১০:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৪৩)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫
  • 20

সেজদি

সেজদি ছিলেন আমার আরও আপনজন। তাঁর কথা লিখিতে আমার দুই চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠে। কত ভাবে কত কৌশলেই যে দিদি আমাকে সাহায্য করিতেন আজ তার সব মনে পড়িতেছে না। তখন নদীতে বাড়ি ভাঙিয়া আমার পিতা একেবারে নিঃস্ব হইয়া পড়িয়াছেন। বই-খাতা-পত্র কিনিতে পারি না। কিন্তু আমাদের পারিবারিক মর্যাদাবোধের জন্য কাহারও নিকট কোনো সাহায্য চাহিতে আমার আত্ম-অহঙ্কারে বাধিত। দিদি ইহা বুঝিতেন।

তাই এটা-ওটা কিনিবার জন্য দিদি আমাকে বেশি টাকা দিয়া বাজারে পাঠাইতেন। তাঁহার জিনিসগুলি কিনিয়া আনিয়া বাকি সিকি-আধুলিগুলি দিদিকে দিতাম। দিদি তাহা কিছুতেই লইতেন না। স্নেহের সঙ্গে বলিতেন, “সাধু! এই সিকি-আধুলিগুলি দিয়া তুমি বইপত্র কিনিও, অথবা কিছু কিনিয়া খাইও।” প্রথম প্রথম আপত্তি করিতাম। দিদি কিছুতেই শুনিতেন না।

ইহার পর দিদির এটা-ওটা কিনিয়া যাহা উদ্বৃত্ত থাকিত তাহা পাওয়া আমার কাছে একটা রেওয়াজ হইয়া উঠিল। কোনো কোনোদিন দিদির দশ টাকার বাজার করিতে যাইয়া আমার পাঁচ-ছয় টাকা পর্যন্ত প্রাপ্য হইত।

একবারের কথা মনে আছে। সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হইতেছিল। বাড়ি যাইয়া খাইয়া আসিতে পারি নাই। মা আমাকে খাইতে বলিলেন। বারান্দার এক স্থানে আমার খাইবার জায়গা হইল। তাহারই পাশে দুইটি ছাগল বাঁধা ছিল। ঠাকুর পাতে ভাত দিয়া তরকারি আনিতে গেল। ইতিমধ্যে ছাগল দুইটি আসিয়া সেই পাতায় মুখ দিয়া ভাতগুলি ওলট-পালট করিয়া ফেলিল। তখন বাড়ির সকলেরই খাওয়া শেষ হইয়াছে। একমাত্র সেজদির খাওয়া বাকি আছে। দিদি টের পাইয়া ঠাকুরকে কানেকানে কি বলিলেন। ঠাকুর সেজদির জন্য রক্ষিত ভাতগুলি আনিয়া আমাকে দিবার জন্য প্রস্তুত হইল। আমি কত বলিলাম, “দোহাই সেজদি! ও ভাত আপনি আনাইবেন না। আমার পেটে ক্ষুধা নাই।” ঠাকুর ইতস্তত করিতেছিল। সেজদি নিজে ঠাকুরের হাত হইতে ভাতের থালা আনিয়া পরিপাটি করিয়া আমাকে বাড়িয়া দিলেন। আমি বারবার করিয়া বলিলাম, “না সেজদি! এ ভাত আমি খাইব না।” সেজদি জোর করিয়া আমার হাতটি ধরিয়া সেই ভাতের সামনে আমাকে বসাইয়া দিতে দিতে বলিলেন, “ও সাধু! আমার মাথা খাও যদি এ ভাত তুমি না খাও।” কত কালের কথা! কিন্তু আজও যেন সেই করুণাময়ীর কথাগুলি আমার কানে বাজিতেছে, “ও সাধু! আমার মাথা খাও, যদি এ ভাত তুমি না খাও।” সেদিন আমারই জন্য এই স্নেহময়ী দিদিটি অভুক্ত রহিলেন।

সেজদি আমার কবিতার বড়ই অনুরাগী ছিলেন। তাঁহার ধারণা ছিল এক কালে আমি একজন খুব বড় কবি হইব। নতুন কোনো কবিতা লিখিলে তাহা সুন্দর অক্ষরে নকল করিয়া বাড়ির সকলকে পড়িয়া শুনাইতেন। তাঁহার পিতা যে এমন ডাকসাইটে রাশভারী মানুষ ছিলেন, তাঁহাকেও তিনি আমার কবিতা না শুনাইয়া ছাড়িতেন না। দিদির মুক্তার মতো অক্ষরে নকল করা কত কবিতাই সেকালে মাসিক পত্রিকায় পাঠাইয়াছি। সেগুলি ছাপা হয় নাই। দিদি বলিয়াছেন, “সাধু। তুমি দুঃখ পাইও না। এতটুকু তো তোমার বয়স। আরও ভালো করিয়া লেখ। নিশ্চয় একদিন তোমার কবিতা ছাপা হইবে।”

সেবার দিদির টাইফয়েড হইল। খুব ভীষণ অসুখ। তখনও আমি সেবাকার্যে পারদর্শী হই নাই। শরৎচন্দ্রের রামের সুমতি গল্পের নায়কের মতো আমি দরজার সামনে বসিয়া থাকি। আল্লার কাছে প্রার্থনা করি, “খোদা। আমার দিদিকে ভালো করিয়া দাও।”

 

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৪৩)

১১:০০:২৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ মার্চ ২০২৫

সেজদি

সেজদি ছিলেন আমার আরও আপনজন। তাঁর কথা লিখিতে আমার দুই চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া উঠে। কত ভাবে কত কৌশলেই যে দিদি আমাকে সাহায্য করিতেন আজ তার সব মনে পড়িতেছে না। তখন নদীতে বাড়ি ভাঙিয়া আমার পিতা একেবারে নিঃস্ব হইয়া পড়িয়াছেন। বই-খাতা-পত্র কিনিতে পারি না। কিন্তু আমাদের পারিবারিক মর্যাদাবোধের জন্য কাহারও নিকট কোনো সাহায্য চাহিতে আমার আত্ম-অহঙ্কারে বাধিত। দিদি ইহা বুঝিতেন।

তাই এটা-ওটা কিনিবার জন্য দিদি আমাকে বেশি টাকা দিয়া বাজারে পাঠাইতেন। তাঁহার জিনিসগুলি কিনিয়া আনিয়া বাকি সিকি-আধুলিগুলি দিদিকে দিতাম। দিদি তাহা কিছুতেই লইতেন না। স্নেহের সঙ্গে বলিতেন, “সাধু! এই সিকি-আধুলিগুলি দিয়া তুমি বইপত্র কিনিও, অথবা কিছু কিনিয়া খাইও।” প্রথম প্রথম আপত্তি করিতাম। দিদি কিছুতেই শুনিতেন না।

ইহার পর দিদির এটা-ওটা কিনিয়া যাহা উদ্বৃত্ত থাকিত তাহা পাওয়া আমার কাছে একটা রেওয়াজ হইয়া উঠিল। কোনো কোনোদিন দিদির দশ টাকার বাজার করিতে যাইয়া আমার পাঁচ-ছয় টাকা পর্যন্ত প্রাপ্য হইত।

একবারের কথা মনে আছে। সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হইতেছিল। বাড়ি যাইয়া খাইয়া আসিতে পারি নাই। মা আমাকে খাইতে বলিলেন। বারান্দার এক স্থানে আমার খাইবার জায়গা হইল। তাহারই পাশে দুইটি ছাগল বাঁধা ছিল। ঠাকুর পাতে ভাত দিয়া তরকারি আনিতে গেল। ইতিমধ্যে ছাগল দুইটি আসিয়া সেই পাতায় মুখ দিয়া ভাতগুলি ওলট-পালট করিয়া ফেলিল। তখন বাড়ির সকলেরই খাওয়া শেষ হইয়াছে। একমাত্র সেজদির খাওয়া বাকি আছে। দিদি টের পাইয়া ঠাকুরকে কানেকানে কি বলিলেন। ঠাকুর সেজদির জন্য রক্ষিত ভাতগুলি আনিয়া আমাকে দিবার জন্য প্রস্তুত হইল। আমি কত বলিলাম, “দোহাই সেজদি! ও ভাত আপনি আনাইবেন না। আমার পেটে ক্ষুধা নাই।” ঠাকুর ইতস্তত করিতেছিল। সেজদি নিজে ঠাকুরের হাত হইতে ভাতের থালা আনিয়া পরিপাটি করিয়া আমাকে বাড়িয়া দিলেন। আমি বারবার করিয়া বলিলাম, “না সেজদি! এ ভাত আমি খাইব না।” সেজদি জোর করিয়া আমার হাতটি ধরিয়া সেই ভাতের সামনে আমাকে বসাইয়া দিতে দিতে বলিলেন, “ও সাধু! আমার মাথা খাও যদি এ ভাত তুমি না খাও।” কত কালের কথা! কিন্তু আজও যেন সেই করুণাময়ীর কথাগুলি আমার কানে বাজিতেছে, “ও সাধু! আমার মাথা খাও, যদি এ ভাত তুমি না খাও।” সেদিন আমারই জন্য এই স্নেহময়ী দিদিটি অভুক্ত রহিলেন।

সেজদি আমার কবিতার বড়ই অনুরাগী ছিলেন। তাঁহার ধারণা ছিল এক কালে আমি একজন খুব বড় কবি হইব। নতুন কোনো কবিতা লিখিলে তাহা সুন্দর অক্ষরে নকল করিয়া বাড়ির সকলকে পড়িয়া শুনাইতেন। তাঁহার পিতা যে এমন ডাকসাইটে রাশভারী মানুষ ছিলেন, তাঁহাকেও তিনি আমার কবিতা না শুনাইয়া ছাড়িতেন না। দিদির মুক্তার মতো অক্ষরে নকল করা কত কবিতাই সেকালে মাসিক পত্রিকায় পাঠাইয়াছি। সেগুলি ছাপা হয় নাই। দিদি বলিয়াছেন, “সাধু। তুমি দুঃখ পাইও না। এতটুকু তো তোমার বয়স। আরও ভালো করিয়া লেখ। নিশ্চয় একদিন তোমার কবিতা ছাপা হইবে।”

সেবার দিদির টাইফয়েড হইল। খুব ভীষণ অসুখ। তখনও আমি সেবাকার্যে পারদর্শী হই নাই। শরৎচন্দ্রের রামের সুমতি গল্পের নায়কের মতো আমি দরজার সামনে বসিয়া থাকি। আল্লার কাছে প্রার্থনা করি, “খোদা। আমার দিদিকে ভালো করিয়া দাও।”