বুয়েনস আয়ার্সে মধ্যবর্তী নির্বাচনে চমকপ্রদ ফলাফল
আর্জেন্টিনার জন্য এই নির্বাচন ছিল একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। যেখানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে সিটি কাউন্সিলের অর্ধেক আসনের নির্বাচন খুব একটা গুরুত্ব পায় না, আর্জেন্টিনায় তা রীতিমতো জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ১৮ মে বুয়েনস আয়ার্সে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই তার দলের মুখপাত্রকে প্রধান প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান এবং একে কার্যত তার সরকারের ওপর গণভোট হিসেবেই উপস্থাপন করেন।
এই নির্বাচনে মিলেইর দল পায় ৩০ শতাংশ ভোট, যা বামপন্থী পেরোনিস্টদের ২৭ শতাংশ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মৌরিসিও মাক্রির মধ্য-ডানপন্থী দল PRO-র ১৬ শতাংশ ভোটের চেয়ে বেশি। ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আর্জেন্টিনার শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং রাষ্ট্রীয় বন্ডের দাম বাড়ে।
মাক্রির ঘাঁটিতে মিলেইর জয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মাক্রির শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকায় এই পরাজয়ের পর মিলেই এখন তাকে পুরোপুরি রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন এবং অক্টোবরের জাতীয় মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগেই PRO দলটিকে আত্মসাৎ করার প্রচেষ্টায় রয়েছেন।
২০২৩ সালের শেষ দিকে একজন ক্ষুব্ধ “বহিরাগত” প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই মিলেই আর্জেন্টিনার রাজনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন আনেন। সরকারি ব্যয় ব্যাপকভাবে কমানো ও দমনমূলক মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পর এপ্রিল মাসে আংশিকভাবে মুদ্রা বিনিময় হার উন্মুক্ত করা হয়। তবে এইসব পদক্ষেপ আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়, কারণ দীর্ঘদিনের ভুল অর্থনৈতিক নীতির ইতিহাস রয়েছে এই দেশে।
নিম্ন ভোটার উপস্থিতি ও রাজনীতির নোংরা রূপ
এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৫৩ শতাংশ—যা বাধ্যতামূলক ভোটদানের পরেও ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন। বিশ্লেষকদের মতে, এ থেকে দুইটি প্রধান বার্তা উঠে আসে।
প্রথমত, আর্জেন্টিনার রাজনীতি আরও উত্তপ্ত ও বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। মিলেই তার রাজনৈতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালানোয় অভ্যস্ত, এবার তার লক্ষ্য সংবাদমাধ্যম। তিনি বলছেন, “মানুষ সাংবাদিকদের যথেষ্ট ঘৃণা করে না।” এই নির্বাচনের জন্য তিনি তার মুখপাত্রকে প্রার্থী করেন, কিন্তু পদে বহাল রাখেন এবং নির্বাচনের সময় নানা আকর্ষণীয় ঘোষণা দেন।
এছাড়া নির্বাচনের আগের রাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা একটি ভুয়া ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে দেখানো হয়, মাক্রি নাকি মিলেইর দলকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন পেরোনিস্টদের ঠেকাতে। এই ভিডিও ছড়ানোর পেছনে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর হাত ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই বাজি ধরেছে সরকার
দ্বিতীয় বার্তাটি হলো, সরকার মনে করছে মূল্যস্ফীতি কমানোই ভোটে জেতার একমাত্র রাস্তা। তাই আইএমএফের প্রভাব ও অভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে পড়ে মুদ্রা বিনিময় হার আংশিকভাবে উন্মুক্ত করলেও, তারা যেকোনো মূল্যে পেসোকে শক্তিশালী রাখতে চায়। এ কারণে উচ্চ সুদের হার বজায় রাখা হয়েছে, বিদেশিদের পেসোতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য নিয়ম শিথিল করা হয়েছে।
এছাড়া অস্থায়ী কর ছাড়ের মাধ্যমে সয়াবিন রপ্তানিকারকদের দ্রুত ফসল বিক্রি করতে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে পেসোর চাহিদা বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে, এক ডলারের বিপরীতে পেসোর মান ১০০০ না হওয়া পর্যন্ত তারা ডলার কিনবে না। বাজারে গুঞ্জন রয়েছে, সরকার ফিউচার মার্কেটেও হস্তক্ষেপ করছে পেসোকে শক্তিশালী রাখার জন্য।
আবার কর ফাঁকি সংক্রান্ত নিয়ম শিথিল করার পরিকল্পনাও রয়েছে, যাতে ঘরে লুকিয়ে রাখা প্রায় ২৭০ বিলিয়ন ডলার আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে ফিরিয়ে আনা যায়।
স্বল্পমেয়াদে সাফল্য, দীর্ঘমেয়াদে অনিশ্চয়তা
এই কৌশল আপাতত কাজে দিচ্ছে। পেসোর মান পতন সীমিত ছিল, এপ্রিল মাসে মাসিক মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ২.৮ শতাংশে। বিজয়ের পরে পেসোর ওপর বাজারের আস্থা বেড়েছে, যার ফলে বন্ডের দামও বেড়েছে।
তবে এই সফলতা দীর্ঘস্থায়ী নাও হতে পারে। জুলাইয়ে ফসল মৌসুম শেষ হলে রপ্তানী হ্রাস পেলে পেসোর ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। পেসোর মান বেশি থাকলে রপ্তানি প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। অথচ আইএমএফ-এর নতুন কর্মসূচি অনুসারে জুনের মধ্যে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার লাগবে, যার জন্য সরকার ঋণ নিতেও প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে পেরোনিস্টদের আসনসংখ্যা বেড়েছে বুয়েনস আয়ার্সে। যদি তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভালো করে, তাহলে জনগণের মধ্যে আবার আতঙ্ক তৈরি হতে পারে, পেসো বিক্রি শুরু হলে মূল্যস্ফীতি ফিরে আসবে।
এই মুহূর্তে জাভিয়ের মিলেই আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু তার জয়যাত্রা কতটা স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করছে মূল্যস্ফীতির গতি, রপ্তানি সক্ষমতা, এবং রাজনীতিতে বিরোধীদের মোকাবেলার ওপর। অক্টোবরের নির্বাচনই হবে তার জন্য বড় পরীক্ষা।