বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে এক ভারতীয় শিক্ষকসহ মোট ১৪ জনকে পুশ-ব্যাক করার ঘটনায় ভারতের গুয়াহাটি হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে বুধবার।
মঙ্গলবার ভোররাতে বিএসএফ ওই ব্যক্তিদের পুশ ব্যাক করে বলে অভিযোগ।
এদেরই একজন, খাইরুল ইসলাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কুড়িগ্রামের স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে ওই ভিডিওতে তিনি দাবি করেছেন।
কুড়িগ্রামের সংবাদকর্মী সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন যে তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে মি. ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেটি বাংলাদেশের ভেতরে।
মি. হোসেনের ধারণ করা একটি ভিডিওতে খাইরুল ইসলাম দাবি করেছেন, তার বাড়ি আসামের মরিগাঁও জেলার মিকিরভেটা থানা অঞ্চলে। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক।
আসামের গুয়াহাটি হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন, তিনি খাইরুল ইসলামের আইনজীবী ছিলেন এবং তাকে ভালো করেই চেনেন মরিগাঁওয়ের শিক্ষক হিসেবে।
তিনি এও জানিয়েছেন যে মি. ইসলামের নাগরিকত্ব নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছিল এবং সেই মামলা এখন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে চলছে।
“যার মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে, তাকে কীভাবে সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে ঠেলে দেওয়া হলো! দেশে কি কোনো আইনকানুন নেই?” প্রশ্ন মি. চৌধুরীর।
তিনি বুধবার গুয়াহাটি হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেছেন, যেটি বৃহস্পতিবার শুনানির জন্য উঠতে পারে।
খাইরুল ইসলাম (সামনে দাঁড়িয়ে)-সহ ১৪ জনকে পুশ ব্যাক করা হয়, (বাকিরা বসে আছেন)
খাইরুল ইসলাম যা বলেছেন
কুড়িগ্রামের স্থানীয় সংবাদকর্মী সাখাওয়াত হোসেন যে ভিডিওটি বিবিসিকে পাঠিয়েছেন, সেখানে খাইরুল ইসলামকে নিজের বাবা-মায়ের নাম, আসামের মরিগাঁও জেলার মিকিরভেটা থানার খন্ডপুকুরি গ্রামে যে তার বাড়ি, সেসব বলেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, গত ২৩শে মে তারিখে তাকে বাড়ি থেকে “উঠিয়ে নিয়ে এসেছে বর্ডার পুলিশ” এবং পরের দিন এসপি অফিসে নিয়ে আসা হয় তাকে।
সেখানেই তার এবং অন্যান্যদের হাতের দশ আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। তারপর তাদের আসামের গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়াতে যে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ আছে বিদেশিদের জন্য, সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
সোমবার হঠাৎ করেই তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ডেকে নেওয়া হয় কোথাও যেতে হবে বলে।
“আমি বলেছিলাম তাহলে বেডিং (বিছানা) নিন। তো বলে বেডিং নিতে হবে না। তা কেন বেডিং নিতে হবে না, সেটা তো বলবে! আমিই তখন বাকিদের বলি যে কেউ যাবে না – বেডিং কেন নেবে না, সেটা বলতে হবে,” জানিয়েছেন মি. ইসলাম।
তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন বলে তাকে খুব মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন মি. ইসলাম।
তার কথায়, “এরকমভাবে মেরেছে, বাবারে.. আমি জন্মে এরকম মার খাইনি।”
একটা সময়ে তার মনে হয়েছিল যে মারতে মারতে বোধহয় তাকে মেরেই ফেলবে।
এরপরে তাদের চোখ বেঁধে, হাত পিছমোড়া করে বেঁধে সীমান্তে নিয়ে আসা হয় বলে জানিয়েছেন মি. ইসলাম।
সেখানে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ মি. ইসলামের। তবে তাদের খাবার দেওয়া হয়েছিল।
তারপর সীমান্তে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে তাদের ‘পুশ-ব্যাক’ করিয়ে দেওয়া হয়।
