মালীহা লোধি
দেশে এখনও অনেক কিছুই অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। রাষ্ট্রের ওপর অভিজাত মহলের কবজা, রাজনীতিতে সামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রভাব, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, শাসকধর্মী অভিজাত গোষ্ঠীর ক্রমাগত ঋণ ও বৈদেশিক সহায়তার উপর নির্ভর করে আর্থিক ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা, কাঠামোগত অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগের ঘাটতি—এসবই দেশের ভাগ্য ও ভবিষ্যতের ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে।
কিন্তু বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনও দেশের গতিপ্রকৃতিকে পুনর্গঠিত করে চলেছে। কিছু পরিবর্তন ইতিবাচক হলেও কিছু নতুন চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। কিছু সুযোগ ইতিবাচক রূপান্তরের সম্ভাবনা জাগালেও, অন্যগুলো আবার দীর্ঘদিনের বিবাদ-বিভাজনের মতোই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেশকে পেছনে টেনে ধরে। কিছু ধারা অস্থিরতার অশনিসঙ্কেত বহন করে। অবশ্য এই দেশীয় বাস্তবতায় এগুলো ছাড়াও আরও অনেক পরিবর্তন ও প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়; তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে উল্লিখিত বিষয়গুলোই বেশি গুরুত্ব বহন করছে।
দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্প্রসারণ। মধ্যবিত্তের উত্থান রাষ্ট্র ও নাগরিকদের সম্পর্ক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে, কেননা এই শ্রেণির মানুষ ভালো শাসনব্যবস্থা প্রত্যাশা করে। পাকিস্তানের গবেষকরা মধ্যবিত্তের সঠিক মাপ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করলেও, সবাই একমত যে গত দুই দশক বা তারও বেশি সময়ে এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালের পর থেকে পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রায় চার গুণ বেড়েছে, যার পেছনে দারিদ্র্যের হার কমা ও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই সম্প্রসারণ জনসংখ্যার মোট হারেও প্রতিফলিত হয়েছে। শহরে বসবাসকারী মানুষের হার বৃদ্ধির সাথেও এটি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। ২০২৩ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করে—২০১৭ সালের তুলনায় যা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, শহুরে অঞ্চলে এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা তিন গুণ বেড়েছে।
শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। তারা এখন রাজনৈতিকভাবে আগ্রহী এবং জাতীয় সিদ্ধান্তগ্রহণে বড় ভূমিকা রাখতে চায়। এই শ্রেণি বৈচিত্র্যময়—এতে শিক্ষিত, পেশাজীবী, বেতনভুক্ত কর্মী এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যম আয়ের কর্মচারী অন্তর্ভুক্ত। তাদের বৃহত্তর আকাঙ্ক্ষা সুশাসন, মেধার মূল্যায়ন এবং জনকল্যাণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি। তারা এখন অনেক বেশি সচেতন ও সক্রিয়ভাবে এগুলো দাবি করে। তবে সমাজে কার্যকর পরিবর্তন আনতে তাদের দরকার সুসংগঠিত কাঠামো ও একটি রাজনৈতিক মঞ্চ, যা তাদের স্বার্থ ও মতাদর্শকে সামনে এনে সংগঠিতভাবে পথ দেখাতে পারবে।
অপরদিকে, ডিজিটাল প্রযুক্তিও দেশের চেহারা অনেকটাই বদলে দিয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ফলে মানুষ আরও সংযুক্ত হয়ে পড়েছে, নাগরিকরা অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১১ কোটির বেশি, আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী প্রায় ৭ কোটি ১০ লাখ।
ফলে, বেশিরভাগ মানুষ আগের চেয়ে বেশি তথ্য পায় এবং জাতীয় বিষয়ে অনেক সক্রিয়ভাবে মতামত দেয়। সরকারের কার্যক্রম মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি এখন রাজনৈতিক সংগঠন ও মতপ্রকাশের একটি শক্তিশালী উপায় হয়ে উঠেছে। এটিই সম্ভবত কর্তৃপক্ষকে ডিজিটাল ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন বা আইন প্রয়োগ এবং ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞা আরোপে উদ্বুদ্ধ করেছে।
পাকিস্তানেও, বিশ্বব্যাপী অন্যান্য দেশের মতো, ডিজিটাল প্রযুক্তি ইতিবাচক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হতে পারে—মানুষকে ক্ষমতায়ন করা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটানো এবং সামগ্রিকভাবে সমাজকে রূপান্তরিত করা এর সক্ষমতার মধ্যে পড়ে। সারা বিশ্বে ডিজিটাল প্রযুক্তি সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে; পাকিস্তানেও দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে এটি একই ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২৪ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এক প্রতিবেদনে ডিজিটাল প্রযুক্তিকে পাকিস্তানের জন্য একটি রূপান্তরমূলক ও গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা “মানব উন্নয়নের ঘাটতি পূরণ করে সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম”।
এখানেই এসে দাঁড়ায় শিক্ষার অভাবজনিত মানব উন্নয়ন-সংকট। এটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে বড় বাধা। পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার পরিধি ও গুণগত মানের গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করার ফলে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর, এবং ২ কোটি ৬০ লাখ স্কুলগামী শিশু স্কুলের বাইরে—বিশ্বে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। যারা স্কুলে যাচ্ছে, তাদের মধ্যেও ‘লার্নিং পভার্টি’ বা শিক্ষাগত দারিদ্র্য বেশ প্রকট। এমন পরিস্থিতিতে মানবসম্পদে বিনিয়োগ না করে পাকিস্তান কখনোই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে না।
দেশের জনসংখ্যার বয়সগত কাঠামো এই সংকটকে আরও গুরুতর করে তুলেছে। মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে। অর্থাৎ, তরুণরাই দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে। কিন্তু তারা যদি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ না পায়, তাহলে হতাশার অন্ধকারে আটকে পড়ে নিজেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি দেশও অগ্রসর হওয়ার পথ হারাবে।
তরুণ জনগোষ্ঠীকে সঠিকভাবে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলতে পারলে পাকিস্তান ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ বা জনমিতিক সুফল পেতে পারে। এটি ত্বরান্বিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান চাবিকাঠি হতে পারে। কিন্তু এই বিনিয়োগে ব্যর্থ হলে একটি ‘ডেমোগ্রাফিক ডিজ্যাস্টার’ বা জনমিতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হবে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকিস্বরূপ।
এসব চ্যালেঞ্জ বছরের পর বছর অনাদৃত থেকে গেছে, কারণ দেশের সংকীর্ণ ক্ষমতাধর অভিজাত গোষ্ঠী রাজনীতিকে কবজা করে ক্ষমতা ধরে রাখতেই বেশি আগ্রহী। এরাই ব্যবস্থা সচল রাখে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে, পরিবর্তনের দরজা রুদ্ধ রাখে। এই ক্ষমতায়িত অভিজাত, যেখানে রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজাতরা একীভূত, দীর্ঘমেয়াদি কোনো অর্থপূর্ণ সংস্কারের পথে হাঁটে না; তারা বরং স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যে নিজেদের প্রভাব ও ক্ষমতা সংহত করতেই বেশি ব্যস্ত থাকে। অভিজাত-নিয়ন্ত্রিত এই ব্যবস্থায় রাজনীতি ও শাসন কাঠামো সাধারণত পৃষ্ঠপোষকতামূলক সুবিধা বণ্টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, জনকল্যাণমূলক স্বচ্ছ নীতিনির্ধারণ সেখানে অগ্রাধিকারের বিষয় নয়।
ফলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাধারণ মানুষের ইস্যুগুলোর চেয়ে ক্ষমতা ও ধনকৌল অর্জনের লড়াই হয়ে দাঁড়ায়—যেখানে বংশানুক্রমিক দল ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক গ্রুপ মুখোমুখি হয়। এমন অবস্থায় দক্ষ শাসনব্যবস্থা আশা করা দুরাশা।
তাহলে কীভাবে এই প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে উল্লেখিত ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোকে কাজে লাগানো সম্ভব? তার উত্তর হলো—একটি নেতৃত্ব, যারা সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন ও সংস্কারে বিশ্বাসী এবং জনকল্যাণকামী শাসনব্যবস্থা গড়ার সংকল্প রাখে; যারা এলিট গোষ্ঠীর সুবিধা বা স্বার্থের তোয়াক্কা না করে সার্বিক উন্নয়নে নিবেদিত।
শুধুমাত্র দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বই প্রতিষ্ঠিত অভিজাতদের বাধা অতিক্রম করে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে। এভাবেই পাকিস্তানকে এমন একটি দেশে পরিণত করা সম্ভব যা জনগণ প্রত্যাশা করে এবং তারা যার যোগ্য।
লেখক. সাবেক রাষ্ট্রদূত (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘ)।