো অনেকের নাম আছে এই তালিকায়। তিনি তাদের কাছে এতো বেশি প্রিয় ছিলেন যে তার পিএইচডি সুপারভাইজার গণিতবিদ জন টেইলর ক্যামব্রিজে নিজের বাসা বদল করে জামাল নজরুল ইসলামের বাসার কাছে চলে আসেন ছাত্রের পড়াশোনার সুবিধার জন্য।
নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে আসেন। তিনি চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে আশা প্রকাশ করেন যে, এশিয়ায় পদার্থবিজ্ঞানে তার পরে কেউ যদি নোবেল পুরষ্কার পান তবে তা পাবেন জামাল নজরুল ইসলাম। একথা তিনি বাংলাদেশে প্রকাশ্যে তিনবার বলেছেন। আরেক নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘জামাল লন্ডনে থেকে গেলে নিশ্চিত নোবেল পুরষ্কার পেতেন।’
আশির দশকের শুরুতেই জামাল নজরুল ইসলাম সোয়া লাখ টাকার সমপরিমাণ বৃটিশ পাউন্ড মাসিক বেতন পেতেন। তখন তার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সময়। চারদিকে প্রিয় ও যোগ্য ব্যক্তির মাঝে সম্মানজনক জীবন। সম্ভাব্য নোবেলজয়ীর তালিকায় তার নাম অগ্রগণ্য। এমন সময়ে সব ফেলে জামাল নজরুল ইসলাম দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে এক বছর কাজ করেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে। মাঝে কিছুটা বিরতি দিয়ে আবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগ দেন মাসিক মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনে! বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তের কথা জেনে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তাকে বলেছিলেন, ‘ইসলাম, তুমি ক্যামব্রিজেই থেকে যাও। এখানে থেকেও দেশের জন্য কাজ করা যাবে। দেশে গিয়ে তুমি কিছু করতে পারবে কিনা জানি না তবে বিশ^ তোমার মতো প্রতিভাবানের বিস্ময়কর অনেক আবিষ্কার থেকে বঞ্চিত হবে।’
জবাবে বিনয়ী জামাল নজরুল ইসলাম বন্ধুকে বলেছিলেন,’দেশে গিয়ে আমি তিন হাজার বিজ্ঞানী তৈরি করবো। এই তিন হাজার বিজ্ঞানী পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারবে। তখন বাংলাদেশও হয়ে উঠবে শ্রেষ্ঠ দেশ।’
ড. জামাল নজরুল ইসলাম দেশে বিদেশে শিক্ষার্থীদের কাছে খুবই প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তিনি অনেক এমফিল ও পিএইচডি শিক্ষার্থীর সুপারভাইজার ছিলেন। দেশে একদল দক্ষ ও যোগ্য বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ তৈরির আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করেন ‘রিচার্স সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল অ্যান্ড ফিজিকাল সায়েন্স’। দিনরাত পরিশ্রম করেন তিনি সেন্টারটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি চেয়েছিলেন বিদেশি ফান্ড না এনে স্থানীয় পর্যায়ে তার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সাড়া পেয়েছেন খুব কম। এতে তিনি দমে যান নি। আমৃত্যু কাজ করে গিয়েছেন শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়নে। মহাকাশ গবেষণার জন্য লন্ডনের মানের একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও তার ছিল। তিনি স্বপ্নগুলোর সূচনা করে গিয়েছেন। পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব হবে সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়া। এই অনন্য বিজ্ঞানী সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায় করে বিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন বলেন, বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই জামাল নজরুলের প্রতি আমার অসম্ভব শ্রদ্ধা। কতো সহজেই তিনি আমেরিকা বা ইওরোপে একটা বৈজ্ঞানিক ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারতেন। অথচ তিনি ফিরে গেলেন জন্মভূমিতে।’
এই জন্মভূমিতেই ড. জামাল নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন ১৬ মার্চ ২০১৩ সালে। তার ‘দি আলটিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘অন্ধকারের প্রাণীদের কাছে দিনের আলোকে যেমন সহনীয় মনে হবে না, তেমনি সুদূর ভবিষ্যতের অতি শীতল মহাবিশ্বের অজানা প্রাণীদের জন্য আমাদের উষ্ণ মহাবিশ্বে সহনীয় মনে হবে না। কিন্তু তবুও, তাদের মধ্যে এমন কয়েকজন থাকবে, যাদের কল্পনাশক্তি প্রখর। তারা অতীতের দিকে, আমাদের মহাবিশ্বের দিকে তাকাবে। দেখবে সূর্যকরোজ্জাল একটা গ্রহ। যেখানে কয়েক কোটি বছরের শক্তি প্রবাহ নিশ্চিত। তারা ভাববে সেই পৃথিবী ছিল এক স্বপ্নীল জগৎ।’