০২:৫৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় প্রাণীদের ভাষা বোঝার নতুন দিগন্ত

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ইতিমধ্যেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনছে। তবে এখন পর্যন্ত এর প্রয়োগ প্রায় একচেটিয়াভাবে মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) ওপরই কেন্দ্রীভূত ছিল। কিন্তু যদি মানুষ এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে একই গ্রহে বসবাসকারী অমানব প্রাণীদের আরও ভালোভাবে বুঝতে পারত?

এই দিগন্তের দরজাই এখন খুলতে শুরু করেছে। মেশিন লার্নিং ও রোবোটিক্সে নতুন অগ্রগতি প্রাণীদের ভাষা ও আচরণ বিশ্লেষণে এমন গভীরতা ও সূক্ষ্মতা এনেছেযা আগে কল্পনাও করা যেত না। গবেষকেরা এখন হাতিদের পরস্পরের জন্য ব্যবহৃত নাম শনাক্ত করতে পারছেনজানতে পারছেন কীভাবে মথ বা পোকামাকড় গাছের যন্ত্রণার সংকেত শোনেএবং স্পার্ম হোয়েল নামক অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং সামাজিক তিমির ধ্বনি বিশ্লেষণ করে এমন এক জটিল ভাষা আবিষ্কার করছেনযার মধ্যে রয়েছে স্বরবর্ণ ও ধ্বনিগত বর্ণমালার মতো উপাদান — যা মানুষের ভাষার কাঠামোর সাদৃশ্য বহন করে।

আজকের প্রযুক্তি বিশাল তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুমান নয়বরং প্রকৃত অনুবাদ ও আন্তঃপ্রজাতি যোগাযোগের সম্ভাবনা খুলে দিচ্ছে। যেমনভাবে অতীতে দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণ যন্ত্র আমাদের অদৃশ্য জগতের জানালা খুলে দিয়েছিলতেমনি এআইও মানব ইন্দ্রিয়ের আওতার বাইরে থাকা বার্তা অনুধাবনের উপায় দিচ্ছে।

প্রায় ৫০ বছর আগে মানুষের আরেক শ্রবণ অভিযাত্রা শুরু হয়যখন রজার ও কেটি পেইন প্রথম তিমির গান রেকর্ড করেনযা পরে হাম্পব্যাক হোয়েল’ এর গান নামে পরিচিত হয়ে এক জনপ্রিয় অ্যালবামে রূপ নেয়। সেই গান মানবজাতির আবেগে নাড়া দেয়, ‘সেভ দ্য হোয়েলস’ আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেযার ফলে বহু তিমি প্রজাতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। এই আন্দোলনের পেছনে ছিল বিজ্ঞানযা জন্ম দেয় বিস্ময়েরবিস্ময় ডেকে আনে সহানুভূতিসহানুভূতি জাগায় আশাআর সেই আশাই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে।

এই ধরনের বৈজ্ঞানিক অনুপ্রেরণার ভিত্তিতে গৃহীত সম্মিলিত সিদ্ধান্তগুলো মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে। তবে আজকের প্রযুক্তিগতপরিবেশগত ও সামাজিক অস্থিরতার মাত্রাগতি ও ঝুঁকি আরও বহুগুণ বেশি। যেমনএআই একদিকে অমানব প্রাণীদের রক্ষা ও বোঝার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করছেঅন্যদিকে এর অপব্যবহারে সেই প্রাণীদের আরও বেশি শোষণ ও নিপীড়নের ঝুঁকিও রয়েছে। প্রশ্ন হলো: আমরা কি এআই ব্যবহার করে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে পারবনাকি আরও বিচ্ছিন্ন হবআমরা কি প্রাণীদের ভাষা শুনে তাদের অধিক রক্ষা করবনাকি সেই তথ্যকে ব্যবহার করে তাদেরকে আরও পণ্য হিসেবে গণ্য করব?

