১১:৫৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

কীভাবে ক্যাথারিন গ্রাহাম ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারির নিক্সনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান

  • বিল গেটস
  • ১১:৪১:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫
  • 75

৫ জুলাই ১৯৯১ আমার জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর একটি। সেদিন আমার মা ওয়াশিংটনের হুড কানালের ছুটির বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে এক সমাবেশ আয়োজিত করেছিলেন। অতিথিদের তালিকায় ছিলেন ওয়ারেন বাফেট, যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমেই আমার—পরবর্তীতে গেটস ফাউন্ডেশনের সূচনা‑সহ—দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

কিন্তু সেদিন আরও এক কিংবদন্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল: ক্যাথারিন (কেই) গ্রাহাম, ওয়াশিংটন পোস্টের খ্যাতনামা প্রকাশক। সেই সাক্ষাৎ থেকেই তাঁর সঙ্গে যে বন্ধুত্বের সূচনা, তা তিনি মারা যাওয়ার (২০০১) অনেক পর পর্যন্ত আমার কাছে অমূল্য রয়ে গেছে।

যে কাহিনি ‘পার্সোনাল হিস্ট্রি’ গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে, তা নিক্সন প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের বাইরেও বিস্তৃত। কৈশোরে তাঁর পিতা পোস্টটি দেউলিয়াত্বের মুখ থেকে কিনে নেন। ১৯৪৬‑এ তিনি পোস্টের প্রকাশনা দায়িত্ব জামাতা ফিলিপ গ্রাহামের হাতে তুলে দেন—কারণ সেই সময়ে বড় সংবাদমাধ্যম চালানোর মতো পদে নারীদের স্থান দেওয়াটা একেবারেই অকল্পনীয় ছিল। কেয়ের নিজের কথায়, “ওই সময় আমার মাথায়ও আসেনি যে বাবা আমাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ভাবতে পারেন।” তাঁর ভূমিকা হবে ‘সুসংহত গৃহিণী ও মা’—সমাজের এই বোঝাপড়াই স্বাভাবিক ধরা হতো।

তবে স্বামী ফিলিপ গ্রাহামের জীবন সহজ ছিল না; বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত তিনি দুর্দান্ত মানসিক অসংযমে ভুগতেন—যে সময় মানসিক রোগের চিকিৎসা ছিল অপরিণত। অবশেষে এক অবকাশযাপনের বাড়িতে তিনি আত্মহত্যা করেন; প্রথমে লাশের সামনে দাঁড়াতে হয় কেইকেই। ব্যক্তিগত শোক সামাল দিতে সামলাতেই কেয়ের কাঁধে এসে পড়ে ওয়াশিংটন পোস্ট কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ও প্রকাশকের দায়িত্ব। পত্রিকাটি ততখনও মুনাফাহীন, টিকে আছে কোম্পানির মালিকানাধীন টিভি স্টেশনগুলোর আয়ে।

নতুন ভূমিকায় সহকর্মী পুরুষদের অনেকে তাঁকে হেয় করেছিলেন। কেয়ের ভাষায়, “তাদের তাচ্ছিল্যকে প্রথমে আমি স্বাভাবিকই ভেবেছিলাম, কারণ আমি তখন একদম নতুন। পরে ‘উইমেন্স লিব’ যুগ এসে বুঝিয়েছে, খোদ আমার ক্ষেত্রেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা কী ধরনের সমস্যার মুখে পড়ে।” সত্ত্বেও কেয়ের আত্মসমালোচনা প্রবণতা প্রবল; নিজেকে “ভয়ানক অজ্ঞ” প্রকাশক বলে দোষারোপ করেন, স্বামীর মৃত্যুতে নিজেকেই দায়ী করেন। তাঁর এই কঠোর আত্মসমালোচনা পড়তে গিয়ে কখনও‑সখনও দুঃসহ লাগে; ইচ্ছে হয়, তিনি যেন বুঝতেন কতটা অসাধারণ ছিলেন।

