০৪:৫৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

হিমসাগরের ঘ্রাণ মিষ্টি, জলিল মিয়ার লাভ তেতো

ভোরের নরম রোদহিমসাগরের মিষ্টি ঘ্রাণ

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ঝাউডাঙা গ্রামের আমবাগানে ভোর সাড়ে পাঁচটা। কুয়াশা-ছলছল পাতার ফাঁক গলে ফোঁটায় ফোঁটায় রোদ পড়ছে। গাছ থেকে নামানো তরতাজা হিমসাগর বাঁশের ঝুড়িতে সাজানো। বাগানের চারদিকজুড়ে যেন একরাশ মধুমিষ্টি গন্ধ। এই গন্ধই মোহিত করে ব্যবসায়ীদের, টানে দূর-দূরান্তের পাইকার ও অনলাইন হোম-ডেলিভারি সংস্থাগুলোর কাভার্ড ভ্যান।

“গত বছর এই সময় ২,৯০০ টাকায় মণ বিক্রি করেছি,” বললেন ৫৫ বছর বয়সী আমচাষি আবদুল জলিল। এবার তাঁর ৪০ বিঘার বাগানে উৎপাদন হয়েছে প্রায় চারশো মণ। কিন্তু দাম দাঁড়িয়েছে ১,৮০০ থেকে ২,২০০ টাকার মধ্যে। “খরচ তো কমেনি—সার, শ্রম, বাগান পরিষ্কার, পলিব্যাগ—সব মিলিয়ে মণে হাজার টাকার ওপর। চারটে ফকির খেদানো হলো বটে, কিন্তু লাভের দিকটা মিষ্টি না ঝাঁঝালো—এখনই বোঝা যাচ্ছে না,” আক্ষেপ তাঁর কণ্ঠে।

সাতক্ষীরার আগাম বাজারে খুচরা ক্রেতার ভিড়

সাতক্ষীরা জেলা সদরের শ্যামনগর হাটে দুপুরে গিয়ে দেখা যায় তুমুল কোলাহল। মাছের বাজার পেরিয়ে ফল-গলির গোড়ায় দাঁড়ালেই হিমসাগর, গোপালভোগ আর ক্ষিরসাপাতের স্তূপ। লোহার পাল্লা চড়ে প্রতি কেজি ৬৫–৭০ টাকা—খুচরায় ১১৫–১৫০। দোকানদার মিজানুর রহমান বললেন, “ঈদের আগে ৯০–৯৫ টাকায় পাইকারি তুলেছি। এবার ছুটির পর ভ্যান থামেনি, কিন্তু ক্রেতা কমে গেছে। তাই দামও গেল নামে।”

বাজারের পাশেই কুরিয়ার অফিস। ‘ঢাকামুখী’ ফলভরা কার্টন লোড হচ্ছে পিকআপে—কার্টনের বড় অক্ষরে লেখা, “কোল্ড-চেইন বজায় রাখুন—হিমসাগর ১২ ঘণ্টায় ঢাকায়।” তবু পরিবহন-ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা নিয়ে শঙ্কা আছে। চালক নূর হোসেন বললেন, “ছুটি পড়লেই সড়ক বন্ধ, মাঝপথে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। ফল নরম হয়ে যায়; দাম পড়ে।”

রাজশাহীর বাঘা হাট: সাড়ে তিন শত মৌসুমী আড়তের দীর্ঘশ্বাস

রাজশাহীর বাঘা হাটে ঈদের ষষ্ঠ দিন সকাল। পাকা ক্ষিরসাপাত ও ল্যাংড়ার গন্ধে ভরে আছে হাটের ২০০ গজ জায়গা, কিন্তু ক্রেতা নেই তেমন। ইমরান হোসেন ১৫ মণ ক্ষিরসাপাত সাজিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। “বাগানে তুলে মণ-দর ১,২০০ টাকা। তিন বছর আগে এই দাম মানে বিশাল লাভ ছিল। এখন সার, কীটনাশক, ব্যাগ, দিনমজুর—সব মিলিয়ে একেক মণেই ১,০৫০–১,১০০ টাকা পড়ে যায়,” তিনি হিসাব দিলেন।