বিজ্ঞান এখনবিজ্ঞান সাংবাদিক এড ইয়ং এর ভাষায়আমাদের সামনে খুলে দিচ্ছে প্রাণীদের অপরিসীম জগৎ” এবং পরিবেশ আইন ও নীতিমালার এক নতুন অধ্যায়। প্রাণীদের নিজেদের বার্তা তাদের অধিকারের পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে। বহুদিন ধরে প্রাণীদের ভাষাহীনতা তাদের আইনগত অধিকার অস্বীকার করার যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যদি তিমির শব্দ এক পরিশীলিতপ্রাচীন বুদ্ধিমত্তার বহিঃপ্রকাশ হয়যেমনটি বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ৫২ বছর আগে বলেছিলেনযেটি হতে পারে মহাকাব্যইতিহাস বা সামাজিক আচরণের গূঢ় সংকেততবে কী প্রাণীদের জন্যও মানবাধিকারের মত অধিকার স্বীকৃত হতে পারে?

এই প্রশ্নই গবেষণা করছে সেটি’ (CETI – Cetacean Translation Initiative) ও মথ’ (MOTH – More-Than-Human Life Program, NYU Law)। তারা অমানব প্রাণীদের ভাষা অনুবাদের আইনি দিক নিয়ে আন্তঃবিভাগীয়ভাবে কাজ করছে। CETI দেখিয়েছে যে স্পার্ম হোয়েলদের মধ্যে জটিল শ্রবণ ও সামাজিক যোগাযোগের উপাদান রয়েছে। MOTH-এর বিশ্লেষণ বলছেএই গবেষণা বিদ্যমান আইন প্রয়োগে সহায়ক প্রমাণ দিতে পারেআদালতের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারে এবং এমনকি তিমিসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীদের নতুন অধিকার নিশ্চিত করতে পারে।

MOTH ও CETI-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছেতিমিদের ভাষা ভালোভাবে বোঝা গেলে জাহাজের আওয়াজতেল অনুসন্ধানে সিসমিক সার্ভেএবং গভীর সমুদ্রে খনির মতো কার্যক্রম থেকে তাদের অস্তিত্বগত হুমকি প্রমাণ করা সম্ভব হবে। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে এ যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যেঅবিরাম উচ্চ শব্দ তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচারএমনকি নিপীড়নের শামিল। ফলেএই শব্দ থেকে মুক্ত থাকার অধিকার স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তিমিদের ভাষা বোঝার মাধ্যমে বোঝা যাবে তাদের যন্ত্রণাতাদের বধিরতাঅস্বাভাবিক মৃত্যুযা সমুদ্রের নিচের শব্দের সঙ্গে জড়িত। একইসঙ্গে জানা যাবে তাদের সামাজিক জীবনের সমৃদ্ধিবিশেষ ক্লানভিত্তিক ভাষাসাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যসহযোগিতাপূর্ণ আচরণযা সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে জোরালো করবে।

এই বিজ্ঞান আদিবাসীদের প্রাচীন জ্ঞান ও সম্পর্কের সঙ্গে মিলিত হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডতাহিতি ও কুক দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী নেতারা তিমিদের আইনি ব্যক্তিসত্তা স্বীকৃতি দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।

তবে এই বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রায় সতর্কতা জরুরি। যথাযথ আইনি ও নৈতিক রক্ষাকবচ না থাকলে এই প্রযুক্তি সেই প্রাণীদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে যাদের আমরা বুঝতে চাই। প্রাণীদের অধিকার ও কল্যাণ রক্ষায় উৎসাহী বিজ্ঞানীদের এটি বোঝা জরুরি যেএই অধিকার আমাদের ধীরেসংবেদনশীলভাবেএবং সতর্কতার সঙ্গে এগোতে বলে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছেদূরদৃষ্টিহীন প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি হয়েছে। মাইক্রোফোনহাইড্রোফোনড্রোন — এগুলো যেমন বোঝার কাজে ব্যবহৃত হয়েছেতেমনি পর্যবেক্ষণনির্যাতনগবেষণার নামে প্রাণীদের ক্ষতিও করেছে।

এই পরিস্থিতিতে গবেষণা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে তিনটি প্রধান নীতিমালার প্রস্তাবনা দেওয়া হচ্ছে:
১. প্রাণীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
২. তথ্য শাসনের নিয়মযা তৃতীয় পক্ষের অপব্যবহার থেকে সুরক্ষা দেবে।
৩. “সতর্কতামূলক নীতি” (precautionary principle), যাতে কোনো ক্ষতির নিশ্চিত প্রমাণ না থাকলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এছাড়া ৩আর” নীতিমালাযেখানে প্রাণীদের পরিবর্তে বিকল্প উপায় প্রয়োগতাদের ব্যবহার হ্রাসএবং গবেষণায় তাদের ক্ষতির পরিমাণ সর্বনিম্ন করার কথা বলা হয়তা ব্যবহার করা উচিত।