সাংবাদিকতায় তাঁর অজ্ঞতা শেষতক শক্তিতে রূপ নেয়। ১৯৬৩‑এ প্রকাশকের আসনে বসে তিনি প্রশ্ন করতেন, সহকর্মীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, নিমগ্ন হয়ে শেখার চেষ্টা করতেন। ঠিক এই আস্থা‑ভরসার পরিবেশই ১৯৭০‑এর দশকে ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারির সময় বড় কাজে আসে। নিক্সনের প্রচারপ্রধান জন মিচেল পোস্টের এক প্রতিবেদককে কেয়ের প্রতি অশ্লীল হুমকি দিয়েছিলেন; পরদিন কেয়ে সেই হুমকি নিজের পত্রিকাতেই পড়ে থাকেন। প্রশাসনের চাপ, সম্ভাব্য মানহানি মামলা ও টিভি স্টেশনের লাইসেন্স হারানোর ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি সম্পাদকীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখেন।

এ সময়ই ওয়ারেন বাফেট দৃঢ় সমর্থন জোগান—১৯৭৩‑এ বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে পোস্ট কোম্পানির ১০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়, কেয়েকে নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখে। ওয়ারেন বহুবার আক্ষেপ করে বলেছেন, ১৯৭৬‑এর চলচ্চিত্র ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’‑এ কেয়ের উল্লেখ না থাকাটা অনুচিত; ভাগ্যেশ ২০১৭‑এর ‘দি পোস্ট’ ফিল্মে মেরিল স্ট্রিপের অনবদ্য অভিনয়ে কেয়ে যথাযথ সম্মান পেয়েছেন।

ওয়াটারগেট ছাড়াও কেয়ের গল্পে আছে প্রেসিডেন্ট কেনেডির সঙ্গে সম্পর্ক, ‘পেন্টাগন পেপার্স’, প্রেসম্যানদের ধর্মঘট—সবই একজীবনে অনন্য অভিজ্ঞতা। তাঁর জীবনের পূর্ণ ছবি জানতে হলে সাম্প্রতিক প্রামাণ্যচিত্র ‘বিকামিং ক্যাথারিন গ্রাহাম’‑এর পর ‘পার্সোনাল হিস্ট্রি’ পড়তে পারেন।

কেয়ে গ্রাহামের জীবন কেবল আমেরিকার ইতিহাসের এক আকর্ষণীয় অধ্যায়েরই জানালা নয়; তা সাহস, নেতৃত্ব আর দুর্বলতার মাঝ থেকে শক্তি সন্ধানেরও পাঠশালা।

কীভাবে ক্যাথারিন গ্রাহাম ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারির নিক্সনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান

১১:৪১:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

৫ জুলাই ১৯৯১ আমার জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোর একটি। সেদিন আমার মা ওয়াশিংটনের হুড কানালের ছুটির বাড়িতে বন্ধুদের নিয়ে এক সমাবেশ আয়োজিত করেছিলেন। অতিথিদের তালিকায় ছিলেন ওয়ারেন বাফেট, যাঁর সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমেই আমার—পরবর্তীতে গেটস ফাউন্ডেশনের সূচনা‑সহ—দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

কিন্তু সেদিন আরও এক কিংবদন্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল: ক্যাথারিন (কেই) গ্রাহাম, ওয়াশিংটন পোস্টের খ্যাতনামা প্রকাশক। সেই সাক্ষাৎ থেকেই তাঁর সঙ্গে যে বন্ধুত্বের সূচনা, তা তিনি মারা যাওয়ার (২০০১) অনেক পর পর্যন্ত আমার কাছে অমূল্য রয়ে গেছে।

যে কাহিনি ‘পার্সোনাল হিস্ট্রি’ গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে, তা নিক্সন প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সংঘাতের বাইরেও বিস্তৃত। কৈশোরে তাঁর পিতা পোস্টটি দেউলিয়াত্বের মুখ থেকে কিনে নেন। ১৯৪৬‑এ তিনি পোস্টের প্রকাশনা দায়িত্ব জামাতা ফিলিপ গ্রাহামের হাতে তুলে দেন—কারণ সেই সময়ে বড় সংবাদমাধ্যম চালানোর মতো পদে নারীদের স্থান দেওয়াটা একেবারেই অকল্পনীয় ছিল। কেয়ের নিজের কথায়, “ওই সময় আমার মাথায়ও আসেনি যে বাবা আমাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ভাবতে পারেন।” তাঁর ভূমিকা হবে ‘সুসংহত গৃহিণী ও মা’—সমাজের এই বোঝাপড়াই স্বাভাবিক ধরা হতো।

