কেরোসিনের মূল্য বৃদ্ধি ও অন্যান্য জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়
সরকার শনিবার (৩১ মে) রাতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা করেছে, আগামীকাল রবিবার (১ জুন) থেকে কার্যকর হবে জ্বালানি তেলের নতুন মূল্য। এতে কেরোসিনের দাম লিটারে ১০৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, ডিজেলের দাম লিটারে ১০৪ টাকা থেকে কমিয়ে ১০২ টাকা, পেট্রলের দাম ১২১ টাকা থেকে ১১৮ টাকা এবং অকটেনের দাম ১২৫ টাকা থেকে ১২২ টাকা রাখা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে এবং এর প্রভাব কোথায় কীভাবে পড়তে পারে—সেগুলো সংক্ষেপে নিম্নে তুলে ধরা হলো।
মূল্য পরিবর্তনের কারণ
অটোমেটিক মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা
২০২৪ সালের মার্চ থেকে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অটোমেটিকভাবে নির্ধারণ করছে। এতে প্রতি মাসে গড় আন্তর্জাতিক দর, ডলারের বিনিময় হার, পরিবহন ও আমদানি খরচ ইত্যাদি বিবেচনা করে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত যানবাহনে বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় পেট্রল ও অকটেনের দাম ডিজেলের তুলনায় সামান্য উঁচুমানের রাখা হয়।
ভেজাল রোধ ও গুণগত মান রক্ষা
অনেকে কেরোসিনের সঙ্গে পেট্রল কিংবা অন্যান্য তেল মিশিয়ে বিক্রি করেন, যা নিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভোক্তা প্রতারণার সুযোগ তৈরি করে। কেরোসিনের দাম কম থাকার কারণে এ ধরনের মিশ্রণের প্রবণতা বাড়ছে বলে সরকার উদ্বিগ্ন। তাই ভেজাল রোধ ও মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কেরোসিনের পাইকারি ও খুচরা মূল্যে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি আনা হয়েছে।
সরকারি রেভিনিউ ও বাজেট চাহিদা
কৃষি, বিদ্যুৎ ও উন্নয়নমূলক কাজ সহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালাতে অতিরিক্ত আর্থিক সংস্থান প্রয়োজনীয়। অন্যান্য জ্বালানি তেলের ছোটখাট হ্রাস সত্ত্বেও কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে সরকারের কর ও শুল্কের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়েছে।
ভোক্তাদের ওপর প্রভাব
নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর চাপ
গ্রামাঞ্চল ও শহরের নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন রান্না ও আলোচালনার জন্য কেরোসিনের ওপর নির্ভর থাকে। এক লিটার কেরোসিনের দামে লিটারে ১০ টাকা বৃদ্ধি হওয়ায় মাসিক গড় গৃহস্থালি খরচে ৫০০–৭০০ টাকা অতিরিক্ত বোঝা পড়তে পারে। বিশেষ করে সোলার বা গ্যাস সংযোগবিহীন গ্রামাঞ্চলে এর প্রভাব আরও বেশি অনুভূত হবে।
ছোট ব্যবসায়ী ও দোকানপাটের অসুবিধা
কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যেমন প্যারাফিন মুদ্রণ কেন্দ্র, ল্যামিনেশন দোকান, ছোট হোটেল-মেস ইত্যাদি রান্না ও কাজের জন্য কেরোসিন ব্যবহার করে। কেরোসিনের দাম বাড়লে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যা শেষমেশ পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি করে সাধারণ ভোক্তার ওপর অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করবে।
প্রান্তিক কৃষক ও পশুপালকদের কষ্ট
গ্রামে ছোট খামারিরা জেনারেটর বা পাম্প চালানোর জন্য কেরোসিন ব্যবহার করে থাকেন। দাম বাড়ায় তাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাবে, ফলে আয়ের মার্জিন সংকুচিত হবে এবং ক্ষুদ্রকৃষকদের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়া
পেট্রোল পাম্প মালিকদের উদ্বেগ
ঢাকার উত্তরা এলাকায় একটি পেট্রোল পাম্পের ইনচার্জ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “অনেকে কেরোসিনের সঙ্গে ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করে। আগে দাম কম থাকায় বিক্রয় সীমিত রাখতে হিমশিম খেতাম। দাম বাড়লে বাজার নিয়ন্ত্রণ কিছুটা সহজ হবে, ভেজাল মেশানো কমানো যাবে।”
রেস্তোরাঁ ও হোটেল মালিকদের ভাবনা
মিরপুরের ছোট একটি রেস্তোরাঁর মালিক শামিমা বেগম জানান, “জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে রান্নার খরচ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে। আমাদের লাভের মার্জিন সংকুচিত হবে। পেট্রল ও ডিজেলে হ্রাস হলেও কেরোসিনের দাম বাড়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলতে হবে।”
ভোক্তা অধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
ভোক্তা অধিকার সংস্থা ‘পর্যাপ্ত বাজার সংরক্ষণ সমিতি’র সভাপতি স্নেহা মুখোপাধ্যায় বলেন, “নিম্ন আয়ের মানুষ কেরোসিন ব্যবহার করে জীবন চালিয়ে যায়। এ দামে বৃদ্ধির ফলে তাদের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হতে পারে। সরকারের উচিত ভর্তুকি বা বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে তাদেরকে সহায়তা করা।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অর্থনীতিবিদ ইনামুল হকের বিশ্লেষণ
“জ্বালানি তেলের অটোমেটিক মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী স্বাভাবিক ওঠানামা সৃষ্টির সুযোগ দেয়। তবে কেরোসিনের মতো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভরসা জ্বালানির দাম বেশি হলে তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সরকারের উচিত অন্য ভ্যাট বা শুল্ক কমিয়ে দরিদ্র ভোক্তাদের বোঝা কমানো।”
পরিবেশ বিজ্ঞানী ডা. রোজিনা পারভীনের মন্তব্য
“কেরোসিন ধোঁয়াযুক্ত ও দূষণকারী তেল। এর দাম বাড়লে কিছু মানুষ সোলার ল্যাম্প, এলইডি বাতি বা আরও অপেক্ষাকৃত পরিবেশবান্ধব বিকল্প খুঁজে নিতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।”
নীতিনির্ধারণে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
উৎপাদনশীল ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “কেরোসিনের বাজারে ভেজাল রোধ ও গুণগত মান নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ না থাকায় দাম বাড়িয়ে স্বল্পমাত্রায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
ভবিষ্যৎ প্রভাব ও সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন
কেরোসিনের দামে এই বেড়ে যাওয়ার ফলে ভেজাল প্রতিরোধে সহায়তা হবে, গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং সরকার অতিরিক্ত রাজস্ব পাবে—এসব ইতিবাচক দিক। তবে নিম্ন আয়ের পরিবারের গৃহস্থালি ব্যয় বৃদ্ধি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া—এসব নেতিবাচক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘমেয়াদে, যদি সরকার বিদ্যুৎ ও সোলার আলো ব্যবহারের প্রসারিত উদ্যোগ না নেয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীতে।
সংক্ষেপে, কেরোসিনের দামের এই পরিবর্তন অটোমেটিক মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ার অংশ হলেও বিতর্কিত। আগামী সময়ে বাজারের প্রতিক্রিয়া এবং ভোক্তাদের জীবনযাপনের ওপর এর সঠিক প্রভাবই নির্ধারণ করবে সিদ্ধান্তের সার্থকতা। সরকারের উচিত দুর্বল শ্রেণীর জন্য ভর্তুকি বা বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থা এনে তাদের ওপর বোঝা কমানো।