স্বদেশ রায়
শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা মাহমুদ রবিবার ২৩ শে ফেব্রুয়ারী শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রীর মৃত্যু কাকতলীয় ভাবে ফেব্রুয়ারী মাসে হওয়াতে অনেকেরই মনে এ মৃত্যুতে একটা ভাল লাগা কাজ করবে। কারন,ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীর “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…..” এই
গানের এমন অমর সুর কখনোই হোত না , যদি না এ পৃথিবীতে, এই বাঙালি ঘরে সুরকার আলতাফ মাহমুদ না জন্মাতেন। আর সুরকার আলতাফ মাহমুদের প্রতিটি সুর সৃষ্টি করার জন্যে তাঁকে সংসারের নানা ভার থেকে মুক্ত রেখে সংঙ্গীতে নিবেদিত হওয়ার জন্য এই ভদ্রমহিলা কি করেছেন, সে ইতিহাস কোনদিন পাওয়া যাবে না। বাস্তবে যে কোন মুক্তির মন্দিরে মা, বোন স্ত্রীর যে রক্তক্ষরন, ত্যাগ, তিলতিল শ্রম সাধনা- কোনদিনই লেখা থাকে না। যেমন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র এই ভদ্রমহিলা কিভাবে নিজে হাতে মাটি কেটে গর্ত খুঁড়ে ট্রাঙ্ক ভরে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিলেন- আজ তার তৃতীয় প্রজন্মের তরুন তরুনীরা কেউ জানে কিনা, এমনকি যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেন , তাদেরও কজন জানেন ,তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়!
তিনি তখন তরুনী ,তাঁর সামনে দিয়েই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো স্বামী আ শুধু একজন আলতাফ মাহমুদকে নয়, একটি জাতির ও একটি শিল্পের শ্রেষ্ঠ এক সন্তানকে।
তারপরেও তিনি বেঁচেছিলেন নিজের একমাত্র কন্যাকে শুধু আশ্রয় করে নন, তাঁর স্বামীর প্রিয় স্বদেশ,সংগ্রাম এবং ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীর অমর সুরকে আশ্রয় করে। আলতাফ মাহমুদ শহীদ হয়েছিলেন তরুন বয়সে। সারা মাহমুদ তারপরেও জীবন সংগ্রামে জর্জরিত হয়ে বেঁচেছিলেন। তাঁর আত্মজা বড় হয়েছ এই মাটিতে। তাঁর তৃতীয় প্রজন্ম তার সামনে বেড়ে উঠেছে আলতাফ মাহমুদের রক্ত ভেজা মৃত্তিকায়। এসব দেখেও অনেকেই মনে মনে কামনা করেছেন, উনি যেন শতায়ু হন। আবার অনেকে ওনাকে ভুলে ও গিয়েছিলেন।
আজ ওনার মৃত্যু সংবাদ দেখে মনে হচ্ছে, উনি মাত্র একটি বছর আগে ফেলে আসা ফেব্রুয়ারিতে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে মৃত্যুর আগে তিনি অনেক কম যন্ত্রনা পেতেন। অন্তত কিছু বাঙালি যা এখনো অবশিষ্ট আছে তারা জানানোর সুযোগ পেতেন তাদের সপুষ্প সম্মান তাঁকে। নিঃসন্দেহে তাঁর হৃদয় যন্ত্রনার ছেনীর আঘাতে বিদ্ধ হোত না একথা শুনে, তাঁর স্বামীর রক্ত ভেজা বাংলায়- ২১শে ফেব্রুয়ারী পালিত হয়েছে, কিন্তু সেখানে বাজেনি আলতাফ মাহমুদের সেই অমর সুর “ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…..আ- আ- আ” । প্রভাত ফেরীর সঙ্গে শোক, মৃত্যু ,বিজয় আর ভবিষ্যতের দীর্ঘতার সেই গভীর সুর-উচ্চারন- যা উঠে আসে শ্রদ্ধাবনত মানুষের নাভিমুল থেকে –“ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী , আমি কি ভুলিতে পারি —আ আ ………” যা এক সমুদ্র মন্থিত বানী ও সুরের সংমিশ্রণ। আর কিছু বাঙালী তো এখনো অবশিষ্ট আছে- তাঁরা সশ্রদ্ধায় বহন করে নিয়ে যেত কোনরূপ অপবিত্রতার ছোঁয়া ছাড়া পবিত্র শহীদ মিনারে তাঁর পবিত্র মরদেহ। শুধু পলাশ, শিমুল আর গোলাপের শ্রদ্ধা নয়,তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বামীর সৃষ্ট অমর সুর-ধ্বনি শহীদ মিনারে প্রতিটি মিনার ছুঁয়ে ছুঁয়ে এসে জানিয়ে যেত তাকে শেষ শ্রদ্ধা।
শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষের এই পৃথিবীতে সবকিছু শুধু এক পক্ষকালে ঘটেনা। তাঁর স্বামী যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন , তখন ও পক্ষকাল নিয়ে ছিল দ্বিধা ,আর সে হিসেবে তিনি ও তাঁর স্বামীর প্রিয়তমা- তাই তিনি ও তাঁরই অনুগামী- সময়ও তাই বলে দেয়।