Prince Bakery – ঢাকার ‘নিউ মিডল ক্লাস’ রুচির প্রতীক
ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় একসময় সকাল-বিকেল ভিড় জমত শুধুমাত্র একটি দোকানের সামনে—সেই দোকানের নাম Prince Bakery। গরম ফ্রুট কেক, নারকেল বিস্কুট কিংবা কাস্টার্ড বান—সবই ছিল এই বেকারির আইকনিক পণ্য। আজও বহু মানুষ ‘প্রিন্সের কেক’-এর নাম শুনলে ফিরে যান নস্টালজিয়ায়। এই বেকারির উত্থান, বিস্তার ও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়া যেন মধ্যবিত্ত ঢাকার আবেগ ও রুচির গতিপথেরই প্রতিচ্ছবি।
শুরুটা কোথা থেকে?
১৯৫২ সাল। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল ঢাকা শহরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি গড়ে উঠতে থাকে কিছু ব্যবসায়িক উদ্যোগ, যেগুলো ছিল স্বাধীন বাঙালির স্বতন্ত্র ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। তেমনই এক সন্ধিক্ষণে ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্র ও বেকিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণ ব্যবসায়ী সাজ্জাদ আহমেদ নিউমার্কেট এলাকার গেটে শুরু করেন ছোট্ট একটি কেক ও বিস্কুটের দোকান—Prince Bakery।
তখন নিউমার্কেট এলাকার অবস্থান ছিল বেশ কৌশলগত। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের বাজার করতে আসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আড্ডা, এবং সরকারি চাকরিজীবীদের চলাচল—সব মিলিয়ে এক নিত্যচঞ্চল কেন্দ্র। সাজ্জাদ আহমেদ ঠিক বুঝে যান, এখানকার ভোক্তারা চান এমন কিছু যা সহজে খাওয়া যায়, রুচিশীল, আবার দামে তুলনামূলক সস্তা। সেই জায়গা থেকেই শুরু প্রিন্সের যাত্রা।
এক রুটি, এক কেক, এক শহর
প্রথম দিকে প্রিন্সে পাওয়া যেত ‘কাস্টার্ড বান’, ‘পাউরুটি’ আর ‘ফ্রুট কেক’। তবে ধীরে ধীরে তাদের বিক্রয়যোগ্যতা বাড়ে। ষাটের দশকের শেষদিকে এসে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় Prince Special Fruit Cake। ছোট অ্যালুমিনিয়ামের টিনে বানানো সেই কেক ছিল তুলতুলে, হালকা মিষ্টি এবং ভেতরে ফ্রুট ক্যান্ডি ছড়ানো। বড়দিন কিংবা ঈদে এটি ছিল আবশ্যিক উপহারসামগ্রী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবু সাবের রহমান বলেন—
“আমরা প্রতিবার ডিসেম্বর এলেই প্রিন্স থেকে বড়দিনের ফ্রুট কেক কিনতাম। একসময় তো এই কেকই ছিল আমাদের দাওয়াতি গিফট কালচারের কেন্দ্রবিন্দু।”
এছাড়া প্রিন্সের নারকেল বিস্কুট, পাইরা শুঁটি কুকিজ এবং চিকেন স্যান্ডউইচ বান দারুণ জনপ্রিয় ছিল ছাত্র-ছাত্রী ও ব্যাংক-কর্মচারীদের মাঝে।
প্রিন্সের ব্যবসায়িক ধারা: উন্নত স্বাদ, সাধারণ দাম
প্রিন্স বেকারির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর ‘ভ্যালু ফর মানি’ ধারণা। স্বাদে আপস না করে তারা দামে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে পণ্য রেখেছে বরাবর। অন্যদিকে, কেক ও রুটির জন্য ব্যবহার হতো ভালো মানের ময়দা, দেশি ঘি ও সিজনাল উপাদান। এমনকি, অনেক সময় বিদেশি শুকনো ফল ও ক্যান্ডি আমদানি করেও বানানো হতো ফ্রুট কেক।
