তিন দিনেরও বেশি সময় ধরে তীব্র উত্তেজনার পর ১১ মে পাকিস্তান ও ভারতের মানুষ তুলনামূলক শান্ত সকালে জেগে উঠেছিল। সীমান্ত পারাপারের ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র ও জেট হামলা স্থলাভিষিক্ত হয়েছিল যুদ্ধবিরতিতে—যার ইঙ্গিত প্রথম দেন স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি এ সমঝোতার কৃতিত্ব দাবি করেন।
ট্রাম্পের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা এখনও স্পষ্ট নয়: তাঁর দাবি নয়াদিল্লি দ্রুতই প্রত্যাখ্যান করলেও ইসলামাবাদ তাঁর ‘গঠনমূলক ভূমিকা’কে স্বাগত জানায়। পর্দার আড়ালে যা‑ই ঘটুক, উভয় পাশের সীমান্তে স্বস্তি ছিল স্পষ্ট; নাগরিকেরা আবারও স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজে ফিরতে শুরু করেন—রাওয়ালপিন্ডিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার পরিকল্পনা হোক বা ভারতে ছুটির আয়োজনই হোক।
দুই দেশের দীর্ঘদিনের বৈরিতা কাশ্মীরের বিতর্কিত ভূখণ্ডকে ঘিরে। তবে সাম্প্রতিক সংঘাতে—ভারত‑শাসিত কাশ্মীরে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে ২৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর—ভারত পাকিস্তানের সীমানা পেরিয়ে বিভিন্ন শহরে হামলা চালায়, আর পাকিস্তান ভারতের ৩৬টি স্থাপনার দিকে ৩০০ থেকে ৪০০ টি ড্রোন নিক্ষেপ করে। এই সীমান্ত‑পারাপার লড়াইয়ে পাকিস্তানে ৫১ জন এবং ভারতে কমপক্ষে ১৬ জন নিহত হন।
তারপরও, কয়েক দশকের মধ্যে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সবচেয়ে উত্তপ্ত সামরিক সংঘাতের পর উভয় পক্ষই ‘জয়’ দাবি করায় সীমান্তের উত্তেজনা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি।
তবে সীমান্ত আক্রমণের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে, বিশ্লেষকদের মতে, শুরু হয়েছে এক নতুন অনিশ্চয়তার যুগ। কাশ্মীরের বাইরে গিয়ে পাল্টা হামলা চালানো যদি আগের ‘রেড লাইন’ আর প্রযোজ্য না থাকার ইঙ্গিত দেয় এবং পারমাণবিক অস্ত্র প্রচলিত আক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ রুখে দিল কী, আর ভবিষ্যতে কোন সুরক্ষাবন্ধন তা ঠেকিয়ে রাখতে পারে?
যদিও নয়াদিল্লি দ্রুতই ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়েছে—এমন যুক্তরাষ্ট্রের দাবি উড়িয়ে দেয় এবং যুদ্ধের ফলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির সঙ্গে দুই দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দেয়, তবু ট্রাম্পের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করতে হবে, জানান সিঙ্গাপুর‑ভিত্তিক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের গবেষক অমিত রঞ্জন।
‘ভারত ও পাকিস্তান সরাসরি কথা বলেছে—এটা বিশ্বাস করা কঠিন,’ বলেন রঞ্জন, নিক্কেই এশিয়াকে।
‘এই পরিস্থিতিতে, যে‑ই যা‑ই বলুক, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা খাটো করে দেখা যায় না… তবে সমস্যাটা হলো, আমরা জানি না এই যুদ্ধবিরতির শর্তগুলো কী, কোন শর্তে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে।’
নয়াদিল্লির একাধিক সূত্র নিক্কেই এশিয়াকে জানায়, যুদ্ধবিরতি ‘সরাসরি’ ভারত ও পাকিস্তানের মাঝেই চূড়ান্ত করা হয়েছে।
তবু ১২ মে ট্রাম্প আবারও শুধু যুদ্ধবিরতির কৃতিত্বই দাবি করেননি, বরং ‘পারমাণবিক সংঘাত’ এড়াতেও তিনি কৃতিত্ব দাবি করেন। হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমি বললাম, চলুন, আমরা আপনাদের সঙ্গে অনেক বাণিজ্য করব। থামান… যদি থামান, তাহলে বাণিজ্য চলবে। থামাতে না পারলে কোনো বাণিজ্য হবে না… এবং আমরা পারমাণবিক সংঘাত থামিয়েছি।’
যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি পণ্যে শুল্ক আরোপের ট্রাম্পের বিস্তৃত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২৬ শতাংশ করের মুখে পড়তে হতে পারে, যা ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত; এর মধ্যে দুই দেশ বাণিজ্য চুক্তিতে না পৌঁছাতে পারলে এ কর কার্যকর হবে। একইভাবে, পাকিস্তানের পণ্যের ওপর ২৯ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা রয়েছে, যদি ৯ জুলাইয়ের আগে কোনো চুক্তি না হয়।
রঞ্জনের মতে, ভারত‑পাকিস্তান সম্পর্কে স্বস্তি ফিরতে সময় লাগবে, যদিও নিকট ভবিষ্যতে তা আবারও যুদ্ধমুখী হয়ে উঠবে না। ‘কিন্তু আপনি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেন না; ভারত‑পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কোনো অনুমানই করা যায় না… ইন্দাস ওয়াটারস চুক্তি ও শিমলা শান্তি চুক্তি স্থগিতসহ তারা যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তা নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের দূরত্ব আরও বাড়িয়েছে।’