এই ধরনের সুরক্ষা ছাড়া ভবিষ্যতে ডিজিটাল প্রযুক্তি দিয়ে প্রাণীদের আরও শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ করার ঝুঁকি রয়েছে। আজ যেসব প্রযুক্তি তিমির গান অনুবাদে ব্যবহৃত হচ্ছেসেগুলোই একদিন ব্যবহৃত হতে পারে তাদের ওপর নজরদারি চালাতেতাদের ব্যবহারের তথ্য বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে।

আগামী বছরগুলো আমাদের ও অন্যান্য প্রাণীর সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে। যদি আমরা এটি যত্নসতর্কতাএবং সুনির্দিষ্ট নৈতিক-আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে এগিয়ে নেইতাহলে এই সময় আমাদের শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নয়বরং প্রাণীজগতের প্রতি সহানুভূতিশ্রদ্ধা ও আন্তঃসম্পর্কের উপলব্ধিও বাড়াবে।

আমাদের বৈজ্ঞানিক ও আইনগত পেশাগত জীবনে কখনোই এত বিস্ময়প্রকৃতির প্রতি এত আকুলতা দেখিনিযেমনটি আমরা তিমিদের ভাষা ও আইনি অধিকার নিয়ে যৌথ গবেষণায় দেখেছি। সেটাসিয়া (তিমির পরিবার) আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে,” বলেছিলেন কার্ল সাগান। এই শিক্ষা শুধু তিমিদের নিয়ে নয়বরং আমাদের নিজেদের নিয়েই।” এখন দেখা যাকআমরা সেই বিস্ময়কে আবারও কীভাবে কর্মে রূপান্তর করতে পারি আমাদের অমানব আত্মীয়দের জন্য।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় প্রাণীদের ভাষা বোঝার নতুন দিগন্ত

১০:০০:১৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ইতিমধ্যেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনছে। তবে এখন পর্যন্ত এর প্রয়োগ প্রায় একচেটিয়াভাবে মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) ওপরই কেন্দ্রীভূত ছিল। কিন্তু যদি মানুষ এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে একই গ্রহে বসবাসকারী অমানব প্রাণীদের আরও ভালোভাবে বুঝতে পারত?

এই দিগন্তের দরজাই এখন খুলতে শুরু করেছে। মেশিন লার্নিং ও রোবোটিক্সে নতুন অগ্রগতি প্রাণীদের ভাষা ও আচরণ বিশ্লেষণে এমন গভীরতা ও সূক্ষ্মতা এনেছেযা আগে কল্পনাও করা যেত না। গবেষকেরা এখন হাতিদের পরস্পরের জন্য ব্যবহৃত নাম শনাক্ত করতে পারছেনজানতে পারছেন কীভাবে মথ বা পোকামাকড় গাছের যন্ত্রণার সংকেত শোনেএবং স্পার্ম হোয়েল নামক অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং সামাজিক তিমির ধ্বনি বিশ্লেষণ করে এমন এক জটিল ভাষা আবিষ্কার করছেনযার মধ্যে রয়েছে স্বরবর্ণ ও ধ্বনিগত বর্ণমালার মতো উপাদান — যা মানুষের ভাষার কাঠামোর সাদৃশ্য বহন করে।

আজকের প্রযুক্তি বিশাল তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুমান নয়বরং প্রকৃত অনুবাদ ও আন্তঃপ্রজাতি যোগাযোগের সম্ভাবনা খুলে দিচ্ছে। যেমনভাবে অতীতে দূরবীক্ষণ ও অণুবীক্ষণ যন্ত্র আমাদের অদৃশ্য জগতের জানালা খুলে দিয়েছিলতেমনি এআইও মানব ইন্দ্রিয়ের আওতার বাইরে থাকা বার্তা অনুধাবনের উপায় দিচ্ছে।

