ঢাকা, বাংলাদেশ, ১৯ জুন ২০২৫: বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৫ উপলক্ষে আজ আইসিডিডিআর,বি-র এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ রিসার্চ গ্রুপ এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করি’ এই বৈশ্বিক প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আয়োজিত এই উদযাপনে গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উন্নয়ন সহযোগী, সরকারি কর্মকর্তা এবং পরিবেশকর্মীরাসহ তিন শতাধিক মানুষ অংশ নেন।
আইসিডিডিআর,বি-এর নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। তিনি প্লাস্টিক দূষণ এবং নগরের ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “পরিবেশ নিয়ে আমাদের সব কাজের মূল লক্ষ্যই হলো মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। আমাদের গবেষণা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা আবর্জনার স্তূপ এবং সিসার মতো নীরব দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এর কারণে পুষ্টির অভাব, অপুষ্টি এবং এমনকি মস্তিষ্কের বিকাশেও সমস্যা হয়। তাই আমাদের মানুষের ভালো থাকার জন্য এসব পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি।”
এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড ওয়াশ প্রোগ্রামের প্রধান ও প্রকল্প সমন্বয়ক ড. মো. মাহবুবুর রহমান পরিবেশগত স্বাস্থ্যে আইসিডিডিআর,বি-র গবেষণা এবং প্রমাণ-ভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে অর্জিত উল্লেখযোগ্য সাফল্যের কথা তুলে ধরেন। এছাড়াও, অনুষ্ঠানে পরিবেশের সুস্থতা আর জনস্বাস্থ্যের গভীর সম্পর্ক তুলে ধরা হয়, বিশেষ করে যত্রতত্র পড়ে থাকা আবর্জনার স্তূপের ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এখান থেকে উৎপন্ন ব্যাকটেরিয়া আন্ত্রিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং অপুষ্টির কারণ হতে পারে।
আলোচনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও সুপারিশের ওপর জোর দেওয়া হয়, যার সপক্ষে তথ্য-প্রমাণও তুলে ধরা হয়। প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায়, যার বৈশ্বিক উৎপাদন ২০০৪ সাল থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৪৩ কোটি মেট্রিক টনে পৌঁছেছে, ব্যক্তিগতভাবে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পরিহার এবং প্রাকৃতিক তন্তুর পোশাক বেছে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া, কমিউনিটি পর্যায়ে বর্জ্য সংগ্রহ ও আলাদা করার সুসংগঠিত উদ্যোগের কথাও বলা হয়। শিল্পের জন্য পরিবেশবান্ধব মোড়ক ব্যবহার এবং সঠিক পরিস্রাবণ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। নীতিগত পর্যায়ে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়, এবং উৎপাদকদের দায়িত্ব বাড়ানো বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়।
সিসা দূষণের বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত স্বাস্থ্য সাফল্যের কথা তুলে ধরা হয়। ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন এর তিথ্য অনুসারে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। এর একটি বড় উৎস হিসেবে হলুদ গুঁড়োতে থাকা লেড ক্রোমেটকে চিহ্নিত করা হয়। এই গবেষণার ফলস্বরূপ সরকার লেড ক্রোমেট আমদানি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়, যার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হলুদে সিসার দূষণ ২৭% থেকে একেবারে ০%-এ নেমে আসে। সিসা নিয়ে আরও বৃহত্তর কর্মপরিকল্পনায় বাতাস, জল এবং মাটি থেকে বিষাক্ত দূষণ দূর করা, লেড-এসিড ব্যাটারির পুনর্ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা, বাজার থেকে সিসাযুক্ত পণ্য সরানো, শিল্প ও যানবাহনের সিসা নির্গমন নিয়ন্ত্রণ করা, ভোক্তা পণ্যে সিসামুক্ত মান নিশ্চিত করা এবং মসলা ও খাদ্য পণ্যের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ইটভাটার ধোঁয়া কমানোর জন্য উদ্ভাবনী, কম খরচের সমাধানও উপস্থাপন করা হয়। এই ভাটাগুলো বার্ষিক কার্বন ডাই অক্সাইডের ১১% এবং ঢাকা শহরের পিএম২.