বিজিবি সদস্যরা খাইরুল ইসলাম সহ ১৪জনকে ভারতে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেন – প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশে আসার পরে যা ঘটে
কুড়িগ্রামের স্থানীয় সাংবাদিক সাখাওয়াত হোসেন বিবিসিকে জানিয়েছেন, সীমান্ত পেরোনোর পরে আবু সৈয়দ নামে এক স্থানীয় বাংলাদেশির বাড়িতে ওঠেন ওই ১৪ জন।
এই সময়ে বিজিবি এই ১৪ জনকে আবার ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে জানা যাচ্ছে স্থানীয় সূত্রগুলো থেকে।
কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ বলে সেদিকে যেতে বাধা দেয়।
তারপর তারা সীমান্তের জিরো লাইনেই বসে ছিলেন।
সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, সর্বক্ষণ ভারতের দিক থেকে ড্রোন দিয়ে এই ১৪ জনের ওপরে নজর রাখা হচ্ছিল। দিনের বেলা সেই ড্রোন ওড়ার ভিডিও তিনি নিজেই রেকর্ড করেছেন।
আবার রাতেও নজরদারি চলেছিল বলে তিনি জানতে পেরেছেন।
বুধবার সকালে অবশ্য ওই ১৪ জনকে সীমান্তে আর দেখা যায়নি।
খাইরুল ইসলাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দাঁড়িয়ে যে ভিডিও সাক্ষাতকার দিয়েছেন, তার কয়েকদিন আগে আসামের একটি স্থানীয় নিউজ পোর্টালে প্রচারিত একটি ভিডিও সংবাদেও মি. ইসলামকে দেখা গেছে।
সেই সময়ে মরিগাঁও পুলিশ আরও কয়েকজনের সঙ্গে তাকে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে আটক করেছিল। ওই ভিডিওতে মি. ইসলাম পরিষ্কার অসমীয়া ভাষায় কথা বলেছিলেন।
বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে খাইরুল ইসলামের দেওয়া বক্তব্যের পরে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুয়াহাটি সীমান্ত অঞ্চলের তরফে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
সেখানে তারা জানিয়েছে, মঙ্গলবার খুব ভোরে আসামের দক্ষিণ শালমারা মানকাছার জেলায় ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে “বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি বড় দল অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে তা সফলভাবে প্রতিহত করা হয়েছে।”
বিএসএফের বিবৃতিতে দক্ষিণ শালমারা মানকাছারের ঠিক কোন এলাকায় তারা ‘বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশের চেষ্টা প্রতিহত’ করেছেন তা উল্লেখ না করা হলেও কাছাকাছি অঞ্চল দিয়েই খাইরুল ইসলামদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে ‘পুশ-ব্যাক’ করানো হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে।
তবে বিএসএফ ‘পুশ ব্যাক’ করানোর ঘটনা কখনোই স্বীকার করে না।
আসাম পুলিশ শনিবার থেকে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে বলে অভিযোগ – প্রতীকী ছবি
শনিবার থেকে আসামে বিশেষ অভিযান
মানবাধিকার সংগঠন সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস বলছে, গত শনিবার থেকে নানা জেলা থেকে কয়েকশো ব্যক্তিকে আটক করা হচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে আসামের বিদেশি ট্রাইব্যুনাল থেকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা লোকও যারা পরবর্তী সময়ে গৌহাটি হাইকোর্ট বা ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জামিনও পেয়েছেন।
“সংখ্যাটা কয়েকশো,” বলছিলেন ‘সিটিজেন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ বা সিজেপির আসাম রাজ্য ইনচার্জ পারিজাত নন্দ ঘোষ।
তিনি বলছিলেন, “আটক হওয়া নারী পুরুষদের গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়াতে বিদেশি ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়েছে বলে কিছু সূত্রে জানা যায়, যদিও পরিবারের সদস্যদের কিছুই বলা হয়নি। না বর্ডার পুলিশ, না থানা, না ডিটেনশন ক্যাম্পে আধিকারিকরা।”
এই খবর পেয়ে মঙ্গলবার সারাদিন সিজেপির আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে মি. ঘোষ ওই ক্যাম্পের সামনেই ছিলেন।