সামনের চায়ের দোকানে বসে থাকা কৃষক-নেতা আয়েশা খাতুন যোগ করলেন, “মেয়েদেরও এখন বাগানে কাজ বাড়ছে। দিনে ৪৫০ টাকা মজুরি ছাড়া এরা মেলে না। আগের তুলনায় দেড় গুণ খরচ, অথচ কিনে নিয়ে যাঁরা ঢাকায় বিক্রি করেন, তাঁরা দাম বাড়ায় না।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোটর-আম’ ট্রেনের আশায়

শিবগঞ্জের কানসাট হাট ছুটির পরদিনও জমেছিল, কিন্তু দর কিঞ্চিৎ কম। টিন-পর্দা টাঙানো একপাশে ১৬ চাকার ট্রাকে ল্যাংড়া প্যাক হচ্ছে চটের বস্তায়। ট্রাক-ড্রাইভার মুকুল জানালেন, “ঢাকা যেতেই ২২–২৩ হাজার টাকার ডিজেল জ্বলে যায়। তেলের দাম উল্টো বাড়ছে, আর আমের দাম পড়ছে। মালিক ৩০–৩২ টাকা কেজিতে কিনে ঢাকায় বিক্রি করেন ৫০–৫৫ টাকায়; মাঝখানে খালি ভাড়া-খরচ।”

চাষি আবুল কাশেম (৪২) ট্রেন-স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মচারীকে ধরে অনুযোগ করছিলেন, “ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন চলছে ঠিকই, কিন্তু রেলের ওভারহেড চার্জ আগে ৮০ পয়সা ছিল, এখন ১.৩০ টাকা কেজি। তবু ট্রাকের চেয়ে সস্তা। এই ট্রেন না থাকলে তো আর লোকসানই হতো।”

আমের আগাম পাকা আর আবহাওয়ার ছলের ছোঁয়া

রাজশাহী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বুঝিয়ে দিলেন, গ্রীষ্মজুড়ে অস্বাভাবিক তাপ ও অনিয়মিত বৃষ্টি একসঙ্গে ফল পাকিয়েছে। “যখন একসঙ্গে গাছে পাকা ধরে, তখন বাজারও ভেসে যায়; চাষি তখন সংরক্ষণ না করে ঝটপট কাটতে বাধ্য হন। ফলে দামে ধস নামে,” তিনি বললেন।

এ পরিস্থিতিতে অনেক বাগানেই এবার ‘বাগিং’ বা কাগজের ব্যাগে আম ঢেকে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। সাতক্ষীরার শফিকুল ইসলাম ব্যাগ লাগিয়েছেন ১০ শতাংশ গাছে। “খরচ মণে ৮০–১০০ টাকা বাড়ে, কিন্তু দাগ কমে, কেমিক্যাল লাগাতে হয় না—দামও ২০০–২৫০ টাকা বেশি মেলে,” তাঁর বক্তব্য।

কৃষকের কণ্ঠ: লাভ নাকি লোকসান?

সাতক্ষীরার আবদুল জলিল

“চার দিন পরে ঢাকায় আমার ব্যবসায়ী ৯০ কেজির পার্সেল ফেরত পাঠাইছে—ঘাম ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে ৬–৭ হাজার টাকা লস হয়েছে। দাম তো কমছে, তার ওপর নষ্টের ভয়। এদিকে ব্যাংকের কিস্তি ঘাড়ে।”