৫-এর ৫৮% এর জন্য দায়ী। বাস্তবায়িত সমাধানগুলো উল্লেখযোগ্য ফলাফল দেখিয়েছে, যার মধ্যে কয়লার ব্যবহার ২৩% হ্রাস এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ও পিএম২.৫ নির্গমন ২০% হ্রাস। এছাড়াও, হাসপাতালগুলোতে বর্জ্য জল ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের জরুরি প্রয়োজন তুলে ধরা হয়। গরমে বাইরের কর্মীদের ওপর তাপের প্রভাব মোকাবিলায় কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়; তথ্য বলছে, গ্রীষ্মকালে ১৫% কৃষি শ্রমিকের হিট এক্সহশন হয় এবং ১০% হিট স্ট্রোকের শিকার হন।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রতিযোগিতামূলক গবেষণা প্রদর্শনী, যেখানে ৫০০টিরও বেশি জমা পড়া অ্যাবস্ট্রাক্ট এর মধ্য থেকে সেরা তিনটি রিসার্চ পেপার উপস্থাপন করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারহানা মুস্তারিন তার গবেষণা “নগর তাপ হ্রাস: ঢাকায় তাপপ্রবাহ সহনশীলতার জন্য প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের মূল্যায়ন” উপস্থাপন করেন। তার কাজে ঢাকার ঘনবসতি এবং অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের ফলে সৃষ্ট তাপপ্রবাহের ঝুঁকির বিষয়টি উঠে আসে। তিনি নগর তাপদ্বীপ প্রভাব কমাতে এবং মানুষের স্বস্তি বাড়াতে ছাদবাগান ও রাস্তার পাশের সবুজায়নের মতো প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের প্রস্তাব করেন।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শাবিহা সুলতানা নূহা “বর্জ্য থেকে সম্পদ: খাদ্য বর্জ্য থেকে বায়োডিগ্রেডেবল কাটলারির উদ্ভাবন” শীর্ষক তার গবেষণাটি তুলে ধরেন। এই গবেষণায় কলার খোসা, ধানের তুষ এবং কাঁঠালের বীজের মতো খাদ্য বর্জ্য ব্যবহার করে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব খাওয়ার সরঞ্জাম (চামচ, ছুড়ি, ইত্যাদি) তৈরির সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ঢাকায় পরিচালিত ভোক্তা জরিপে দেখা যায়, এই সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব সমাধানটির প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।
ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শরাফ নওয়ার উপস্থাপন করেন “ঢাকার ল্যান্ডফিল থেকে প্লাস্টিক-হ্রাসকারী সিউডোমোনাস: বৈশ্বিক প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি প্রতিশ্রুতিশীল পদ্ধতি” শীর্ষক তার গবেষণা। এই গবেষণায় ঢাকার ল্যান্ডফিল থেকে পৃথক করা সিউডোমোনাস ব্যাকটেরিয়ার প্লাস্টিক হজম করার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়, যা প্রচলিত বর্জ্য নিষ্পত্তির একটি টেকসই বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ফলাফলগুলো টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থার দিকে পরিবর্তনে অণুজীবের ভূমিকা স্পষ্ট করে তোলে।
এছাড়াও, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও সমাধানগুলোকে ছবির মাধ্যমে তুলে ধরতে একটি আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এই প্রতিযোগিতায় অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়, যেখানে ১,১০০টিরও বেশি ছবি জমা পড়েছিল। অংশগ্রহণকারীরা স্মার্টফোন বা পেশাদার ক্যামেরা ব্যবহার করে তাদের নিজস্ব গল্প ও পরিবেশ ভাবনা তুলে ধরেছিলেন। এই চমৎকার ছবিগুলোর মধ্য থেকে সেরা ১০টি ছবি প্রদর্শনীতে স্থান পায়, এবং বিচারকদের রায়ে শীর্ষ ৩জন ফটোগ্রাফার – মো. আল-আমিন ইসলাম, মো. শাজাহান, এবং কাজী আরিফুজ্জামানকে পুরস্কৃত করা হয়। এই উদ্যোগটি পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান। আরো উপস্তিত ছিলেন ডা. মো. জয়নাল আবেদিন টিটু, লাইন ডিরেক্টর, হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট, ডিজিএইচএস।