“ভিক্টিম পরিবারের বহু মানুষ ক্যাম্পের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। তাদের তো কর্তৃপক্ষ পাত্তাই দেয়নি। আমরা যখন আইনজীবীদের নিয়ে তথ্য জানতে চাই, তখনও কিছুই জানানো হয়নি। আইনি সহায়তা দেওয়ারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। জেলারের সঙ্গে দেখা করার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই আমরা।”
“এমনকি কোথায় কোথায় আইন ভঙ্গ হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের অর্ডারসহ মেমোরেন্ডামও দেওয়া হয়, সেটাও নেননি ডিটেনশন ক্যাম্পের অথরিটি”, জানিয়েছেন মি. ঘোষ।
তিনি আরও জানান, এরা কিন্তু কেউ সাজাপ্রাপ্ত বিদেশি বা সিএফএন (কনভিক্টেড ফরেন ন্যাশনাল) নয়।
ট্রাইবুনালে এরা বিদেশি ঘোষিত হয়েছেন। সবাই তো জানে আসামে এই বিদেশি ট্রাইব্যুনালগুলো কীভাবে কাজ করে, কী ধরনের পক্ষপাতিত্ব কাজ করে এখানে। বেশিরভাগ সময়েই সামান্য বানান ভুল বা তারিখের সামান্য ভুলের কারণেও বিদেশি বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়।
“আবার যারা উচ্চতর আদালত – হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে যান, তাদের জামিনও হয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, ” ডিটেনশন ক্যাম্পে যারা মারা গিয়েছেন,মৃতদেহ কিন্তু একটিও বিদেশে পাঠানো হয়নি। পাঠানো হয়েছে আসামে থাকা বাড়ির আত্মীয়র কাছেই।”
তিনি বলেন, “আসলে বিদেশির নামে এখানে দরিদ্র, শিক্ষাহীন, শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষগুলো শুধু হেনস্তা করে এক ত্রাসের চেষ্টা করা হচ্ছে! ভারতের একজন শিক্ষক, যিনি আসাম সরকারের চাকরি করেন, তার ভিডিও যখন নো মেন্স লেন্ড থেকে আসে সেটা কি লজ্জাজনক না?”
আসামের বিদেশি ট্রাইব্যুনাল – ফাইল ছবি
গুয়াহাটিতে মামলা দায়ের
গুয়াহাটি হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হাফিজ রশিদ চৌধুরী বলছেন, “যাদের গত কয়েকদিনে আটক করা হয়েছে, তাদের অনেকেরই আদালতে মামলা চলছে। আর এটা করা হচ্ছে একটি মাত্র সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে। বেশিরভাগ আটক হওয়া মানুষই কিন্তু মুসলমান।”
“আর এইভাবে পুশ-ব্যাক করা তো আইন বিরুদ্ধ। যদি কেউ বিদেশি থেকেও থাকেন এদের মধ্যে, তাও এটা করা যায় না। এর আগে এই আসাম সরকারই এফিডেফিট দিয়ে আদালতে বলেছিল যে ২০১৩ সালের পর থেকে আর কোনো পুশ-ব্যাক করা হয় না, প্রত্যর্পণ করা হয়। প্রত্যর্পণের নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, সেভাবে করতে পারত,” বলছিলেন মি. চৌধুরী।
তিনি এও বলছিলেন, যেভাবে বাড়ি থেকে উঠিয়ে আনা হচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই তথ্য পরিবারের অন্য সদস্যদের জানানো হচ্ছে না, সেটা সংবিধানের পরিপন্থি।
“একজন বিদেশি নাগরিকেরও এই অধিকার আছে। আমি বুধবারই হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছি। আশা করছি যে বৃহস্পতিবার মামলা শুনানির জন্য উঠবে,” জানিয়েছেন মি. চৌধুরী।
গুয়াহাটি হাইকোর্টে খাইরুল ইসলামের আইনজীবী ছিলেন হাফিজ রশিদ চৌধুরী।
“তাকে একবার ডিটেনশনে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনার সময়ে তিনি শর্তসাপেক্ষে জামিন পান। জামিনের শর্ত সবই মেনে চলছিলেন তিনি। হাইকোর্টের কেসটায় আমরা হেরে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তারপর তো তিনি সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে,” বলছিলেন হাফিজ রশিদ চৌধুরী।
সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে যে খাইরুল ইসলামের মামলার সর্বশেষ শুনানি হয়েছে ২০২৪ সালে ১৭ই ডিসেম্বর।
সেদিন আদালত নির্দেশ দিয়েছিল যে বিদেশি ট্রাইব্যুনাল থেকে মূল নথি যেন কোর্টে পেশ করা হয়।
অর্থাৎ মামলার কোনো রায় হয়নি সেদিনও।
মামলা চলাকালীন কী করে একজন ব্যক্তিকে অন্য দেশে ঠেলে দেওয়া হলো, তা নিয়ে বিস্মিত হাফিজ রশিদ চৌধুরী।
বিবিসি নিউজ বাংলা