প্রায় ৫০ বছর আগে মানুষের আরেক শ্রবণ অভিযাত্রা শুরু হয়যখন রজার ও কেটি পেইন প্রথম তিমির গান রেকর্ড করেনযা পরে হাম্পব্যাক হোয়েল’ এর গান নামে পরিচিত হয়ে এক জনপ্রিয় অ্যালবামে রূপ নেয়। সেই গান মানবজাতির আবেগে নাড়া দেয়, ‘সেভ দ্য হোয়েলস’ আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেযার ফলে বহু তিমি প্রজাতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। এই আন্দোলনের পেছনে ছিল বিজ্ঞানযা জন্ম দেয় বিস্ময়েরবিস্ময় ডেকে আনে সহানুভূতিসহানুভূতি জাগায় আশাআর সেই আশাই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে।

এই ধরনের বৈজ্ঞানিক অনুপ্রেরণার ভিত্তিতে গৃহীত সম্মিলিত সিদ্ধান্তগুলো মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছে। তবে আজকের প্রযুক্তিগতপরিবেশগত ও সামাজিক অস্থিরতার মাত্রাগতি ও ঝুঁকি আরও বহুগুণ বেশি। যেমনএআই একদিকে অমানব প্রাণীদের রক্ষা ও বোঝার বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করছেঅন্যদিকে এর অপব্যবহারে সেই প্রাণীদের আরও বেশি শোষণ ও নিপীড়নের ঝুঁকিও রয়েছে। প্রশ্ন হলো: আমরা কি এআই ব্যবহার করে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে পারবনাকি আরও বিচ্ছিন্ন হবআমরা কি প্রাণীদের ভাষা শুনে তাদের অধিক রক্ষা করবনাকি সেই তথ্যকে ব্যবহার করে তাদেরকে আরও পণ্য হিসেবে গণ্য করব?

বিজ্ঞান এখনবিজ্ঞান সাংবাদিক এড ইয়ং এর ভাষায়আমাদের সামনে খুলে দিচ্ছে প্রাণীদের অপরিসীম জগৎ” এবং পরিবেশ আইন ও নীতিমালার এক নতুন অধ্যায়। প্রাণীদের নিজেদের বার্তা তাদের অধিকারের পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ হয়ে উঠতে পারে। বহুদিন ধরে প্রাণীদের ভাষাহীনতা তাদের আইনগত অধিকার অস্বীকার করার যুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যদি তিমির শব্দ এক পরিশীলিতপ্রাচীন বুদ্ধিমত্তার বহিঃপ্রকাশ হয়যেমনটি বিজ্ঞানী কার্ল সাগান ৫২ বছর আগে বলেছিলেনযেটি হতে পারে মহাকাব্যইতিহাস বা সামাজিক আচরণের গূঢ় সংকেততবে কী প্রাণীদের জন্যও মানবাধিকারের মত অধিকার স্বীকৃত হতে পারে?

এই প্রশ্নই গবেষণা করছে সেটি’ (CETI – Cetacean Translation Initiative) ও মথ’ (MOTH – More-Than-Human Life Program, NYU Law)। তারা অমানব প্রাণীদের ভাষা অনুবাদের আইনি দিক নিয়ে আন্তঃবিভাগীয়ভাবে কাজ করছে। CETI দেখিয়েছে যে স্পার্ম হোয়েলদের মধ্যে জটিল শ্রবণ ও সামাজিক যোগাযোগের উপাদান রয়েছে। MOTH-এর বিশ্লেষণ বলছেএই গবেষণা বিদ্যমান আইন প্রয়োগে সহায়ক প্রমাণ দিতে পারেআদালতের সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারে এবং এমনকি তিমিসহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীদের নতুন অধিকার নিশ্চিত করতে পারে।

MOTH ও CETI-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছেতিমিদের ভাষা ভালোভাবে বোঝা গেলে জাহাজের আওয়াজতেল অনুসন্ধানে সিসমিক সার্ভেএবং গভীর সমুদ্রে খনির মতো কার্যক্রম থেকে তাদের অস্তিত্বগত হুমকি প্রমাণ করা সম্ভব হবে। এসব প্রমাণের ভিত্তিতে এ যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যেঅবিরাম উচ্চ শব্দ তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচারএমনকি নিপীড়নের শামিল। ফলেএই শব্দ থেকে মুক্ত থাকার অধিকার স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তিমিদের ভাষা বোঝার মাধ্যমে বোঝা যাবে তাদের যন্ত্রণাতাদের বধিরতাঅস্বাভাবিক মৃত্যুযা সমুদ্রের নিচের শব্দের সঙ্গে জড়িত। একইসঙ্গে জানা যাবে তাদের সামাজিক জীবনের সমৃদ্ধিবিশেষ ক্লানভিত্তিক ভাষাসাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যসহযোগিতাপূর্ণ আচরণযা সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে জোরালো করবে।

