আর্কাদি গাইদার
প্রথম পরিচ্ছেদ
রাত্তির পর্যন্ত জঙ্গলে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ালুম আমি। জঙ্গলটা একেবারে বিজন ছিল না। কেননা, সারা জঙ্গলে এখানে-ওখানে গাছের কাটা গড়ি ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
জঙ্গলের যতই গভীরে যাবার চেষ্টা করলুম ততই দেখলুম গাছের সংখ্যা কমে আসছে আর ফাঁকা জায়গার সংখ্যা বাড়ছে। শুধু তাই নয়, ওই ফাঁকা জায়গাগুলোয় ঘোড়ার খুরের দাগ আর ঘোডার নাদ পড়ে থাকতে দেখলাম। রাত নেমে এল। আমি তখন ভীষণ ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, ক্ষতবিক্ষত। একটা ঝোপের মধ্যে শুকনোমতন লুকনো একটা জায়গা খাঁজে নিয়ে একখানা কাঠ মাথার নিচে বালিশের মতো রেখে শুয়ে পড়লুম। শোয়ার পর ক্লান্তি যেন আরও চেপে ধরল। গাল দুটো গরম ঠেকতে লাগল আর যে-পায়ে কুকুরে কামড়েছিল সেই পা-টা উঠল টন্টনিয়ে।
ঠিক করলুম, ‘আমায় ঘুমোতেই হবে। এখন রাত্তির, কেউ আমায় খুঁজে পাবে না এখানে। আমি ক্লান্ত। আমায় ঘুমোতেই হবে। কাল সকালে উঠে যা-হোক কিছু ঠিক করা যাবে।’
ঝিমুনি আসতেই মনে পড়ে গেল আমাদের আজামাসের কথা। সেই পুকুর, ভেলায় চড়ে আমাদের সেই যুদ্ধ, গরম পুরনো কম্বলের নিচে আমার সেই নরম বিছানা। মনে পড়ল, ফেদুকা আর আমি সেই-যে একবার পায়রা ধরে ফেকাদের রান্নার কড়াইতে ভেজেছিলুম সেই কথা। তারপর লুকিয়ে পায়রাগুলো খেয়েছিলুম দু-জনে। পায়রার মাংস খেতে এমন সুস্বাদু ছিল যে কী বলি..
গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে শনশন্ বাতাস বইতে শুরু করল। জঙ্গলটাকে কেমন খালি-খালি আর ভয়ঙ্কর বোধ হতে লাগল। আর আমার মনে ভেসে উঠল আমাদের পুরনো শহর আজামাস, পরবের সুস্বাদু পিঠের মতো উষ্ণ আর সুগন্ধি। কোটের কলারটা উচু করে তুলে নিলুম। আর বুঝতে পারলুম এক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে গাল বেয়ে নামছে। কিন্তু তবু, তবু আমি কাঁদি নি। কিছুতেই কাঁদি নি।
ওই দিন আরও গভীর রাত্রে ঠান্ডায় শরীর অসাড় হয়ে যাওয়ার যোগাড় হলে অনবরত লাফালাফি করতে আর ফাঁকা জায়গাটায় দৌড়োদৌড়ি করতে বাধ্য হলুম।
একবার একটা বার্চ-গাছে ওঠারও চেষ্টা করলুম। এমন কি শরীর গরম করার জন্যে নাচতেও লাগলুম। তারপর আবার কিছুক্ষণ শুয়ে রইলুম চুপচাপ। তারপর বন-থেকে-ওঠা কুয়াশায় শরীর আবার ঠান্ডা হয়ে যেতে ফের লাফিয়ে উঠলুম।