এছাড়াও, ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতার বিচারকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ক্যাম্পেইন এবং আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় জমা পড়া কাজগুলো সম্পর্কে মূল্যবান মতামত দেন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, “এখানে উপস্থিত পরিবেশ সুরক্ষার চ্যাম্পিয়ন এবং বিশেষ করে আইসিডিডিআর,বি-এর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা দেখে আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত। প্লাস্টিক দূষণের মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং প্রতিটি নাগরিকের সম্মিলিত অঙ্গীকার অপরিহার্য।”
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, “এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আইসিডিডিআর,বি-র মেধাবী গবেষকদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, আপনাদের গবেষণা ও উদ্ভাবনগুলো আমাদের নীতি নির্ধারণে সহায়ক হবে। পরিবর্তনের ক্ষমতা প্রতিটি নাগরিকের হাতেই নিহিত; কোটি কোটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ যখন সম্মিলিত হয়, তখন তা পরিবর্তনের এক বিশাল ঢেউ সৃষ্টি করে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যেন প্লাস্টিকের স্তূপ রেখে না যাই, বরং রেখে যাই একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ—এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।”
আইসিডিডিআর,বি-এর এইচএসপিএসডি-এর সিনিয়র ডিরেক্টর ড. সারা সালওয়ে তার বক্তব্যে এই প্রাণবন্ত উদযাপনকে সফল করে তোলার জন্য সকল বিশিষ্ট অতিথি, প্রতিযোগী এবং অংশগ্রহণকারীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
অনুষ্ঠানের শেষে পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা যারা অনুপ্রেরণামূলক কাজ করেছেন, তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত পরিবেশ বান্ধব সেরা উদ্যোগ এবং অসাধারণ অবদানগুলোকে পুরস্কৃত করা হয়।
পোস্টার উপস্থাপনার জন্য সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন; রুবিনূর ইসলাম (শ্রেষ্ঠ পোস্টার), রয়েল হোসেন, তাশফিয়া হাসান, নাজিফ মুহাম্মদ, আনোয়ার হোসেন রয়হান, বুশরা হামিদ, নাফিসা আবেদীন, জয়শ্রী কর্মকার, মোঃ নাজিফা ইশরাত তাসনিম এবং তাশদিকা মাহদী হোসেন। রিসার্চ অ্যাবস্ট্রাক্টের মৌখিক উপস্থাপনার জন্য সম্মানিত হয়েছেন শারাফ নাওয়ার (শ্রেষ্ঠউপস্থাপক), ফারহানা মুস্তারিন এবং শাবিহা সুলতানা নুহা।
আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার বিজয়ীরা হলেন মোঃ আল-আমিন ইসলাম, মোহাম্মদ শাহজাহান এবং কাজী আরিফুজ্জামান। সম্মাননাপ্রাপ্তরা হলেন মোঃ শহীদুল আলম, ডা. কুমার বিশ্বজিৎ সূত্রধর, মোঃ আহিদুল হাসান, মোঃ জাবেদ নূর শান্ত, বিধান চন্দ্র দাস, মোহাম্মদ শাহজাহান, মোহাম্মদ সুম্মন।
পরিবেশ বিষয়ক অনুপ্রেরণাদায়ী উদ্যোগ এর জন্য সম্মানিত করা হয় হোপ ইন হার হ্যান্ডস (সংগঠন) এবং মাহমুদ রহমান (ব্যক্তি) এর ফিফটি ফাইভ কদমতলা উদ্যোগকে। হ্যাশট্যাগ রিতআর্থ রিবার্থ সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করে সম্মাননা পেয়েছেন অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ, ইয়াসমিন আক্তার ও আরকে সোহান।