তবে স্বামী ফিলিপ গ্রাহামের জীবন সহজ ছিল না; বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত তিনি দুর্দান্ত মানসিক অসংযমে ভুগতেন—যে সময় মানসিক রোগের চিকিৎসা ছিল অপরিণত। অবশেষে এক অবকাশযাপনের বাড়িতে তিনি আত্মহত্যা করেন; প্রথমে লাশের সামনে দাঁড়াতে হয় কেইকেই। ব্যক্তিগত শোক সামাল দিতে সামলাতেই কেয়ের কাঁধে এসে পড়ে ওয়াশিংটন পোস্ট কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ও প্রকাশকের দায়িত্ব। পত্রিকাটি ততখনও মুনাফাহীন, টিকে আছে কোম্পানির মালিকানাধীন টিভি স্টেশনগুলোর আয়ে।

নতুন ভূমিকায় সহকর্মী পুরুষদের অনেকে তাঁকে হেয় করেছিলেন। কেয়ের ভাষায়, “তাদের তাচ্ছিল্যকে প্রথমে আমি স্বাভাবিকই ভেবেছিলাম, কারণ আমি তখন একদম নতুন। পরে ‘উইমেন্স লিব’ যুগ এসে বুঝিয়েছে, খোদ আমার ক্ষেত্রেও কর্মক্ষেত্রে নারীরা কী ধরনের সমস্যার মুখে পড়ে।” সত্ত্বেও কেয়ের আত্মসমালোচনা প্রবণতা প্রবল; নিজেকে “ভয়ানক অজ্ঞ” প্রকাশক বলে দোষারোপ করেন, স্বামীর মৃত্যুতে নিজেকেই দায়ী করেন। তাঁর এই কঠোর আত্মসমালোচনা পড়তে গিয়ে কখনও‑সখনও দুঃসহ লাগে; ইচ্ছে হয়, তিনি যেন বুঝতেন কতটা অসাধারণ ছিলেন।

সাংবাদিকতায় তাঁর অজ্ঞতা শেষতক শক্তিতে রূপ নেয়। ১৯৬৩‑এ প্রকাশকের আসনে বসে তিনি প্রশ্ন করতেন, সহকর্মীদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, নিমগ্ন হয়ে শেখার চেষ্টা করতেন। ঠিক এই আস্থা‑ভরসার পরিবেশই ১৯৭০‑এর দশকে ‘ওয়াটারগেট’ কেলেঙ্কারির সময় বড় কাজে আসে। নিক্সনের প্রচারপ্রধান জন মিচেল পোস্টের এক প্রতিবেদককে কেয়ের প্রতি অশ্লীল হুমকি দিয়েছিলেন; পরদিন কেয়ে সেই হুমকি নিজের পত্রিকাতেই পড়ে থাকেন। প্রশাসনের চাপ, সম্ভাব্য মানহানি মামলা ও টিভি স্টেশনের লাইসেন্স হারানোর ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি সম্পাদকীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখেন।

এ সময়ই ওয়ারেন বাফেট দৃঢ় সমর্থন জোগান—১৯৭৩‑এ বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে পোস্ট কোম্পানির ১০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়, কেয়েকে নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখে। ওয়ারেন বহুবার আক্ষেপ করে বলেছেন, ১৯৭৬‑এর চলচ্চিত্র ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’‑এ কেয়ের উল্লেখ না থাকাটা অনুচিত; ভাগ্যেশ ২০১৭‑এর ‘দি পোস্ট’ ফিল্মে মেরিল স্ট্রিপের অনবদ্য অভিনয়ে কেয়ে যথাযথ সম্মান পেয়েছেন।

ওয়াটারগেট ছাড়াও কেয়ের গল্পে আছে প্রেসিডেন্ট কেনেডির সঙ্গে সম্পর্ক, ‘পেন্টাগন পেপার্স’, প্রেসম্যানদের ধর্মঘট—সবই একজীবনে অনন্য অভিজ্ঞতা। তাঁর জীবনের পূর্ণ ছবি জানতে হলে সাম্প্রতিক প্রামাণ্যচিত্র ‘বিকামিং ক্যাথারিন গ্রাহাম’‑এর পর ‘পার্সোনাল হিস্ট্রি’ পড়তে পারেন।

কেয়ে গ্রাহামের জীবন কেবল আমেরিকার ইতিহাসের এক আকর্ষণীয় অধ্যায়েরই জানালা নয়; তা সাহস, নেতৃত্ব আর দুর্বলতার মাঝ থেকে শক্তি সন্ধানেরও পাঠশালা।