১৯৮০ সালের দিকে প্রিন্স তাদের কর্মক্ষেত্রে চালু করে ছোট্ট একটি ওভেন ও কাস্টম মেশিন, যা একদিনে ৩৫০টির বেশি কেক তৈরি করতে পারত। সঙ্গে যুক্ত হয় ৭ জন মহিলা কর্মী, যাঁরা কুকিজের ডো হাতে বানিয়ে দিতেন। এটিও ছিল নারীশ্রমের এক সূক্ষ্ম উত্থান এই বেকারির ভেতরে।
চা দোকান থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত বিস্কুটের রাজত্ব
প্রিন্সের আরেকটি বিখ্যাত পণ্য ছিল ‘বাটার কুকিজ’, যেটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে আশেপাশের চা দোকান, নর্থ হল-জগন্নাথ হল-কার্জন হল এমনকি সংসদ ভবনের ক্যান্টিনেও একসময় প্রিন্স বেকারির বিস্কুট সরবরাহ হতো।
রাজনীতিকদের বিকেলবেলার নাস্তা, সাংবাদিকদের প্রেস ক্লাবের চা, এমনকি বিসিএস পরীক্ষার্থীদের প্রিপারেশন ক্লাস—সব জায়গায় একটা সময় প্রিন্সের নাম ছিল মানের প্রতীক।
প্রযুক্তির ঢেউ ও মন্থরতা
১৯৯৫ সালের পর থেকে ঢাকার খাদ্যখাতে আসে এক ধরনের রূপান্তর। বিদেশি ফুড চেইন, চকচকে সুপার শপ, ব্র্যান্ডেড ফ্র্যাঞ্চাইজি ঢুকতে শুরু করে। ওদিকে Prince Bakery একইরকমভাবে চলে আসছিল পুরনো ঘরানার মেশিন ও রেসিপি নিয়ে। ফলত ২০০৫ সালের দিকে তাদের বিক্রি কমে যায়। নতুন প্রজন্ম ‘স্মার্ট কনজিউমার’ হিসেবে ব্র্যান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হলেও, প্রিন্স নিজের ঐতিহ্যে আবদ্ধ থেকে যায়।
২০০৯ সালে মালিক সাজ্জাদ আহমেদের মৃত্যুর পর তার ছেলে হাবিব আহমেদ কিছুটা চেষ্টা করেন আধুনিকায়নের, কিন্তু সম্পূর্ণ ফ্র্যাঞ্চাইজ রূপে রূপান্তর করতে ব্যর্থ হন। ২০১৪ সালে নিউমার্কেটের মূল দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়।
এখনো টিকে আছে স্মৃতি
আজ হয়তো প্রিন্স বেকারির প্যাকেট হাতে নিয়ে নিউমার্কেটের সামনে কাউকে দেখা যায় না। কিন্তু এখনো পুরান ঢাকা বা মোহাম্মদপুরের কিছু পুরনো দোকানে “প্রিন্স কেকের মতো বানান”—এই অনুরোধ আসে। এখনও কিছু বৃদ্ধা মা বলেন—“তোর বাবার বিয়েতে প্রিন্সের কেক দিয়েছিলাম।”
অর্থাৎ, প্রিন্স এখন স্মৃতির বেকারি। শহরের রুচির ঐতিহাসিক অনুরণন।
রিস্টোরেশনের চিন্তা, না কি জাদুঘর?
২০১৯ সালে কিছু সাবেক কর্মী ও বেকারিপ্রেমী উদ্যোক্তা মিলে ‘Prince Revival Initiative’ নামে একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেন। তাঁদের প্রস্তাব ছিল—নিউমার্কেটের পুরনো দোকানটিকে রেখে একটি ‘Baking Heritage Display Corner’ বানানো।
যেখানে থাকবে সেই পুরনো কেকের ছাঁচ, বিস্কুটের ট্রে, পুরনো বিল খাতা, এবং সেই গোলাপি-কালো রঙের মোড়কের বাক্স।
তবে প্রশাসনিক জটিলতা ও জায়গা দখলের কারণে এখনো সে উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।
Prince Bakery ছিল এক সময় ঢাকার “নতুন মধ্যবিত্ত” সংস্কৃতির পরিচয়। এর প্রতিটি কেক-বিস্কুটের মধ্যে ছিল পরিচ্ছন্নতা, যত্ন ও স্মার্ট সার্ভিসের ছাপ। এখন সে প্রতিষ্ঠান নেই, কিন্তু তার রন্ধ্র দিয়ে তৈরি করা স্বাদ এখনো অনেকের মন-জিভে গেঁথে আছে।
পুরনো ঢাকার কুম্বো বেকারির মতই—প্রিন্সও হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ইতিহাস হয়ে বেঁচে থাকছে।