আমেরিকায় পড়াশোনার আগ্রহে ভাটা
চীনা শিক্ষার্থীদের জন্য আমেরিকায় পড়াশোনার ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। গত ২৮ মে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা দিয়েছে, তারা “জোরালোভাবে” কিছু চীনা ছাত্রছাত্রীর ভিসা বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করবে। এর আওতায় প্রধানত বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পড়বেন, যাদের শিক্ষাগত ক্ষেত্রকে চীনের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত মনে করা হচ্ছে। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থীর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযোগ রয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। ঠিক কতজন শিক্ষার্থী এই অভিযানের আওতায় পড়বেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে এতেই অনেক চীনা পরিবার আমেরিকায় উচ্চশিক্ষাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতে শুরু করেছে।
করোনা, খরচ ও আর্থিক সংকটে কমেছে আগ্রহ
চীনা শিক্ষার্থীদের আমেরিকায় আগমনের হার নতুন এই নীতির আগেই কমতে শুরু করেছিল। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে সর্বোচ্চ ৩.৭২ লাখ চীনা শিক্ষার্থী আমেরিকায় পড়ছিলেন। এরপর কোভিড-১৯ এর কড়াকড়ি ও লকডাউনের কারণে এই সংখ্যা দ্রুত কমে যায়। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে আমেরিকায় পড়ছেন মাত্র ২.৭৭ লাখ চীনা শিক্ষার্থী।
মধ্যবিত্ত চীনা পরিবারগুলো এখন এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে অতিমূল্যবান ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন। অনেকেই যুক্তরাজ্য, হংকং, সিঙ্গাপুর বা এমনকি জাপানের মতো দেশকে নিরাপদ ও অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিযুক্ত বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছেন। ২০২৩ সালে জাপানে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১.১৫ লাখে পৌঁছেছে, যেখানে ২০১৯ সালে তা ছিল ১ লাখের কম।
‘সী টার্টল’ থেকে সন্দেহের চোখে দেখা
গত চার দশকে প্রায় ৩০ লাখ চীনা শিক্ষার্থী আমেরিকায় পড়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই ফিরে এসে ‘হাইগুই’ (সমুদ্র পেরিয়ে ফেরা) নামে পরিচিত হয়েছেন এবং দেশীয় কর্পোরেট ও সরকারে কাজ করেছেন। এমনকি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর কন্যাও হার্ভার্ডে পড়েছেন। তবে এখন এই ডিগ্রির আর আগের মতো কদর নেই।
চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা, রিয়েল এস্টেট খাতের পতন এবং চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতির কারণে বিদেশি ডিগ্রি আর আগের মতো সুবিধা এনে দিতে পারছে না। তদুপরি, কিছু বড় প্রতিষ্ঠান হাইগুইদের নিয়োগে অনীহা দেখাচ্ছে। এপ্রিল মাসে চীনের একটি বড় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি গ্রী ইলেকট্রিকের চেয়ারম্যান ডং মিংজু বলেছিলেন, তারা বিদেশফেরতদের নিয়োগে সাবধানতা অবলম্বন করেন, কারণ তারা বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন।
দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় আত্মবিশ্বাস বাড়ছে
চীনের অভ্যন্তরীণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান এখন অনেক উন্নত হয়েছে, বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রকৌশল ক্ষেত্রে। বেইজিংয়ের তসিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জীববিদ্যার পিএইচডি শিক্ষার্থী বলছেন, “চীন আমেরিকাকে ধরে ফেলবে, এমনকি অতিক্রম করতেও পারবে। আমাদের শুধু একটু সময় দরকার।” তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপকরা আমেরিকায় পড়েছেন, কিন্তু তরুণরা মূলত চীনেই শিক্ষিত।
নতুন প্রজন্মের পছন্দ স্থানীয়তা
চীনের নিম্ন জন্মহার ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বিদেশি স্কুলে সন্তান পাঠানোর আগ্রহ হ্রাস পাওয়ার ফলে ভবিষ্যতে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও কমবে বলে মনে করেন শিক্ষা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভেঞ্চার এডুকেশনের জুলিয়ান ফিশার। অনেক অভিভাবক এখন তাদের সন্তানদের স্থানীয় শিক্ষায় গড়ে তুলতে আগ্রহী, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক ধরনের ‘টাইম বোমা’ হয়ে উঠছে। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো প্রতিষ্ঠান, যারা চীনা শিক্ষার্থীদের ফি-নির্ভর হয়ে পড়েছে, তারা ভবিষ্যতে সংকটে পড়তে পারে।
ভিসা নীতির প্রতিক্রিয়া: নির্লিপ্ততা ও আত্মনির্ভরতা
চীনের তরুণদের মধ্যে অনেকেই এই নতুন ভিসা নীতিতে খুব একটা বিচলিত নন। বেইজিংয়ের বিহাং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্যাটেলাইট প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করা শিক্ষার্থী বলেন, তিনি বুঝতে পারেন কেন আমেরিকা চীনা নাগরিকদের তাদের হাই-টেক প্রোগ্রামে প্রবেশ করতে দিতে চায় না। তবে তিনি মনে করেন, এতে দেশের অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও উন্নয়ন আরও সমৃদ্ধ হবে। আরেকজন পিএইচডি গবেষক ঝাং বলেন, “আমরা আমেরিকার আচরণ পরিবর্তন করতে পারব না। কিন্তু আমরা যদি নিজেদের উন্নয়ন ঠিকমতো চালিয়ে যাই, তাহলে প্রতিটি বাধাও সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।”