০২:২০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

Rafiq Bakery – শ্রমিক শ্রেণির পেটে পাউরুটি, হৃদয়ে গর্ব [চতুর্থ পর্ব]

ঢাকার রেস্তোরাঁ বা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কেক শপ নয়—শহরের প্রতিদিনকার নাশতার অবিচ্ছেদ্য অংশ এক টুকরো গরম পাউরুটি, যার নাম ‘রফিক বেকারি’। আধুনিকতার আলোচনার আড়ালে ঢাকা শহরের কাজের মানুষের জীবনে, রাস্তার কিনারার ভ্রাম্যমাণ দোকানে কিংবা স্কুল-কলেজের ক্যান্টিনে, রফিক বেকারির রুটি আছে গভীরভাবে গেঁথে। এক সময়ের পাড়াগাঁয়ের ছেলে রফিক উদ্দিন তৈরি করেছিলেন এমন একটি বেকারি, যা হয়ে উঠেছিল শহরের সবচেয়ে সহজলভ্য, কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিক্রিত রুটির নাম।

শুরুটা এক কুলি থেকে

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার মোহাম্মদপুরে আশ্রয় নেন মানিকগঞ্জের ছেলে রফিক উদ্দিন। বাবাহীন রফিক শুরুতে ছিলেন গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে কুলি। পরে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এলাকায় এক বেকারিতে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখনই তার বেকিংয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়।

ছোট ছোট টিনের পাউরুটি বানানো, চুলায় ফায়ার তোলার কৌশল, সঠিক ফারমেন্টেশন—সব শিখে ফেলেন কয়েক বছরের মধ্যেই। এরপর ১৯৭৭ সালে শুরু করেন নিজস্ব একটি ক্ষুদ্র বেকারি। একটি মাত্র ওভেন, তিনজন কর্মী, আর প্রতিদিন মাত্র ৪০টি রুটি—সেখান থেকেই রফিক বেকারির যাত্রা।

পণ্যের বৈশিষ্ট্য: রুটি মানেই রফিক

রফিক বেকারির প্রধান পণ্য ছিল এবং এখনো আছে—সাদা পাউরুটি। তবে এই রুটি ছিল বিশেষভাবে তৈরি। সাধারণ বেকারির তুলনায় এদের মিশ্রণে দেওয়া হতো তুলনামূলক কম চিনি, বেশি ইস্ট ও স্থানীয় আটা-ময়দা মিশ্রণ। ফলে স্বাদ ছিল সহজ, টেক্সচার ছিল নরম, আর দাম ছিল স্বল্প।

১৯৮০-৯০ দশকে শ্রমজীবী মানুষ, দোকান কর্মচারী, বাস চালক, রিকশাওয়ালা, এমনকি স্কুলছাত্রদের টিফিনে রফিক বেকারির রুটি ছিল সর্বজনীন খাবার। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হতো “রফিকের রুটি”। একেকটা মাঝারি রুটির দাম ছিল ৫ টাকা—যেখানে অন্য ব্র্যান্ডের রুটি ছিল ১২-১৫ টাকা।

সঙ্গে থাকত মিল্ক বানচিকেন রোল (সপ্তাহে একদিন), আর এক ধরণের গোল পাউরুটি যেটা ডিম-পেঁয়াজ ভাজি দিয়ে খাওয়ার জন্য আদর্শ ছিল।

কোনো বিলাসিতা নয়সময়-ভিত্তিক উৎপাদন

রফিক বেকারির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল এর টাইম বেইজড ব্যাচ ম্যানেজমেন্ট। প্রতিদিন রাত ১টা থেকে শুরু হতো প্রস্তুতি, ভোর ৫টায় প্রথম ব্যাচ চুলা থেকে বের হতো। স্থানীয় চায়ের দোকান, ক্যান্টিন, এবং রাস্তার ফুডকার্টগুলো নিজে এসে সংগ্রহ করত।
প্যাকেজিং ছিল খালি—শুধু সাদা মোড়কে হাতে লেখা “রফিক বেকারি, মোহাম্মদপুর”।