রাজশাহীর রুবিনা বেগম

“আমি বাগানে ২২ বিঘায় আম করি। ক্ষিরসাপাত আর আম্রপালি মিলে এবার ৪১৫ মণ হয়েছে। দাম কেজি ৩৫ টাকায় বিক্রি করলে সংসার চলে যায়, কিন্তু এখন মোটরখরচ বাদে হাতে থাকছে ২৫–২৬ টাকা।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কলেজছাত্র-চাষি সোহেল রানা

“ল্যাংড়া খেতে মজা, বিক্রি করতে মজা নেই! পাইকার ১,৫০০ টাকা মণে দিয়েছে, আমি ৩ বিঘায় ৬০ মণ তুলে ৯০ হাজার পেয়েছি। খরচ উঠেছে ৭০ হাজার। লাভ ২০ হাজার—সারা বছরের জন্য খুব বেশি না।”

বাজারের ভেতরের চিত্র

ঢাকার কারওয়ান বাজারে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ট্রাক থেকে নামছে সবুজ-এশ ও হিমসাগর। প্রচুর ফল ছাড়াও ক্রেতা চোখে পড়ে কম। একটা দোকানের সামনে লেখা, “ফ্যামিলি প্যাক—কেজি ১২০ টাকা”—যেখানে ঈদের আগে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দোকানদার সোহাগ জানান, “মঙ্গলবার ট্রাক কম, সেদিন দাম বাড়ে; কিন্তু সাধারণত পচা-বিষের ভয়ে লোক কম কিনছে।”

একই বাজারে অনলাইন-ভিত্তিক ডেলিভারি স্টার্ট-আপ ‘ফ্রুটফ্রেশ’ স্টলের সামনে ৫–৬ জন তরুণ পলিব্যাগে আম বাছাই করছেন। কোম্পানির অপারেশন ম্যানেজার ফারিয়া সুলতানা জানালেন, “চাষি থেকে সরাসরি সংগ্রহ করি বলে গড়ে ১০–১২ টাকা বেশি দিই; আবার ঢাকায় ক্রেতাকে ১৫–২০ টাকা লাভে বিক্রি করি। মাঝখানের লজিস্টিক ঠিক থাকলে চাষি-ভোক্তা দু’পক্ষই উপকৃত।”

 

লাভ-লোকসানের হিসাবের খাতা

এলাকা গড় বিক্রিমূল্য (মণ) গড় খরচ (মণ) নেট লাভ/ক্ষতি লাভের হার
সাতক্ষীরা ১,৮০০–২,২০০ ১,০০০–১,১০০ ৭০০–১,১০০ ১৫–৩০ % লাভ
রাজশাহী ১,০০০–১,৬০০ ৯০০–১,১০০ −১০০ থেকে ৬০০ ব্রেক-ইভেন বা ৫–১০ % ক্ষতি
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১,৫০০–১,৮০০ ১,০০০–১,১০০ ৪০০–৭০০ ৮–১২ % সামান্য লাভ

খরচে জমি-ভাড়া ধরা হয়নিমালিকানাধীন জমিতে লাভ তুলনামূলক বেশি।

প্রশাসনের উদ্যোগ ও চাষিদের প্রত্যাশা

সাতক্ষীরায় জেলা প্রশাসন ‘জাত-ভেদে আম পাড়া ক্যালেন্ডার’ কঠোরভাবে মানতে মাঠ-পর্যায়ে মনিটরিং বাড়িয়েছে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘ম্যাংগো স্পেশাল’ ট্রেনকে টিকিয়ে রাখতে রেল-ভাড়া ছাড়ের দাবি জানিয়েছে চাষি-ব্যবসায়ী মঞ্চ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (রাজশাহী) গৌতম রায় জানালেন, সিটি করপোরেশনের ভোক্তা বাজারে ‘কোঅপারেটিভ বুথ’ চালু হলে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমবে। চাষিরাও চাইছেন, সরকার যেন নির্দিষ্ট উৎপাদন-খরচের ভিত্তিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করে।

সামনে কী?

