ঢাকার কেক শিল্পে যদি কেউ প্রকৃত অর্থে game changer হয়ে থাকে, তবে তার নাম নিঃসন্দেহে Mr. Baker। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় মিরপুরের একটি ছোট গ্যারেজে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটি আজ একাধিক শোরুম, অনলাইন অর্ডার, এবং বহু তরুণ উদ্যোক্তার অনুপ্রেরণা। কিভাবে একটি প্রথাগত বেকারি থেকে Mr. Baker হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিক, গ্রাহককেন্দ্রিক কেক ব্র্যান্ড?
শুরুর দিন: গ্যারেজে গন্ধ
১৯৯৩ সাল। মিরপুর-১ নম্বর সেকশনে এক পুরনো বাড়ির গ্যারেজে বন্ধু দুজন—রফিকুল ইসলাম ও শাহজাহান কবির—মিলে চালু করেন একটি কেক ও বেকড পণ্যের দোকান। তখন তারা দুজনেই ঢাকার একটি বেকারিতে কাজ করতেন, তবে বিদেশি কেকের স্বাদ, ডিজাইন এবং প্যাকেজিং দেখে তারা ভাবেন—“এমন কিছু ঢাকাতেও করা সম্ভব, শুধু দরকার সাহস আর স্বপ্ন।”
তাদের প্রথম দোকানে পাওয়া যেত মাত্র চার ধরণের কেক—চকলেট, ভ্যানিলা, ফ্রুট কেক ও বাটার স্পঞ্জ। তবুও যেটি ছিল একদম আলাদা—তা হলো ডেকোরেটিভ কেক ডিজাইন এবং কাস্টমার-চাহিদাভিত্তিক বানানো কেক।
ব্র্যান্ড গড়ার শুরু: Mr. Baker নাম কেন?
Mr. Baker নামটি রাখা হয় ১৯৯৪ সালে, যখন তারা বুঝতে পারেন যে শুধু স্বাদ নয়, নামের মধ্যেও থাকতে হবে এক ধরনের ব্যক্তিত্ব। কাস্টমার যেন মনে রাখতে পারে—“কেক মানে Mr. Baker”।
তারা এমনকি ছোট ছোট লিফলেট ছেপে মিরপুর থেকে কলাবাগান পর্যন্ত বিতরণ করেন, যেখানে লেখা ছিল—“আপনার জন্মদিনে কেক আমরা বানাবো, যেমন আপনি চান!”। সেই সময় ঢাকায় প্রথম বারে গ্রাহকের পছন্দমতো কেক ডিজাইন করানোর সুযোগ তৈরি করে Mr. Baker।
ব্যবসায়িক সম্প্রসারণ: ছোট থেকে বড়, তারপর ফ্র্যাঞ্চাইজি
২০০০ সালের মধ্যে Mr. Baker-এর চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে তারা শ্যামলী, ধানমন্ডি ও উত্তরায় শোরুম খোলেন। একই সঙ্গে শুরু করেন এক ধরনের ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল, যেখানে স্থানীয় উদ্যোক্তারা তাদের অনুমোদন নিয়ে দোকান চালাতে পারেন।
তাদের সিগনেচার পণ্যগুলোর মধ্যে ছিল:
- Red Velvet Cake
- Mocha Layer Cake
- Designer Birthday Cake
- German Chocolate Cake
- Rainbow Surprise Cake
বিশেষ করে জন্মদিন, বিয়ের অনুষ্ঠান, এনগেজমেন্ট—এসব কাস্টম কেক অর্ডারের জন্য Mr. Baker ছিল অব্যর্থ গন্তব্য।
গ্রাহকসেবা ও আধুনিকায়ন
Mr. Baker অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিল যে আধুনিক ক্রেতা শুধু খাবার খেতে চান না, তারা চান অভিজ্ঞতা। সেই জন্যই তারা ঢাকায় প্রথম cake tasting booth, custom order tracking system, এবং পরবর্তীতে অনলাইন কেক ডিজাইনার টুল চালু করেন।