এভাবেই সকাল ৯টার মধ্যে দিনের প্রথম চালান শেষ হয়ে যেত। এরপর দুপুরে দ্বিতীয় ব্যাচ—স্কুল, কলেজ ও অফিস এলাকার জন্য।

শ্রমিক-চালিত ব্যবসার অনন্য উদাহরণ

রফিক বেকারি কখনোই বহুমূল্য যন্ত্রপাতি আনেনি, ফ্র্যাঞ্চাইজে যায়নি, বা চকচকে ব্র্যান্ডিং করেনি। বরং এর মূল ভিত্তি ছিল মানুষ ও ঘাম
রফিক উদ্দিনের দর্শন ছিল—“রুটি হবে এমন, যেন রিকশাচালকও খেয়ে দিন শুরু করতে পারে, আর শিক্ষকও খেয়ে ক্লাস নিতে পারে।”

এ বেকারির ৮০% কর্মী ছিলেন আশেপাশের বস্তি ও নিম্নআয়ের যুবক, যারা এখানে এসে শিখেছেন ময়দা মাখা, ছাঁচে ভরা, তাপমাত্রা বোঝা—একটি কারুশিল্প হিসেবে বেকিং।

জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক সংযোগ

৯০-এর দশকে রফিক বেকারির রুটি সরবরাহ হতো স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কার্যালয়ের মিটিংয়ে। কারণ তারা জানত, এই রুটি সস্তা এবং প্রচুর।

এছাড়াও, শহরের অনেক গণজমায়েতে—বিক্ষোভ, মিছিল, ধর্মঘট—রফিক বেকারির রুটি ছিল সকালের খাবার। এমনকি ২০০১ সালের নির্বাচনের সময়ে একাধিক ওয়ার্ডে প্রার্থীরা তাদের ক্যাম্পে এই রুটি সরবরাহ করাতেন।

রফিক উদ্দিন নিজে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দিতেন না, তবে তাঁর বেকারি ছিল জনগণের, তাই রাজনৈতিক সব পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য।

প্রতিকূলতা ও উত্তরাধিকার

২০১৫ সালে রফিক উদ্দিন মারা যান। তাঁর দুই ছেলে, মাহবুব ও শহীদ, বেকারির হাল ধরেন। তবে আধুনিক পদ্ধতি, সরকারি লাইসেন্সিং ও স্বাস্থ্যনীতি কঠিন হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায় ধাক্কা লাগে। ২০২০ সালে কোভিডের সময় বেকারিটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও এখন অনেকটাই সীমিত আকারে চলছে।

মোহাম্মদপুরের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন—
রফিকের রুটি মানেই ছিল সকালে উঠে গরম চা আর তৃপ্তির প্রথম কামড়। আজকের মোড়কপরা ব্র্যান্ডে সেই স্বাদ নেই।

ভবিষ্যৎ ভাবনা: ঘামের ঐতিহ্য সংরক্ষণ

বর্তমানে একদল তরুণ উদ্যোক্তা ও গবেষক মিলে রফিক বেকারির কর্মীদের দিয়ে একটি “Community Baking Studio” গড়ার চিন্তা করছেন, যেখানে ঐতিহ্যগত সস্তা ও স্বাস্থ্যকর বেকিংয়ের পদ্ধতি শেখানো হবে। সেই সঙ্গে রফিক উদ্দিনের জীবনভিত্তিক বই ও ডকুমেন্টারি নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।

Rafiq Bakery শুধুই এক পাউরুটি তৈরির দোকান ছিল না—এটি ছিল ঢাকার শ্রমজীবী মানুষের পেটের পেট্রোল, ক্লাসের ছাত্রের রুটি, আর তাড়াহুড়ো জীবনের জন্য সহজ সমাধান। এ বেকারি ছিল ঢাকার বাস্তবতার সঙ্গে মিশে থাকা এক আবেগের নাম, এক নির্ভরতার ছায়া।

