জরুরি অবস্থায় ‘সবকিছু ঝুঁকে পড়া’
অ্যাপোলো–১৩ মহাকাশযানের বিপর্যয়ের সময় যেমন টিউব জুতো-মোজা ও ডুকট টেপ দিয়ে সমাধান খুঁজেছিলেন নভোচারীরা, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান সঙ্কটেও আমাদের বিকল্প সব উপায় একসঙ্গে বিবেচনা করতে হচ্ছে। কার্বন নির্গমন দ্রুত কমানোই মূল সমাধান, তবে দীর্ঘ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাই ‘প্ল্যান বি’ হিসেবে উঠে এসেছে ভূ-প্রকৌশল—পৃথিবীর জলবায়ুকে ইচ্ছাকৃতভাবে সাময়িক বদলে দেওয়ার নীতি।
প্ল্যান এ-মুখ্য লক্ষ্য: নির্গমন দ্রুত ছাঁটাই
বিজ্ঞানীদের সর্বসম্মত মত, প্রথম কৌশল হওয়া উচিত গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন যত দ্রুত ও যত বেশি সম্ভব কমানো। কার্বন নিঃসরণ বন্ধ না করলে অন্য কোনো সমাধানই স্থায়ী ফল দেবে না।
প্ল্যান বি-এর অন্তর্গত প্রধান কৌশলসমূহ
১. সূর্যের তাপ কমানো (সৌর বিকিরণ ব্যবস্থাপনা)
বড় অগ্ন্যুৎপাত যেমন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে সূক্ষ্ম কণিকা ছড়িয়ে সূর্যের আলো কিছুটা আটকে দেয়, তেমনি ক্ষুদ্র বিমান বহর দিয়ে সালফেট বা মিনারেল কণা ছড়িয়ে সাময়িক শীতলতা আনা সম্ভব। এটি তুলনামূলক সস্তা হলেও বৃষ্টিপাতের ধরণ বদলে যেতে পারে, এমনকি ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কার্বন চক্রে হস্তক্ষেপ
- বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন
প্রচুর গাছ কার্বন শোষণ করে, কিন্তু শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক নির্গমন ‘শোষতে’ প্রতি বছর মাথাপিছু ৬০০টির বেশি গাছ লাগানো লাগবে—জমিরও তীব্র চাহিদা তৈরি হবে। - ডাইরেক্ট এয়ার ক্যাপচার (ডিএসি)
কারখানা আকৃতির যন্ত্র দিয়ে বায়ু থেকে সরাসরি কার্বন টেনে নেওয়া সম্ভব, তবে ব্যয়বহুল ও উচ্চশক্তি-নির্ভর। বর্তমানে মানুষের মোট নির্গমন মাত্র ১৩ মিনিটেই এক মিলিয়ন টন ছুঁয়ে ফেলে—একটি বড় ডিএসি প্ল্যান্টের পুরো বছরের সক্ষমতা।
মহাসাগরকে ‘অ্যান্টাসিড’ খাওয়ানো
কার্বন ডাই-অক্সাইড পানির সঙ্গে মিশে সামুদ্রিক জলকে অম্লীয় করছে। পাথর গুঁড়া ছড়িয়ে বা বিদ্যুৎ-চালিত রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পানি ক্ষারীয় করলে সমুদ্র বাতাস থেকে আরও বেশি কার্বন টেনে নিতে পারে। আবার, শৈবাল-ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বাড়ালেও তা সমুদ্রপথ, মাৎস্যজীবী ও অফশোর বিদ্যুৎ প্রকল্পকে প্রভাবিত করতে পারে।
পাথর ক্ষয় ত্বরান্বিত করা (এনহান্সড ওয়েদারিং)
পৃথিবীর বুকে কোটি বছরের প্রাকৃতিক ক্ষয়ে পাথর থেকে ক্যালসিয়াম বেরিয়ে কার্বনিক অ্যাসিডের সাথে মিশে চুনাপাথর তৈরি করে, ফলে কার্বন স্থায়ীভাবে আটকে থাকে। এই প্রক্রিয়া বাড়াতে পাথর গুঁড়ো করে চাষের জমিতে ছিটালে প্রতিবছর কয়েক শ’ কোটি টন কার্বন বায়ু থেকে সরানো সম্ভব হতে পারে, আর কিছু মাটি এতে উর্বরও হতে পারে। খনিজ খননক্ষেত্রের আগেই পিষে রাখা বিপুল পাথর এখানে কাজে লাগানো যায়। তবে পাথর গুঁড়ো করতে ও পরিবহনে প্রচুর শক্তি লাগে।
ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা
কোনো কৌশলই এখনো বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষিত নয়। আকাশে কণা ছিটালে বৈশ্বিক জলচক্র বদলাতে পারে, সমুদ্রের রাসায়নিক গঠন পাল্টালে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়তে পারে। এত বড় সিদ্ধান্ত সার্বজনীন ঐকমত্য ছাড়া নেওয়া উচিত নয়, অথচ বৈশ্বিক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। তবু কয়েক বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যেই এসব গবেষণায় লগ্নি হয়েছে।
‘ময়লা’ বন্ধ না করলে পরিষ্কার করা কঠিন
অ্যাপোলো–১৩ প্রমাণ করে, মানুষ মহাকাশে যেতে যেমন সক্ষম, তেমন বিপদে পড়লে বুদ্ধি-সঞ্জাতে রক্ষা পেতেও পারে। তেমনি আমরা কার্বন কমাতে সচেষ্ট থাকলে ও প্রয়োজনে সঠিকভাবে ভূ-প্রকৌশল ব্যবহার করলে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। তবে আগে নিশ্চিত করতে হবে—নতুন করে আর কার্বন ‘জমা’ না হয়।