  • দ্বিতীয় ধাপের ফজলিআশ্বিনা ও বারি-৪ – জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে বাজারে ঢুকবে। অতিরিক্ত সরবরাহ না হলে দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
  • রপ্তানি – বেসরকারিভাবে ১০ হাজার টন চীনে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখনো মাত্র ২,৭০০ টন গেছে; দাম বাড়লে রপ্তানি বাড়লেও চাষির লাভ নিশ্চিত নয়।
  • প্রক্রিয়াজাত শিল্প – রাজশাহীর বহরমপুরে স্থাপিত নতুন পাল্প-ফ্যাক্টরি ৫ হাজার টন আম কিনতে পারে; এতে নষ্ট হয়ে যাওয়া ফলেরও দাম পেতে পারেন ক্ষুদ্র চাষি।
হিম সাগর আমের

ফল-মিষ্টিহাসি-ফিকে

সবুজ-হলুদ ছোপের হিমসাগর, ছাই-রঙা ক্ষিরসাপাত, বাসন্তী-ল্যাংড়া—দেখতেই যেন চোখে জল আসে। কিন্তু এ সৌন্দর্যের সাথেই জড়িয়ে আছে হিসাবের খাতা ও ব্যাংক-কিস্তির দুশ্চিন্তা। সাতক্ষীরার জলিল মিয়া বললেন, “আমের গন্ধে যেদিন বাজার ভরে, সেদিনই তো আমাদের ঘর ভরে ওঠে। কিন্তু যদি দাম না মেলে, তাহলে ওই মিষ্টি ঘ্রাণ কেমন হঠাৎই ফিকে লাগে।”

এভাবেই আমের মধুমাসে লাভ-লোকসানের টানাপোড়েনে বাঁচছে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সাতক্ষীরার শত শত পরিবার—জীবন আর স্বপ্ন সবকটিই যেন গাছের ডালে ঝুলে থাকা অপরিপক্ক ফল, কখন ধরে, কখন ঝরে—কেবল সময়ই জানে।

 

হিমসাগরের ঘ্রাণ মিষ্টি, জলিল মিয়ার লাভ তেতো

০৭:১২:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

ভোরের নরম রোদহিমসাগরের মিষ্টি ঘ্রাণ

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার ঝাউডাঙা গ্রামের আমবাগানে ভোর সাড়ে পাঁচটা। কুয়াশা-ছলছল পাতার ফাঁক গলে ফোঁটায় ফোঁটায় রোদ পড়ছে। গাছ থেকে নামানো তরতাজা হিমসাগর বাঁশের ঝুড়িতে সাজানো। বাগানের চারদিকজুড়ে যেন একরাশ মধুমিষ্টি গন্ধ। এই গন্ধই মোহিত করে ব্যবসায়ীদের, টানে দূর-দূরান্তের পাইকার ও অনলাইন হোম-ডেলিভারি সংস্থাগুলোর কাভার্ড ভ্যান।

“গত বছর এই সময় ২,৯০০ টাকায় মণ বিক্রি করেছি,” বললেন ৫৫ বছর বয়সী আমচাষি আবদুল জলিল। এবার তাঁর ৪০ বিঘার বাগানে উৎপাদন হয়েছে প্রায় চারশো মণ। কিন্তু দাম দাঁড়িয়েছে ১,৮০০ থেকে ২,২০০ টাকার মধ্যে। “খরচ তো কমেনি—সার, শ্রম, বাগান পরিষ্কার, পলিব্যাগ—সব মিলিয়ে মণে হাজার টাকার ওপর। চারটে ফকির খেদানো হলো বটে, কিন্তু লাভের দিকটা মিষ্টি না ঝাঁঝালো—এখনই বোঝা যাচ্ছে না,” আক্ষেপ তাঁর কণ্ঠে।

সাতক্ষীরার আগাম বাজারে খুচরা ক্রেতার ভিড়

সাতক্ষীরা জেলা সদরের শ্যামনগর হাটে দুপুরে গিয়ে দেখা যায় তুমুল কোলাহল। মাছের বাজার পেরিয়ে ফল-গলির গোড়ায় দাঁড়ালেই হিমসাগর, গোপালভোগ আর ক্ষিরসাপাতের স্তূপ। লোহার পাল্লা চড়ে প্রতি কেজি ৬৫–৭০ টাকা—খুচরায় ১১৫–১৫০। দোকানদার মিজানুর রহমান বললেন, “ঈদের আগে ৯০–৯৫ টাকায় পাইকারি তুলেছি। এবার ছুটির পর ভ্যান থামেনি, কিন্তু ক্রেতা কমে গেছে। তাই দামও গেল নামে।”

বাজারের পাশেই কুরিয়ার অফিস। ‘ঢাকামুখী’ ফলভরা কার্টন লোড হচ্ছে পিকআপে—কার্টনের বড় অক্ষরে লেখা, “কোল্ড-চেইন বজায় রাখুন—হিমসাগর ১২ ঘণ্টায় ঢাকায়।” তবু পরিবহন-ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা নিয়ে শঙ্কা আছে। চালক নূর হোসেন বললেন, “ছুটি পড়লেই সড়ক বন্ধ, মাঝপথে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। ফল নরম হয়ে যায়; দাম পড়ে।”

রাজশাহীর বাঘা হাট: সাড়ে তিন শত মৌসুমী আড়তের দীর্ঘশ্বাস

রাজশাহীর বাঘা হাটে ঈদের ষষ্ঠ দিন সকাল। পাকা ক্ষিরসাপাত ও ল্যাংড়ার গন্ধে ভরে আছে হাটের ২০০ গজ জায়গা, কিন্তু ক্রেতা নেই তেমন। ইমরান হোসেন ১৫ মণ ক্ষিরসাপাত সাজিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। “বাগানে তুলে মণ-দর ১,২০০ টাকা। তিন বছর আগে এই দাম মানে বিশাল লাভ ছিল। এখন সার, কীটনাশক, ব্যাগ, দিনমজুর—সব মিলিয়ে একেক মণেই ১,০৫০–১,১০০ টাকা পড়ে যায়,” তিনি হিসাব দিলেন।

সামনের চায়ের দোকানে বসে থাকা কৃষক-নেতা আয়েশা খাতুন যোগ করলেন, “মেয়েদেরও এখন বাগানে কাজ বাড়ছে। দিনে ৪৫০ টাকা মজুরি ছাড়া এরা মেলে না। আগের তুলনায় দেড় গুণ খরচ, অথচ কিনে নিয়ে যাঁরা ঢাকায় বিক্রি করেন, তাঁরা দাম বাড়ায় না।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোটর-আম’ ট্রেনের আশায়

শিবগঞ্জের কানসাট হাট ছুটির পরদিনও জমেছিল, কিন্তু দর কিঞ্চিৎ কম। টিন-পর্দা টাঙানো একপাশে ১৬ চাকার ট্রাকে ল্যাংড়া প্যাক হচ্ছে চটের বস্তায়। ট্রাক-ড্রাইভার মুকুল জানালেন, “ঢাকা যেতেই ২২–২৩ হাজার টাকার ডিজেল জ্বলে যায়। তেলের দাম উল্টো বাড়ছে, আর আমের দাম পড়ছে। মালিক ৩০–৩২ টাকা কেজিতে কিনে ঢাকায় বিক্রি করেন ৫০–৫৫ টাকায়; মাঝখানে খালি ভাড়া-খরচ।”

চাষি আবুল কাশেম (৪২) ট্রেন-স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মচারীকে ধরে অনুযোগ করছিলেন, “ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন চলছে ঠিকই, কিন্তু রেলের ওভারহেড চার্জ আগে ৮০ পয়সা ছিল, এখন ১.৩০ টাকা কেজি। তবু ট্রাকের চেয়ে সস্তা। এই ট্রেন না থাকলে তো আর লোকসানই হতো।”

আমের আগাম পাকা আর আবহাওয়ার ছলের ছোঁয়া

রাজশাহী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বুঝিয়ে দিলেন, গ্রীষ্মজুড়ে অস্বাভাবিক তাপ ও অনিয়মিত বৃষ্টি একসঙ্গে ফল পাকিয়েছে। “যখন একসঙ্গে গাছে পাকা ধরে, তখন বাজারও ভেসে যায়; চাষি তখন সংরক্ষণ না করে ঝটপট কাটতে বাধ্য হন। ফলে দামে ধস নামে,” তিনি বললেন।

এ পরিস্থিতিতে অনেক বাগানেই এবার ‘বাগিং’ বা কাগজের ব্যাগে আম ঢেকে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। সাতক্ষীরার শফিকুল ইসলাম ব্যাগ লাগিয়েছেন ১০ শতাংশ গাছে। “খরচ মণে ৮০–১০০ টাকা বাড়ে, কিন্তু দাগ কমে, কেমিক্যাল লাগাতে হয় না—দামও ২০০–২৫০ টাকা বেশি মেলে,” তাঁর বক্তব্য।

কৃষকের কণ্ঠ: লাভ নাকি লোকসান?

সাতক্ষীরার আবদুল জলিল

“চার দিন পরে ঢাকায় আমার ব্যবসায়ী ৯০ কেজির পার্সেল ফেরত পাঠাইছে—ঘাম ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে ৬–৭ হাজার টাকা লস হয়েছে। দাম তো কমছে, তার ওপর নষ্টের ভয়। এদিকে ব্যাংকের কিস্তি ঘাড়ে।”

রাজশাহীর রুবিনা বেগম

“আমি বাগানে ২২ বিঘায় আম করি। ক্ষিরসাপাত আর আম্রপালি মিলে এবার ৪১৫ মণ হয়েছে। দাম কেজি ৩৫ টাকায় বিক্রি করলে সংসার চলে যায়, কিন্তু এখন মোটরখরচ বাদে হাতে থাকছে ২৫–২৬ টাকা।”

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কলেজছাত্র-চাষি সোহেল রানা

“ল্যাংড়া খেতে মজা, বিক্রি করতে মজা নেই! পাইকার ১,৫০০ টাকা মণে দিয়েছে, আমি ৩ বিঘায় ৬০ মণ তুলে ৯০ হাজার পেয়েছি। খরচ উঠেছে ৭০ হাজার। লাভ ২০ হাজার—সারা বছরের জন্য খুব বেশি না।”

বাজারের ভেতরের চিত্র

ঢাকার কারওয়ান বাজারে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ট্রাক থেকে নামছে সবুজ-এশ ও হিমসাগর। প্রচুর ফল ছাড়াও ক্রেতা চোখে পড়ে কম। একটা দোকানের সামনে লেখা, “ফ্যামিলি প্যাক—কেজি ১২০ টাকা”—যেখানে ঈদের আগে ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দোকানদার সোহাগ জানান, “মঙ্গলবার ট্রাক কম, সেদিন দাম বাড়ে; কিন্তু সাধারণত পচা-বিষের ভয়ে লোক কম কিনছে।”

একই বাজারে অনলাইন-ভিত্তিক ডেলিভারি স্টার্ট-আপ ‘ফ্রুটফ্রেশ’ স্টলের সামনে ৫–৬ জন তরুণ পলিব্যাগে আম বাছাই করছেন। কোম্পানির অপারেশন ম্যানেজার ফারিয়া সুলতানা জানালেন, “চাষি থেকে সরাসরি সংগ্রহ করি বলে গড়ে ১০–১২ টাকা বেশি দিই; আবার ঢাকায় ক্রেতাকে ১৫–২০ টাকা লাভে বিক্রি করি। মাঝখানের লজিস্টিক ঠিক থাকলে চাষি-ভোক্তা দু’পক্ষই উপকৃত।”

