গাঁজার গন্ধে ইতিহাস
নওগাঁ—বাংলার এক প্রান্তিক জেলা, কিন্তু ইতিহাসে ‘গাঁজার রাজধানী’ নাম পেতে এর কষ্ট হয়নি। কেউ কেউ একে বলেন “বাংলার আমস্টারডাম”—তফাৎ শুধু, এখানে কফিশপ নেই, আছে বাঁশঝাড়ের আড়ালে পুরনো দিনের “মস্তানিয়া” গন্ধ।
ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে থেকেই নওগাঁতে গাঁজা চাষ একটি রীতিমতো কৃষিকৌশল ছিল। সেই সময়ে সরকারিভাবে লাইসেন্স নিয়ে গাঁজা উৎপাদন ও বিক্রি হতো। গাঁজা তখন ছিল রাজস্ব আয়ের একটি উৎস। অনেকেই মনে করেন, নওগাঁর মাটি ও আবহাওয়া ছিল গাঁজার জন্য ‘স্বর্গীয়’। পাটের মতো গাঁজাও তখন কৃষকের স্বপ্নের ফসল ছিল।
নিষিদ্ধের নাটক
১৯৮৭ সালের দিকে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে গাঁজা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তখন নওগাঁর গাঁজার মাঠে ধূসরতা নামে—না, ধোঁয়ায় নয়, বরং দীর্ঘশ্বাসে। যারা গাঁজা চাষ করে পরিবার চালাতেন, তারা হয়ে পড়েন বেকার। গাঁজার বদলে কেউ কেউ পটোল চাষ শুরু করলেন, কিন্তু পটোলে তো আর “টান” নেই! ফলে গাঁজার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য একরকম আড়ালে চলে যায়।
তবে নিষিদ্ধ হলেও গাঁজার আভিজাত্য পুরোপুরি মুছে যায়নি। এখনো নওগাঁর বাজারে, বিশেষ করে বর্ধমানপুর, রানীনগর, মহাদেবপুর বা পত্নীতলার আশেপাশে চুপিচুপি “তেলের শিশি ভাঙল বলে” ধরা পড়ে গাঁজার গন্ধ।
বর্তমান গাঁজার চিত্র
গাঁজার এখন অবস্থা অনেকটা সিনেমার ‘প্রাক্তন নায়িকা’র মতো—সবাই মনে রাখে, কেউ সামনে আনে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে গাঁজা নিয়ে গবেষণা এবং ওষুধশিল্পে এর ব্যবহার আবারও আলোচনায় এসেছে। কানাডা, থাইল্যান্ড, জার্মানি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে এখন গাঁজা বৈধ। অর্থাৎ, যাকে আমরা ‘নষ্ট ছেলে’ ভাবতাম, সে এখন চাকরি করছে বৈশ্বিক ফার্মা কোম্পানিতে!
বাংলাদেশেও কিছু বিশেষজ্ঞ এখন গাঁজার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, বৈজ্ঞানিক নিয়ন্ত্রণে গাঁজা চাষ করা গেলে কৃষক লাভবান হবেন, বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও আসতে পারে।
‘গাঁজার অর্থনীতি’: ব্যতিক্রম নয়, সম্ভাবনা
অনেকে হয়তো ভ্রু কুঁচকে বলবেন, “গাঁজায় উন্নয়ন? কেমন কথা!” কিন্তু হিসেব বলছে, বিশ্বজুড়ে ২০২৫ সালে গাঁজা-ভিত্তিক পণ্যের বাজার হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। থাইল্যান্ড যেখানে নিজেদের গাঁজাকে ‘ওষুধ এবং অর্থনীতি’র মাধ্যম বানিয়েছে, বাংলাদেশই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?
নওগাঁর কৃষকরা যদি গাঁজার চাষ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করতে পারেন—ওষুধ, রেশমি কাপড়, সুগন্ধি তেল, এমনকি রফতানিযোগ্য পণ্যের বিশাল বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব।
হালকা ধোঁয়ার মাঝে ভবিষ্যতের স্বপ্ন
নওগাঁর বয়স্ক কৃষকরা এখনো বলেন, “গাঁজা থাকলে টাকা থাকত, ঘর থাকত, আর টান থাকত!” হয়তো সে টান আজ আর ‘সিগারেটীয়’ নয়, কিন্তু অর্থনীতির টান ঠিকই কাজ করতে পারে।
যদি সঠিক নীতিমালায়, গবেষণার মাধ্যমে এবং আইনগত কাঠামো মেনে গাঁজাকে ফিরিয়ে আনা যায়, তবে নওগাঁ শুধু গাঁজার গন্ধে নয়, উন্নয়নের ধোঁয়াতেও দেশকে মাত করতে পারে।
শেষ কথা: “গাঁজা” মানেই “গন্ডগোল” নয়
গাঁজা নিয়ে যত মজা-ঠাট্টা থাকুক, বাস্তবে এটি একটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক সম্পদ। একটু বিজ্ঞান, একটু সচেতনতা, আর সরকারী সদিচ্ছা থাকলেই নওগাঁর গাঁজার ধোঁয়া হতে পারে বাংলার ভবিষ্যতের ‘সবুজ আলো’।
সংক্ষেপে বলতে গেলে: গাঁজা নষ্ট ছেলের গল্প নয়, বরং সুযোগ পেলে ‘ঘরের ছেলে’ হয়ে উঠতে পারে। এখন দেখার বিষয়—বাংলাদেশ কি এ সুযোগকে গ্রহণ করবে, নাকি শুধু গন্ধ শুঁকে পাশ কাটিয়ে যাবে?