প্রযুক্তি বদলাচ্ছে দেশ, তবে শিক্ষা বদলাবে ভবিষ্যৎ
গত এক দশকে ভারত ডিজিটাল রূপান্তরের পথে দ্রুত এগিয়েছে। স্মার্টফোনের বিস্তার, ইউপিআই-এর সাফল্য, আধার ব্যবস্থার পরিপক্কতা—সবই এই পরিবর্তনের চিহ্ন। কিন্তু টেকনোলজিভিত্তিক এই অগ্রগতিকে টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ভবিষ্যতপ্রস্তুত করতে হলে তা শুধু প্ল্যাটফর্মেই সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। বাস্তব পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করতে হবে শ্রেণিকক্ষে, গবেষণাগারে, আর গ্রামীণ বা নগরপল্লির কমিউনিটি সেন্টারে—যেখানে গড়ে উঠবে আগামী দিনের উদ্ভাবকেরা।
এই প্রয়াসের কেন্দ্রে রয়েছে ‘হাতে-কলমে’ এসটিইএম (STEM: বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) শিক্ষা, যা মুখস্থনির্ভর বা পরীক্ষাকেন্দ্রিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর জোর দেয়। জনসংখ্যার বিশাল সম্ভাবনা এবং শিক্ষার বৈষম্যে জর্জরিত একটি দেশের জন্য এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কার্যকর পথ।
হাতে-কলমে শেখার প্রয়োজনীয়তা
ভারতের প্রচলিত এসটিইএম শিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে তত্ত্বনির্ভর থেকেছে। পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনে তার প্রয়োগ করতে পারে না। কিন্তু রোবট বানানো, আবহাওয়া অ্যাপ কোডিং করা, কিংবা সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থা ডিজাইন করার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী জ্ঞানগ্রাহী থেকে রূপ নেয় সমস্যার সমাধানকারী হিসেবে।
এই অভিজ্ঞতাধর্মী শিক্ষা শিক্ষার্থীদের দেয় ২১ শতকের গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা—যেমন কম্পিউটেশনাল চিন্তাভাবনা, সহযোগিতা, অভিযোজনক্ষমতা—যা শুধু বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীর জন্য নয়, বর্তমানের পরিবর্তনশীল বিশ্বে বেঁচে থাকার জন্যও অপরিহার্য। সবচেয়ে বড় কথা, এই শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিখে কীভাবে তাদের সমাজ ও বাস্তবতার সঙ্গে শিক্ষাকে যুক্ত করতে হয়।
সেন্ট্রাল স্কয়ার ফাউন্ডেশনের ২০২৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি স্কুলে নেই ল্যাব বা হাতে-কলমে বিজ্ঞান শেখার সুযোগ—এটা একটা বড় অবকাঠামোগত ঘাটতি, যা দ্রুত সমাধান প্রয়োজন।
সমান সুযোগের ভিত্তি গড়ার চাবিকাঠি
ভারতের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ তখনই শক্তিশালী হবে, যখন তা দেশের প্রতিটি ছেলেমেয়েকে অন্তর্ভুক্ত করবে। আজও গ্রামীণ, দরিদ্র এবং মেয়েদের অংশগ্রহণ এসটিইএম শিক্ষায় কম।
এই ব্যবধান ঘোচাতে পারে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা। যখন একটি গ্রামের মেয়ে কোডিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় বা কোনো সমস্যা সমাধানে বাস্তব মডেল তৈরি করে, তখন শুধু তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে না, ভবিষ্যৎ নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে যায়। এই ধরনের অভিজ্ঞতা মেয়েদের বাল্যকাল থেকেই এসটিইএম ক্ষেত্রে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০২৪ সালের ‘Gender in Education’ পর্যালোচনায় দেখা যায়, হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রোগ্রাম গ্রামীণ এলাকায় মেয়েদের বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ ২৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অর্থনীতির প্রস্তুতি
বিশ্ব এখন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্বয়ংক্রিয়তা এবং ডেটাভিত্তিক অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে। ভারতকে এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু শুধু প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হলেই হবে না, তৈরি করতে হবে প্রযুক্তি—এখানেই আসে ‘বিল্ডার মাইন্ডসেট’।
স্বাস্থ্যখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার, গ্রামীণ সহনশীলতা বৃদ্ধিতে জলবায়ু প্রযুক্তি—সবই ভবিষ্যতের উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দু। হাতে-কলমে শেখা শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে কিভাবে বিভিন্ন সিস্টেম পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, কোথায় ঘাটতি, এবং কীভাবে ব্যবহারকারীর উপযোগী সমাধান তৈরি করা যায়।
নাসকমের ২০২৪ সালের ‘Future of Work’ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতীয় কোম্পানিগুলোর ৯০ শতাংশ কর্মী হাতে-কলমে এআই ও ডেটা দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী, এবং ৬০ শতাংশ চায় বাস্তব প্রকল্পে এই দক্ষতা প্রয়োগ করতে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাধর্মী শিক্ষা মূল স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রয়োজন বহুমাত্রিক অংশীদারিত্ব
এসটিইএম শিক্ষার অভিজ্ঞতাধর্মী রূপকে সর্বজনীন করতে হলে প্রয়োজন গভীর ও টেকসই অংশীদারিত্ব—সরকার, বেসরকারি খাত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সিভিল সোসাইটির মধ্যে।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে mentorship, বাস্তব শিল্পসংযোগ, অবকাঠামো এবং বিনিয়োগ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এতে শ্রেণিকক্ষের শেখার সঙ্গে কর্মসংস্থানের চাহিদার সেতুবন্ধন সম্ভব হয়।
NEP 2020 তত্ত্বনির্ভর থেকে অনুসন্ধানভিত্তিক শেখার দিকে মনোযোগ দিলেও বাস্তবায়নেই রয়েছে মূল চ্যালেঞ্জ। NCERT-এর ২০২৪ সালের অডিট জানায়, মাত্র ৩৫ শতাংশ স্কুল এখনো পর্যন্ত কার্যকরভাবে হাতে-কলমে এসটিইএম প্রোগ্রাম চালু করতে পেরেছে। তাই জরুরি হয়ে উঠেছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, কারিকুলামের উন্নয়ন, এবং বৃহৎ পরিসরের ডিজাইনের প্রয়োগ।
তলদেশ থেকে নতুন ভিত গড়া
ভারতের ডিজিটাল লক্ষ্য উচ্চাভিলাষী, এবং হওয়াটাই উচিত। কিন্তু দেশের ২৫ কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে এই যাত্রায় যুক্ত করতে হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে ভাবতে হবে। হাতে-কলমে এসটিইএম শিক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজন।
এই শিক্ষা যুব সমাজকে দেয় জ্ঞানকে প্রশ্ন করার, বিশ্লেষণ করার এবং নিজের বাস্তবতা পরিবর্তন করার সাহস। যখন আমরা বিজ্ঞানকে সবার জন্য উন্মুক্ত করি, হাতে-কলমে ও মানবিক দৃষ্টিকোণে নিয়ে আসি, তখন আমরা শুধু চাকরিপ্রার্থী তৈরি করি না, তৈরি করি ভবিষ্যতের নির্মাতা।
এভাবেই আমরা গড়ে তুলতে পারি একটি উদ্ভাবনী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজিটাল ভারত।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, দ্য ইনোভেশন স্টোরি (ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীদের জন্য উদ্ভাবনকে সহজলভ্য করে তুলতে কাজ করে এমন একটি এসটিইএম শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম)