০৪:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

ডায়াবেটিস মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি অপরিহার্য

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০৩:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 17

চ্যাংহং লি

স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বা নতুন ওষুধ গবেষণার জন্য অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রায়ই উপেক্ষিত হলেও ডায়াবেটিস আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এটি সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করছে এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে বটেতবে রোগটির জটিলতা সত্যিকার অর্থে মোকাবিলা করতে এবং এই বৈশ্বিক মহামারিকে দমিয়ে রাখতে পদ্ধতিগত একটি মৌলিক পরিবর্তন দরকার।

এশিয়ায় ডায়াবেটিসের অবস্থা এখন একটি সংকটময় পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। নগরায়ণবসন্তে জীবনযাপনপ্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি নির্ভরতাকম খরচে সহজলভ্য চিনি ও ক্রমবর্ধমান খাবারের পরিমাণএগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য। সব মিলিয়ে এখানে ডায়াবেটিসের প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। আমরা শারীরিক পরিশ্রম আর প্রাকৃতিক খাবারের বদলে অফিসকেন্দ্রিক জীবনযাপন ও চিনিযুক্ত এনার্জি ড্রিংক বেছে নিয়েছি। মূলত শরীরের সঙ্গে খাদ্যের সম্পর্কজনিত ভারসাম্যহীনতাই ডায়াবেটিসের অন্যতম চালিকাশক্তি।

বর্তমানে এশিয়ায় আনুমানিক ২৩ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্তযা বৈশ্বিক ডায়াবেটিস-রোগীর প্রায় ৪০%। চীন ও ভারতে ডায়াবেটিসের হার নজিরবিহীনভাবে বেড়ে চলেছেএবং বিপুলসংখ্যক রোগী এখনো চিকিতসার বাইরে থেকে যাচ্ছে বা পর্যাপ্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছেন। এত বিপুলসংখ্যক রোগী সামাল দেওয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।

তবে এসব দেশ চিকিৎসাবিজ্ঞানে উদ্ভাবনেরও কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেবিশেষত চীনে ভবিষ্যতপন্থী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

প্রথাগতভাবে ডায়াবেটিস চিকিৎসার মূল লক্ষ্য ছিল উপসর্গ নিয়ন্ত্রণঔষধখাদ্য ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে রোগের মূল কারণগুলো সমাধান হয় না। আনুমানিক হিসেবে দেখা যায়ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মাত্র ৪০% মানুষ যথাযথভাবে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে মাত্র ৪ জন সুস্থ মাত্রায় শর্করা রাখতে সক্ষম।

ফলে একেবারে নতুন ধরনের একটি দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি হয়ে পড়েছেযেখানে প্রতিটি ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে চিকিৎসা পরিকল্পনা করা হবে।

ডায়াবেটিস মোকাবিলার একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ে হস্তক্ষেপপ্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বাধুনিক গবেষণা ও প্রযুক্তিকে রোগীকেন্দ্রিক পদ্ধতির সঙ্গে একীভূত করা। এশিয়ায় যেখানে স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো দেশভেদে ভীষণ বৈচিত্র্যময়সেখানে এই ধরনের কৌশল বাস্তবায়ন করা নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জআবার অত্যন্ত জরুরিও বটে।

চিকিৎসা ও গবেষণা খাতে নতুন প্রযুক্তিগত অগ্রগতিবিশেষত সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতিএশিয়াজুড়ে অনন্য জিনগত ও পরিবেশগত কারণজনিত নানা রকম ডায়াবেটিসের উৎস চিহ্নিত ও মোকাবিলা করতে আশার আলো দেখায়। তবে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করতে গবেষণায় ব্যাপক বিনিয়োগশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজনযাতে রোগীদের জন্য আরো কার্যকর ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসার সুযোগ তৈরি হয়।

বর্তমান পদ্ধতিতে প্রায় সবার ক্ষেত্রেই একই ওষুধ পুনরাবৃত্তি করে দেওয়া হয়জিনগত ভিন্নতা বা কার কী কারণে ডায়াবেটিস হয়েছে তা খুব একটা বিবেচনা করা হয় না। অথচ একজনের ডায়াবেটিসের অন্তর্নিহিত কারণ অন্যজনের থেকে ভিন্ন হতে পারে।

ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও পরিচর্যায় সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতির (প্রেসিশন মেডিসিন) ব্যবহার বাড়লে খুবই ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে। জি এল পি – ১ (GLP-1) সম্পর্কিত ওষুধের ব্যাপক ব্যবহারের প্রবণতা এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। যদিও ওজেম্পিক (সেমাগ্লুটাইড) বা ভিক্টোজা (লিরাগ্লুটাইড)-এর মতো জি এল পি – ১ ওষুধ এখন মোটা শরীরের ওজন কমানোর জন্যই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছেতবু এগুলো ডায়াবেটিস চিকিৎসায়ও খুবই কার্যকর।

শুধু জি এল পি – ১ ওষুধের ব্যবহারে ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়িয়ে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে এগুলোকে এমন ওষুধের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারেযেগুলো দেহের গ্লুকোজ-সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং খাবার গ্রহণের পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইনসুলিন নিঃসরণকে সহায়তা করে। এতে শরীরে শর্করার মাত্রা অনেক বেশি ভারসাম্যমূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপঅনেকের ডায়াবেটিস গ্লুকোকিনেজ (জি.কে.) নামের একটি উৎসেচকের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার কারণে হয়। গ্লুকোকিনেজ দেহের অভ্যন্তরীণ গ্লুকোজ সেন্সর” হিসেবে কাজ করে এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেএটি শর্করাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। জিনগত ভিন্নতার কারণে অনেকের মধ্যে গ্লুকোকিনেজের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। এই কারণগুলো মাথায় রেখে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতিই এই ধরনের পার্থক্যগুলোকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে।

এজন্য অবশ্যই আরো গবেষণাক্লিনিক্যাল ও বাস্তব-জীবনের তথ্য বিশ্লেষণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবেস্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকারযাতে প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের কারণ বোঝা যায়।

এই লক্ষ্য অর্জনে অন্তত তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ পেরোতে হবে।

প্রথমতরোগীর প্রয়োজন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতার মধ্যে বড় ফারাক রয়েছে। এশিয়ায় ডায়াবেটিসের বিপুলসংখ্যক রোগী থাকায় স্বাভাবিকভাবেই সবার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী নেই। আবার ব্যক্তিভিত্তিক বিশদ বিশ্লেষণ করতে খরচ ও সময়উভয়ই বেশি লাগে। তবে ডায়ালাইসিসের মতো আজীবনের ব্যয়বহুল বিকল্প চিকিৎসার তুলনায় এটি এখনো সাশ্রয়ী।

দ্বিতীয়তরাজনৈতিক বাধা রয়েছে। সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা মূলত ব্যক্তিগত জিনগত তথ্যের ওপর নির্ভর করেযা অনেক দেশেই জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

তৃতীয়তবাজারের বাস্তবতা। ওষুধ কোম্পানিগুলো চায় তাদের ওষুধ যতবেশি সম্ভব ব্যবহৃত হোক। অন্য কোম্পানির ওষুধের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করলে বাজার ভাগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আসলে বাজার বিশালতাই এটি হয়তো অতটা বড় সমস্যাও নয়কিন্তু প্রতিযোগিতা যে আছেতা অস্বীকার করা যায় না।

তারপরও ডায়াবেটিস চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতির প্রসার ঘটলে ভবিষ্যতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে।

ডায়াবেটিস চিকিৎসার ভবিষ্যৎ সুনির্দিষ্ট চিকিৎসায় নিহিত। নতুন ওষুধ নিয়ে আলোচনার জোরসম্ভাব্য যুগপৎ চিকিৎসা-পদ্ধতিনতুন গবেষণা এবং ডায়াবেটিসজনিত চাপে জর্জরিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে এমন একটি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।

ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় এই পদ্ধতিগত পরিবর্তন এখন হাতের নাগালেই। তবে তার জন্য চাই ব্যাপকভিত্তিকপূর্ণাঙ্গ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এতে ডায়াবেটিস রোগীদের জীবনমান যেমন উন্নত হবেতেমনি স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়ও কমবে। ফলে রোগী ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাউভয়ই উপকৃত হবে।

লেখক: চ্যাংহং লি হলেন হুয়া মেডিসিনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা 

ডায়াবেটিস মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি অপরিহার্য

০৮:০৩:১৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

চ্যাংহং লি

স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বা নতুন ওষুধ গবেষণার জন্য অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রায়ই উপেক্ষিত হলেও ডায়াবেটিস আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এটি সারা বিশ্বে কোটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করছে এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে বটেতবে রোগটির জটিলতা সত্যিকার অর্থে মোকাবিলা করতে এবং এই বৈশ্বিক মহামারিকে দমিয়ে রাখতে পদ্ধতিগত একটি মৌলিক পরিবর্তন দরকার।

এশিয়ায় ডায়াবেটিসের অবস্থা এখন একটি সংকটময় পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। নগরায়ণবসন্তে জীবনযাপনপ্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি নির্ভরতাকম খরচে সহজলভ্য চিনি ও ক্রমবর্ধমান খাবারের পরিমাণএগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য। সব মিলিয়ে এখানে ডায়াবেটিসের প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। আমরা শারীরিক পরিশ্রম আর প্রাকৃতিক খাবারের বদলে অফিসকেন্দ্রিক জীবনযাপন ও চিনিযুক্ত এনার্জি ড্রিংক বেছে নিয়েছি। মূলত শরীরের সঙ্গে খাদ্যের সম্পর্কজনিত ভারসাম্যহীনতাই ডায়াবেটিসের অন্যতম চালিকাশক্তি।

বর্তমানে এশিয়ায় আনুমানিক ২৩ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্তযা বৈশ্বিক ডায়াবেটিস-রোগীর প্রায় ৪০%। চীন ও ভারতে ডায়াবেটিসের হার নজিরবিহীনভাবে বেড়ে চলেছেএবং বিপুলসংখ্যক রোগী এখনো চিকিতসার বাইরে থেকে যাচ্ছে বা পর্যাপ্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছেন। এত বিপুলসংখ্যক রোগী সামাল দেওয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।

তবে এসব দেশ চিকিৎসাবিজ্ঞানে উদ্ভাবনেরও কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেবিশেষত চীনে ভবিষ্যতপন্থী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

প্রথাগতভাবে ডায়াবেটিস চিকিৎসার মূল লক্ষ্য ছিল উপসর্গ নিয়ন্ত্রণঔষধখাদ্য ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে রোগের মূল কারণগুলো সমাধান হয় না। আনুমানিক হিসেবে দেখা যায়ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মাত্র ৪০% মানুষ যথাযথভাবে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে মাত্র ৪ জন সুস্থ মাত্রায় শর্করা রাখতে সক্ষম।

ফলে একেবারে নতুন ধরনের একটি দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি হয়ে পড়েছেযেখানে প্রতিটি ব্যক্তির সুনির্দিষ্ট চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে চিকিৎসা পরিকল্পনা করা হবে।

ডায়াবেটিস মোকাবিলার একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে প্রাথমিক পর্যায়ে হস্তক্ষেপপ্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বাধুনিক গবেষণা ও প্রযুক্তিকে রোগীকেন্দ্রিক পদ্ধতির সঙ্গে একীভূত করা। এশিয়ায় যেখানে স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো দেশভেদে ভীষণ বৈচিত্র্যময়সেখানে এই ধরনের কৌশল বাস্তবায়ন করা নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জআবার অত্যন্ত জরুরিও বটে।

চিকিৎসা ও গবেষণা খাতে নতুন প্রযুক্তিগত অগ্রগতিবিশেষত সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতিএশিয়াজুড়ে অনন্য জিনগত ও পরিবেশগত কারণজনিত নানা রকম ডায়াবেটিসের উৎস চিহ্নিত ও মোকাবিলা করতে আশার আলো দেখায়। তবে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করতে গবেষণায় ব্যাপক বিনিয়োগশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজনযাতে রোগীদের জন্য আরো কার্যকর ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসার সুযোগ তৈরি হয়।

বর্তমান পদ্ধতিতে প্রায় সবার ক্ষেত্রেই একই ওষুধ পুনরাবৃত্তি করে দেওয়া হয়জিনগত ভিন্নতা বা কার কী কারণে ডায়াবেটিস হয়েছে তা খুব একটা বিবেচনা করা হয় না। অথচ একজনের ডায়াবেটিসের অন্তর্নিহিত কারণ অন্যজনের থেকে ভিন্ন হতে পারে।

ডায়াবেটিস চিকিৎসা ও পরিচর্যায় সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতির (প্রেসিশন মেডিসিন) ব্যবহার বাড়লে খুবই ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে। জি এল পি – ১ (GLP-1) সম্পর্কিত ওষুধের ব্যাপক ব্যবহারের প্রবণতা এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। যদিও ওজেম্পিক (সেমাগ্লুটাইড) বা ভিক্টোজা (লিরাগ্লুটাইড)-এর মতো জি এল পি – ১ ওষুধ এখন মোটা শরীরের ওজন কমানোর জন্যই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছেতবু এগুলো ডায়াবেটিস চিকিৎসায়ও খুবই কার্যকর।

শুধু জি এল পি – ১ ওষুধের ব্যবহারে ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়িয়ে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে এগুলোকে এমন ওষুধের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারেযেগুলো দেহের গ্লুকোজ-সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং খাবার গ্রহণের পর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইনসুলিন নিঃসরণকে সহায়তা করে। এতে শরীরে শর্করার মাত্রা অনেক বেশি ভারসাম্যমূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

উদাহরণস্বরূপঅনেকের ডায়াবেটিস গ্লুকোকিনেজ (জি.কে.) নামের একটি উৎসেচকের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার কারণে হয়। গ্লুকোকিনেজ দেহের অভ্যন্তরীণ গ্লুকোজ সেন্সর” হিসেবে কাজ করে এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেএটি শর্করাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। জিনগত ভিন্নতার কারণে অনেকের মধ্যে গ্লুকোকিনেজের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। এই কারণগুলো মাথায় রেখে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতিই এই ধরনের পার্থক্যগুলোকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে।

এজন্য অবশ্যই আরো গবেষণাক্লিনিক্যাল ও বাস্তব-জীবনের তথ্য বিশ্লেষণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবেস্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকারযাতে প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের কারণ বোঝা যায়।

এই লক্ষ্য অর্জনে অন্তত তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ পেরোতে হবে।

প্রথমতরোগীর প্রয়োজন ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতার মধ্যে বড় ফারাক রয়েছে। এশিয়ায় ডায়াবেটিসের বিপুলসংখ্যক রোগী থাকায় স্বাভাবিকভাবেই সবার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী নেই। আবার ব্যক্তিভিত্তিক বিশদ বিশ্লেষণ করতে খরচ ও সময়উভয়ই বেশি লাগে। তবে ডায়ালাইসিসের মতো আজীবনের ব্যয়বহুল বিকল্প চিকিৎসার তুলনায় এটি এখনো সাশ্রয়ী।

দ্বিতীয়তরাজনৈতিক বাধা রয়েছে। সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা মূলত ব্যক্তিগত জিনগত তথ্যের ওপর নির্ভর করেযা অনেক দেশেই জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

তৃতীয়তবাজারের বাস্তবতা। ওষুধ কোম্পানিগুলো চায় তাদের ওষুধ যতবেশি সম্ভব ব্যবহৃত হোক। অন্য কোম্পানির ওষুধের সঙ্গে মিলিয়ে ব্যবহার করলে বাজার ভাগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আসলে বাজার বিশালতাই এটি হয়তো অতটা বড় সমস্যাও নয়কিন্তু প্রতিযোগিতা যে আছেতা অস্বীকার করা যায় না।

তারপরও ডায়াবেটিস চিকিৎসায় সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতির প্রসার ঘটলে ভবিষ্যতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে।

ডায়াবেটিস চিকিৎসার ভবিষ্যৎ সুনির্দিষ্ট চিকিৎসায় নিহিত। নতুন ওষুধ নিয়ে আলোচনার জোরসম্ভাব্য যুগপৎ চিকিৎসা-পদ্ধতিনতুন গবেষণা এবং ডায়াবেটিসজনিত চাপে জর্জরিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে এমন একটি পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।

ডায়াবেটিস ব্যবস্থাপনায় এই পদ্ধতিগত পরিবর্তন এখন হাতের নাগালেই। তবে তার জন্য চাই ব্যাপকভিত্তিকপূর্ণাঙ্গ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এতে ডায়াবেটিস রোগীদের জীবনমান যেমন উন্নত হবেতেমনি স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়ও কমবে। ফলে রোগী ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাউভয়ই উপকৃত হবে।

লেখক: চ্যাংহং লি হলেন হুয়া মেডিসিনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা