সারাক্ষণ রিপোর্ট
ফ্রান্সিস স্কট ফিট্জেরাল্ড মাত্র ২৮ বছর বয়সে যখন ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’ প্রকাশ করেন, তিনি ভাবেননি তাঁর হালকা উপন্যাসটি একদিন মার্কিন সাহিত্যের সবচেয়ে পাঠ-প্রিয় গ্রন্থে পরিণত হবে। আজ প্রকাশের ১০০ বছর পরে, জে গ্যাটসবি নামের রহস্যময়, স্বপ্নমগ্ন ধনকুবেরের গল্প আমাদের অর্থ, বর্ণ, প্রেম ও ইতিহাস-বোধকে বারবার আলোয় এনে দেয়।
গ্যাটসবির মূল কাহিনি সংক্ষেপে
আড়াইশ পৃষ্ঠারও কম এই উপন্যাসে ইয়েল-স্নাতক নিক ক্যারাওয়ের চোখে আমরা দেখি গ্যাটসবির জীর্ণ স্বপ্ন—পুরনো প্রেমিকা ডেইজি বুকানানের কাছে ফেরার আকুতি। ডেইজির স্বামী টম যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো ধনিকশ্রেণির দম্ভ, বর্ণবিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের প্রতীক। তাঁদের অবহেলায় ভাঙচুর হয় নিঃস্ব মানুষের জীবন, আর ভুল অভিমান থেকে গ্যাটসবি শেষতক প্রাণ হারান। নিকের নিরবধি আত্ম-পৃথা প্রশ্ন তোলে—এই ট্র্যাজেডি কি আসলে আমেরিকান অভিজ্ঞতার প্রতিচ্ছবি?
গঠনমূলক জনপ্রিয়তা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
• হাইস্কুলের রচনায় ‘আমেরিকান ড্রিম’ ও ঘোলাটে সবুজ বাতির প্রতীক নিয়ে অনন্ত আলোচনা
• অন্তত চারটি বড় বাজেটের চলচ্চিত্র, অগণিত টিভি পর্ব, একটি অপেরা, দুটি মিউজিক্যাল ও অসংখ্য পুনর্লেখন
• ২০২১ সালে গ্রন্থটি পাবলিক ডোমেনে আসার পর ফ্যান-ফিকশন ও ছায়া-উপন্যাসের অধ্যায় শুরু
জাজ এজ গ্যাটসবি
রোরিং টোয়েন্টিজের চটকদার ঐশ্বর্য, মদবন্দী নৈরাজ্য ও ওয়াল স্ট্রিটের উদ্দাম পুঁজির সঙ্গে গ্যাটসবির নাম জুড়ে যায়। প্রকাশের সময় বইটি তেমন বিক্রি না-হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ১.৫ লাখ কপি সৈন্যদের মধ্যে বিলি হলে উৎসাহ ফিরে আসে। পোস্ট-ওয়ার আমেরিকা অতীতের উদ্দীপনা খুঁজতে গ্যাটসবিকে বারবার সিনেমায়, ফ্যাশনে ও নাটকে ফিরিয়ে আনে—যা কালক্রমে ‘গ্রেট গ্যাটসবি যুগ’ নামে পরিচিত হয়।
অস্তিত্ববাদী গ্যাটসবি
পঞ্চাশের দশকে উপন্যাসটিকে আর কেবল বিংশ শতকের অতিবিলাসের ব্যঙ্গ বলে ভাবা হয়নি; বরং অ্যালবার্ট কামুর ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ বা সল বেলোর ‘ড্যাংলিং ম্যান’-এর মতো আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতার পাঠ বলা হয়েছে। এই সময়েই অ্যালান ল্যাড (১৯৪৯) ও রবার্ট রেডফোর্ড (১৯৭৪) অভিনীত চলচ্চিত্রে গ্যাটসবি হয়ে ওঠেন বিষণ্ণ, অর্থহীনতার শিকার এক নায়ক। ১৯৯৮-এর ‘পিনাটস’ কমিক-স্ট্রিপে স্নুপির টাই-ধরা স্নায়ুক্ষয়ী অবতার সেই অস্তিত্ববাদী গ্যাটসবিরই কার্টুন প্রতিচ্ছবি।
হিপ-হপ গ্যাটসবি
বাজ লুহরম্যানের ২০১৩ সালের ছবিতে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিয়োর গ্যাটসবিকে স্মরণীয় করেছে সমসাময়িক পপ ও র্যাপের মিশ্র সাউন্ডট্র্যাক—যার নির্বাহী প্রযোজক জে-জেড। ঠিক যেমন জে গ্যাটসবি নিষিদ্ধ মদ দিয়ে সম্পদ গড়েন, তেমনি জে-জেড অবৈধ রাস্তায় শুরু করে শিল্প-জগতে সাফল্য পেয়েছেন। ‘জি’ (২০০২) চলচ্চিত্র, রড ওয়েভের ‘গ্রেট গ্যাটসবি’ (২০২৩) গান কিংবা ‘দ্য সিম্পসন্স’-এর ‘দ্য গ্রেট ফ্যাটসবি’ পর্বে গ্যাটসবিকে হিপ-হপের নতুন ধনীদের মাঝে দেখি। এ প্রেক্ষাপটে গ্যাটসবির জাতিগত অভিন্নতা নিয়েও বিতর্ক ওঠে; অনেকের মতে তিনি ছিলেন ‘কালো মানুষ সাদা মুখোশে’—যে অনিশ্চয়তা উপন্যাসটিকে নতুন আলোয় দেখায়।
উচ্চ-নিম্ন (High-Low) গ্যাটসবি
১৯৪৫-এ লায়নেল ট্রিলিং ‘গ্যাটসবি’কে মিল্টন-গোয়েথে-ইয়েটসের পাশে বসিয়ে উচ্চ সাহিত্যকে সম্মানিত করেন। একই সঙ্গে স্কুলের বাধ্যতামূলক পাঠক্রমে ঢুকে বইটি ‘হোমওয়ার্ক’-এ পরিণত হয়। কমেডিয়ান অ্যান্ডি কফম্যান ৭০-এর দশকে টাক্সিডো পরে মঞ্চে পুরো উপন্যাস পাঠ করে দর্শক বিভ্রান্ত করেন। ‘সাউথ পার্ক’, ‘ফ্যামিলি গাই’, ‘সেইনফেল্ড’—সর্বত্রই বইটি ধনিক প্রতীকে বা পড়ার বাধ্যবাধকতায় ঠাট্টার উপাদান। ২০০৪-এ নিউইয়র্কের ‘গ্যাটস’ নামের ৮-ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের মঞ্চ-আস্বাদন দেখায়, অফিসের ধূলিধূসর পরিবেশেও গ্যাটসবির ভাষ্য আমাদের ছুঁয়ে যায়।
উপসংহার
সবুজ আলোটি আসলে একটা নক্ষত্রমণ্ডল—যেমন গ্যাটসবি তাঁর কালের সীমা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে মানুষের আশা-হতাশা, শ্রেণি-স্বপ্ন ও স্ব-পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। শত বছর পরে উপন্যাসটি এখনো মনে করিয়ে দেয়, আমরা প্রত্যেকেই নদীর প্রতিস্রোতে বোট চালিয়ে চলেছি—সামনের দিকে এগোতে গিয়ে বারবার অতীতে ফেরত যেতে বাধ্য। গ্যাটসবি আমাদের এই চিরন্তন মানবকথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।