২০১৫ সাল থেকে তারা ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অর্ডার নেওয়া শুরু করেন। কোভিড-১৯ মহামারির সময়েও তারা ঘরে পৌঁছে দেওয়া কেক ডেলিভারির মাধ্যমে বাজার ধরে রাখতে সক্ষম হন।
স্বপ্নপূরণের জায়গা: ভালোবাসার মুহূর্তে Mr. Baker
Mr. Baker-এর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল—এটি মানুষকে তাদের ভালোবাসার মুহূর্তগুলো উদযাপন করতে সাহায্য করেছে। অনেকেই তাঁদের প্রেম নিবেদন করেছেন Mr. Baker-এর ডিজাইন করা ‘Propose Cake’-এর মাধ্যমে। অনেক বাচ্চার জন্মদিনে প্রথম কেক কাটার স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই দোকানের সঙ্গে।
ঢাকার রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতির বিশ্লেষক শওকত মুনির বলেন—
“Mr. Baker আমাদের দেখিয়েছে, কেক শুধু খাদ্য নয়—এটি এক্সপ্রেশন, এটি ভালোবাসা, এটি জীবনের মাইলফলক।”
প্রতিযোগিতা ও টিকে থাকার কৌশল
বর্তমানে ঢাকায় বহু ফিউশন বেকারি, পেস্ট্রি হাউজ ও ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড এসেছে। তবুও Mr. Baker তাদের স্বতন্ত্রতা ধরে রেখেছে দুটি কারণে—(১) স্থানীয় চাহিদা বোঝা, এবং (২) পণ্যে সততা। তারা কখনো স্বাদে আপস করেনি, বরং সময়ের সঙ্গে রেসিপি ও প্রযুক্তি আপডেট করেছে।
তাদের বেকিং ল্যাব এখন আন্তর্জাতিক মানের। কর্মীরা বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আছে কেক ডিজাইনার, চকলেট স্পেশালিস্ট, এমনকি শিশু-কেন্দ্রিক প্রডাক্ট টিম।
সামাজিক অবদান
Mr. Baker তাদের CSR কার্যক্রমের আওতায় প্রতিবছর পথশিশুদের জন্য জন্মদিনের কেক তৈরি করে ‘Celebrating Forgotten Birthdays’ নামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
তারা বিভিন্ন ট্রেনিং সেশনের মাধ্যমে তরুণ বেকারদের প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে।
Mr. Baker আজ কোথায়?
বর্তমানে Mr. Baker-এর ৩৮টির বেশি আউটলেট রয়েছে সারা বাংলাদেশে। বছরে প্রায় ১০ লাখ কেক তৈরি করে তারা।
তাদের মূল কারখানা এখন গাজীপুরে, যা ২৫,০০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে বিস্তৃত।
কোনো বিশেষ দিনে যেমন ভালোবাসা দিবস বা নববর্ষে, Mr. Baker প্রতিদিন গড়ে ৭,০০০-৮,০০০ কেক বিক্রি করে।
Mr. Baker শুধুমাত্র একটি সফল ব্যবসার গল্প নয়—এটি ঢাকার বেকিং শিল্পে আধুনিকতার সূচনা। এটি প্রমাণ করে দিয়েছে যে স্বপ্ন, পরিশ্রম, এবং গ্রাহকের চাহিদা বোঝার ক্ষমতা থাকলে গ্যারেজ থেকেও গড়ে তোলা যায় আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান।
গলি ঘেঁষা যে শহরের পুরনো বেকারিগুলো ছিল ইতিহাসের অংশ, সেই শহরেই Mr. Baker হয়ে উঠেছে ভবিষ্যতের রুচি, ডিজাইন ও উদযাপনের প্রতীক।
সমাপ্ত