যুদ্ধবিরতি টিকে থাকবে কি না—সাম্প্রতিক নজির স্থায়িত্বের অনিশ্চয়তা দেখায়। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি ২০২৪ সালের এক গবেষণায় লিখেছেন, ‘উভয় রাজধানীর শীর্ষ নেতৃত্বের সমর্থন’ একটি যুদ্ধবিরতিকে সফল করার জন্য অপরিহার্য শর্ত। গত চার দশকে ২০০০–২০০১, ২০০৩, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২১ সালে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা হয়েছিল; এর মধ্যে কেবল ২০০৩ ও ২০২১ সালের যুদ্ধবিরতিকে সফল বলা যায়।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ব্যাপকতা দেখে র্যান্ড কর্পোরেশনের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ডেরেক গ্রসম্যান আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে দুই দেশ আগের সীমিত বৈরিতার যুগ ছাড়িয়ে গেছে।
‘আমার মতে, এটি আগের যে কোনো রেড লাইন বা সুরক্ষাবন্ধনের ধারণা ভেঙে দিয়েছে, কারণ ১৯৭১ থেকে আজ পর্যন্ত সীমান্ত সংঘর্ষ ও সংকট ছিল অপেক্ষাকৃত সীমিত ও স্থানীয়,’ বলেন তিনি।
গ্রসম্যান আরও বলেন, ‘সংঘাত ফের জ্বললে অভিযানের সীমা ঠিক করতে নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ কখনও—অন্তত প্রকাশ্যে—সম্মত হয়নি, যদিও গোপনে তারা এমন কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে।’ তা সত্ত্বেও, কাশ্মীর‑কেন্দ্রিক অর্ধশতকের সংঘর্ষের ধারাবাহিকতায় ওই সীমারেখাগুলো পর্যবেক্ষকদের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম ড্রোন যুদ্ধ; এতে পূর্বের সীমা অতিক্রমের বিষয়টি দুই দেশের পারমাণবিক অস্ত্রাগারের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে পণ্ডিতদের ভাবিয়ে তুলেছে। পাকিস্তান থেকে ছোড়া অধিকাংশ ড্রোন তুরস্কের আসিসগার্ড নির্মিত সোনগার সামরিক ড্রোন বলে জানিয়েছে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়; অপরদিকে, ভারতীয় বাহিনী একাধিক ইসরাইলি‑নির্মিত ড্রোন ব্যবহার করেছে বলে পর্যবেক্ষকেরা জানান, আর দেশীয় ড্রোন নির্মাতাদের শেয়ারদর ভবিষ্যতের চাহিদার প্রত্যাশায় বেড়েছে।
একই সময়ে, ভারত ও পাকিস্তান কয়েক দশক ধরে সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে প্রতিযোগিতা করে আসছে। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টসের ২০২৫ সালের মার্চ রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তানের পারমাণবিক ওয়ারহেড ১৭০ টি, আর ভারতের ১৮০ টি। কোনো দেশই পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার নিরোধ চুক্তি‑এ যোগ দেয়নি।
‘ভারতের আক্রমণ এবং পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া কোনো একটি এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না; তারা সেই সীমা অতিক্রম করেছে,’ ইসলামাবাদের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজেসের অধ্যাপক তাহির নঈম মালিক বলেন।
‘ফলে পুরো পারমাণবিক প্রতিবন্ধকতা কাঠামোই প্রশ্নের মুখে পড়েছে,’ যোগ করেন তিনি।
কয়েকজন পর্যবেক্ষকের মতে, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরুর অর্থনৈতিক পরিণতিই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার একটি যুক্তিসংগত কারণ হতে পারে; চূড়ান্ত প্রতিবন্ধক হয়তো ট্রাম্পের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কা নয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর অর্থনৈতিক দুরবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের উদ্ধার প্যাকেজ নিতে হয়েছে পাকিস্তানকে। পাশাপাশি চীনের ধারাবাহিক ঋণ পুনর্বিন্যাসে পাকিস্তানের অর্থনীতি টিকে আছে; এ বছর বেইজিংকে ঋণ‑পরিষেবা রেকর্ড পরিমাণে পৌঁছাতে পারে।
অর্থনৈতিক কারণেই ভারতও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চায়নি বলে মনে করেন দিল্লি‑ভিত্তিক অবজারভার রিচার্স ফাউন্ডেশনের গবেষণা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক সহসভাপতি হর্ষ ভি. পান্ত।
তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রাকৃত কোনো প্রণোদনাই ছিল না রুশদের মতো ইউক্রেনে বা ইসরাইলিদের মতো হামাসের সঙ্গে গিয়ে জড়িয়ে পড়ার, কারণ তা ভারতের মূল লক্ষ্য—অর্থনৈতিক উন্নয়ন—থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেবে।’
অ্যাডনান আমীর সহ‑লেখক।