Rafiq Bakery – শ্রমিক শ্রেণির পেটে পাউরুটি, হৃদয়ে গর্ব [চতুর্থ পর্ব]

০৭:০০:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

ঢাকার রেস্তোরাঁ বা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কেক শপ নয়—শহরের প্রতিদিনকার নাশতার অবিচ্ছেদ্য অংশ এক টুকরো গরম পাউরুটি, যার নাম ‘রফিক বেকারি’। আধুনিকতার আলোচনার আড়ালে ঢাকা শহরের কাজের মানুষের জীবনে, রাস্তার কিনারার ভ্রাম্যমাণ দোকানে কিংবা স্কুল-কলেজের ক্যান্টিনে, রফিক বেকারির রুটি আছে গভীরভাবে গেঁথে। এক সময়ের পাড়াগাঁয়ের ছেলে রফিক উদ্দিন তৈরি করেছিলেন এমন একটি বেকারি, যা হয়ে উঠেছিল শহরের সবচেয়ে সহজলভ্য, কিন্তু সবচেয়ে বেশি বিক্রিত রুটির নাম।

শুরুটা এক কুলি থেকে

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকার মোহাম্মদপুরে আশ্রয় নেন মানিকগঞ্জের ছেলে রফিক উদ্দিন। বাবাহীন রফিক শুরুতে ছিলেন গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে কুলি। পরে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এলাকায় এক বেকারিতে হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখনই তার বেকিংয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয়।

ছোট ছোট টিনের পাউরুটি বানানো, চুলায় ফায়ার তোলার কৌশল, সঠিক ফারমেন্টেশন—সব শিখে ফেলেন কয়েক বছরের মধ্যেই। এরপর ১৯৭৭ সালে শুরু করেন নিজস্ব একটি ক্ষুদ্র বেকারি। একটি মাত্র ওভেন, তিনজন কর্মী, আর প্রতিদিন মাত্র ৪০টি রুটি—সেখান থেকেই রফিক বেকারির যাত্রা।

পণ্যের বৈশিষ্ট্য: রুটি মানেই রফিক

রফিক বেকারির প্রধান পণ্য ছিল এবং এখনো আছে—সাদা পাউরুটি। তবে এই রুটি ছিল বিশেষভাবে তৈরি। সাধারণ বেকারির তুলনায় এদের মিশ্রণে দেওয়া হতো তুলনামূলক কম চিনি, বেশি ইস্ট ও স্থানীয় আটা-ময়দা মিশ্রণ। ফলে স্বাদ ছিল সহজ, টেক্সচার ছিল নরম, আর দাম ছিল স্বল্প।

১৯৮০-৯০ দশকে শ্রমজীবী মানুষ, দোকান কর্মচারী, বাস চালক, রিকশাওয়ালা, এমনকি স্কুলছাত্রদের টিফিনে রফিক বেকারির রুটি ছিল সর্বজনীন খাবার। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হতো “রফিকের রুটি”। একেকটা মাঝারি রুটির দাম ছিল ৫ টাকা—যেখানে অন্য ব্র্যান্ডের রুটি ছিল ১২-১৫ টাকা।

সঙ্গে থাকত মিল্ক বানচিকেন রোল (সপ্তাহে একদিন), আর এক ধরণের গোল পাউরুটি যেটা ডিম-পেঁয়াজ ভাজি দিয়ে খাওয়ার জন্য আদর্শ ছিল।

কোনো বিলাসিতা নয়সময়-ভিত্তিক উৎপাদন

রফিক বেকারির সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল এর টাইম বেইজড ব্যাচ ম্যানেজমেন্ট। প্রতিদিন রাত ১টা থেকে শুরু হতো প্রস্তুতি, ভোর ৫টায় প্রথম ব্যাচ চুলা থেকে বের হতো। স্থানীয় চায়ের দোকান, ক্যান্টিন, এবং রাস্তার ফুডকার্টগুলো নিজে এসে সংগ্রহ করত।
প্যাকেজিং ছিল খালি—শুধু সাদা মোড়কে হাতে লেখা “রফিক বেকারি, মোহাম্মদপুর”।