এই বিজ্ঞান আদিবাসীদের প্রাচীন জ্ঞান ও সম্পর্কের সঙ্গে মিলিত হয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডতাহিতি ও কুক দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী নেতারা তিমিদের আইনি ব্যক্তিসত্তা স্বীকৃতি দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।

তবে এই বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রায় সতর্কতা জরুরি। যথাযথ আইনি ও নৈতিক রক্ষাকবচ না থাকলে এই প্রযুক্তি সেই প্রাণীদেরই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে যাদের আমরা বুঝতে চাই। প্রাণীদের অধিকার ও কল্যাণ রক্ষায় উৎসাহী বিজ্ঞানীদের এটি বোঝা জরুরি যেএই অধিকার আমাদের ধীরেসংবেদনশীলভাবেএবং সতর্কতার সঙ্গে এগোতে বলে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছেদূরদৃষ্টিহীন প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি হয়েছে। মাইক্রোফোনহাইড্রোফোনড্রোন — এগুলো যেমন বোঝার কাজে ব্যবহৃত হয়েছেতেমনি পর্যবেক্ষণনির্যাতনগবেষণার নামে প্রাণীদের ক্ষতিও করেছে।

এই পরিস্থিতিতে গবেষণা ও প্রযুক্তি ব্যবহারে তিনটি প্রধান নীতিমালার প্রস্তাবনা দেওয়া হচ্ছে:
১. প্রাণীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
২. তথ্য শাসনের নিয়মযা তৃতীয় পক্ষের অপব্যবহার থেকে সুরক্ষা দেবে।
৩. “সতর্কতামূলক নীতি” (precautionary principle), যাতে কোনো ক্ষতির নিশ্চিত প্রমাণ না থাকলেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

এছাড়া ৩আর” নীতিমালাযেখানে প্রাণীদের পরিবর্তে বিকল্প উপায় প্রয়োগতাদের ব্যবহার হ্রাসএবং গবেষণায় তাদের ক্ষতির পরিমাণ সর্বনিম্ন করার কথা বলা হয়তা ব্যবহার করা উচিত।

এই ধরনের সুরক্ষা ছাড়া ভবিষ্যতে ডিজিটাল প্রযুক্তি দিয়ে প্রাণীদের আরও শোষণ ও নিয়ন্ত্রণ করার ঝুঁকি রয়েছে। আজ যেসব প্রযুক্তি তিমির গান অনুবাদে ব্যবহৃত হচ্ছেসেগুলোই একদিন ব্যবহৃত হতে পারে তাদের ওপর নজরদারি চালাতেতাদের ব্যবহারের তথ্য বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করতে।

আগামী বছরগুলো আমাদের ও অন্যান্য প্রাণীর সম্পর্ক নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে। যদি আমরা এটি যত্নসতর্কতাএবং সুনির্দিষ্ট নৈতিক-আইনি কাঠামোর ভিত্তিতে এগিয়ে নেইতাহলে এই সময় আমাদের শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নয়বরং প্রাণীজগতের প্রতি সহানুভূতিশ্রদ্ধা ও আন্তঃসম্পর্কের উপলব্ধিও বাড়াবে।

আমাদের বৈজ্ঞানিক ও আইনগত পেশাগত জীবনে কখনোই এত বিস্ময়প্রকৃতির প্রতি এত আকুলতা দেখিনিযেমনটি আমরা তিমিদের ভাষা ও আইনি অধিকার নিয়ে যৌথ গবেষণায় দেখেছি। সেটাসিয়া (তিমির পরিবার) আমাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বহন করে,” বলেছিলেন কার্ল সাগান। এই শিক্ষা শুধু তিমিদের নিয়ে নয়বরং আমাদের নিজেদের নিয়েই।” এখন দেখা যাকআমরা সেই বিস্ময়কে আবারও কীভাবে কর্মে রূপান্তর করতে পারি আমাদের অমানব আত্মীয়দের জন্য।