 

লাভ-লোকসানের হিসাবের খাতা

এলাকা গড় বিক্রিমূল্য (মণ) গড় খরচ (মণ) নেট লাভ/ক্ষতি লাভের হার
সাতক্ষীরা ১,৮০০–২,২০০ ১,০০০–১,১০০ ৭০০–১,১০০ ১৫–৩০ % লাভ
রাজশাহী ১,০০০–১,৬০০ ৯০০–১,১০০ −১০০ থেকে ৬০০ ব্রেক-ইভেন বা ৫–১০ % ক্ষতি
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ১,৫০০–১,৮০০ ১,০০০–১,১০০ ৪০০–৭০০ ৮–১২ % সামান্য লাভ

খরচে জমি-ভাড়া ধরা হয়নিমালিকানাধীন জমিতে লাভ তুলনামূলক বেশি।

প্রশাসনের উদ্যোগ ও চাষিদের প্রত্যাশা

সাতক্ষীরায় জেলা প্রশাসন ‘জাত-ভেদে আম পাড়া ক্যালেন্ডার’ কঠোরভাবে মানতে মাঠ-পর্যায়ে মনিটরিং বাড়িয়েছে। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ‘ম্যাংগো স্পেশাল’ ট্রেনকে টিকিয়ে রাখতে রেল-ভাড়া ছাড়ের দাবি জানিয়েছে চাষি-ব্যবসায়ী মঞ্চ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (রাজশাহী) গৌতম রায় জানালেন, সিটি করপোরেশনের ভোক্তা বাজারে ‘কোঅপারেটিভ বুথ’ চালু হলে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমবে। চাষিরাও চাইছেন, সরকার যেন নির্দিষ্ট উৎপাদন-খরচের ভিত্তিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করে।

সামনে কী?

  • দ্বিতীয় ধাপের ফজলিআশ্বিনা ও বারি-৪ – জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে বাজারে ঢুকবে। অতিরিক্ত সরবরাহ না হলে দাম কিছুটা বাড়তে পারে।
  • রপ্তানি – বেসরকারিভাবে ১০ হাজার টন চীনে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখনো মাত্র ২,৭০০ টন গেছে; দাম বাড়লে রপ্তানি বাড়লেও চাষির লাভ নিশ্চিত নয়।
  • প্রক্রিয়াজাত শিল্প – রাজশাহীর বহরমপুরে স্থাপিত নতুন পাল্প-ফ্যাক্টরি ৫ হাজার টন আম কিনতে পারে; এতে নষ্ট হয়ে যাওয়া ফলেরও দাম পেতে পারেন ক্ষুদ্র চাষি।
হিম সাগর আমের

ফল-মিষ্টিহাসি-ফিকে

সবুজ-হলুদ ছোপের হিমসাগর, ছাই-রঙা ক্ষিরসাপাত, বাসন্তী-ল্যাংড়া—দেখতেই যেন চোখে জল আসে। কিন্তু এ সৌন্দর্যের সাথেই জড়িয়ে আছে হিসাবের খাতা ও ব্যাংক-কিস্তির দুশ্চিন্তা। সাতক্ষীরার জলিল মিয়া বললেন, “আমের গন্ধে যেদিন বাজার ভরে, সেদিনই তো আমাদের ঘর ভরে ওঠে। কিন্তু যদি দাম না মেলে, তাহলে ওই মিষ্টি ঘ্রাণ কেমন হঠাৎই ফিকে লাগে।”

এভাবেই আমের মধুমাসে লাভ-লোকসানের টানাপোড়েনে বাঁচছে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সাতক্ষীরার শত শত পরিবার—জীবন আর স্বপ্ন সবকটিই যেন গাছের ডালে ঝুলে থাকা অপরিপক্ক ফল, কখন ধরে, কখন ঝরে—কেবল সময়ই জানে।