এভাবেই সকাল ৯টার মধ্যে দিনের প্রথম চালান শেষ হয়ে যেত। এরপর দুপুরে দ্বিতীয় ব্যাচ—স্কুল, কলেজ ও অফিস এলাকার জন্য।

শ্রমিক-চালিত ব্যবসার অনন্য উদাহরণ

রফিক বেকারি কখনোই বহুমূল্য যন্ত্রপাতি আনেনি, ফ্র্যাঞ্চাইজে যায়নি, বা চকচকে ব্র্যান্ডিং করেনি। বরং এর মূল ভিত্তি ছিল মানুষ ও ঘাম
রফিক উদ্দিনের দর্শন ছিল—“রুটি হবে এমন, যেন রিকশাচালকও খেয়ে দিন শুরু করতে পারে, আর শিক্ষকও খেয়ে ক্লাস নিতে পারে।”

এ বেকারির ৮০% কর্মী ছিলেন আশেপাশের বস্তি ও নিম্নআয়ের যুবক, যারা এখানে এসে শিখেছেন ময়দা মাখা, ছাঁচে ভরা, তাপমাত্রা বোঝা—একটি কারুশিল্প হিসেবে বেকিং।

জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক সংযোগ

৯০-এর দশকে রফিক বেকারির রুটি সরবরাহ হতো স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কার্যালয়ের মিটিংয়ে। কারণ তারা জানত, এই রুটি সস্তা এবং প্রচুর।

এছাড়াও, শহরের অনেক গণজমায়েতে—বিক্ষোভ, মিছিল, ধর্মঘট—রফিক বেকারির রুটি ছিল সকালের খাবার। এমনকি ২০০১ সালের নির্বাচনের সময়ে একাধিক ওয়ার্ডে প্রার্থীরা তাদের ক্যাম্পে এই রুটি সরবরাহ করাতেন।

রফিক উদ্দিন নিজে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দিতেন না, তবে তাঁর বেকারি ছিল জনগণের, তাই রাজনৈতিক সব পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য।

প্রতিকূলতা ও উত্তরাধিকার

২০১৫ সালে রফিক উদ্দিন মারা যান। তাঁর দুই ছেলে, মাহবুব ও শহীদ, বেকারির হাল ধরেন। তবে আধুনিক পদ্ধতি, সরকারি লাইসেন্সিং ও স্বাস্থ্যনীতি কঠিন হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায় ধাক্কা লাগে। ২০২০ সালে কোভিডের সময় বেকারিটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও এখন অনেকটাই সীমিত আকারে চলছে।

মোহাম্মদপুরের এক প্রবীণ বাসিন্দা বলেন—
রফিকের রুটি মানেই ছিল সকালে উঠে গরম চা আর তৃপ্তির প্রথম কামড়। আজকের মোড়কপরা ব্র্যান্ডে সেই স্বাদ নেই।

ভবিষ্যৎ ভাবনা: ঘামের ঐতিহ্য সংরক্ষণ

বর্তমানে একদল তরুণ উদ্যোক্তা ও গবেষক মিলে রফিক বেকারির কর্মীদের দিয়ে একটি “Community Baking Studio” গড়ার চিন্তা করছেন, যেখানে ঐতিহ্যগত সস্তা ও স্বাস্থ্যকর বেকিংয়ের পদ্ধতি শেখানো হবে। সেই সঙ্গে রফিক উদ্দিনের জীবনভিত্তিক বই ও ডকুমেন্টারি নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে।

Rafiq Bakery শুধুই এক পাউরুটি তৈরির দোকান ছিল না—এটি ছিল ঢাকার শ্রমজীবী মানুষের পেটের পেট্রোল, ক্লাসের ছাত্রের রুটি, আর তাড়াহুড়ো জীবনের জন্য সহজ সমাধান। এ বেকারি ছিল ঢাকার বাস্তবতার সঙ্গে মিশে থাকা এক আবেগের নাম, এক নির্ভরতার ছায়া।