০২:৫৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্যে নিকেলের খোঁজে ইন্দোনেশিয়ার আমপাট দ্বীপে

ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ–পাপুয়া প্রদেশের শত শত ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত রাজা আমপাট দ্বীপপুঞ্জ—যা ‘সমুদ্রের অ্যামাজন’ নামে পরিচিত—পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সামুদ্রিক বাসস্থান। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এখানকার নিকেল খনন দ্রুত বেড়েছে; নিকেল বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি ও স্টেইনলেস স্টিল তৈরিতে প্রয়োজনীয় একটি ধাতু। পরিবেশগত সংগঠন গ্লোবাল উইটনেস ড্রোনে ধারণ করা যেসব ছবি বিবিসির সঙ্গে শেয়ার করেছে, সেগুলোতে দেখা যায়—খনন কার্যক্রম বন উজাড় ও জলদূষণ ঘটিয়ে এই সামুদ্রিক স্বর্গকে ইতোমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত করেছে।

খনির বর্তমান চিত্র

ডিসেম্বরে ক্যাওয়াই দ্বীপে তোলা ছবিতে বন সাফ করে খোলা মাটির স্তর বের করে আনা, খনিশ্রমিক ও যানবাহনের জন্য কাঁচা রাস্তা তৈরি এবং খনির ময়লা জমে থাকা জলাধার স্পষ্ট দেখা যায়। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দ্বীপপুঞ্জের একাধিক ক্ষুদ্র দ্বীপে খনিসংক্রান্ত ভূমি ব্যবহারের পরিমাণ ৫০০ হেক্টর—or প্রায় ৭০০টি ফুটবল মাঠের সমান—বেড়েছে। পাহাড়ি খনির ঢাল বেয়ে ধুয়ে আসা বাদামি পলিমাটি নীল সমুদ্রজলে মিশে প্রবালপ্রাচীরকে ঢেকে ফেলছে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি।

সরকারি পদক্ষেপ ও আশঙ্কা

এই সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার সরকার রাজা আমপাটের পাঁচটি খনন কোম্পানির মধ্যে চারটির লাইসেন্স বাতিল করেছে; পরিবেশবাদীরা সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। পরিবেশ মন্ত্রণালয় অনলাইনে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলেছে, ‘রাজার আমপাটের জীববৈচিত্র্য বিশ্ব ঐতিহ্য—এটি রক্ষা করতে হবে।’ তবু গ্রিনপিসসহ অনেক সংগঠন আশঙ্কা করছে, খনন কোম্পানিরা আইনি পথে এই সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারে। গাগ দ্বীপে নিকেল মজুত সবচেয়ে বেশি; সেখানে একটি কোম্পানিকে এখনো খনন চালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে, তবে সরকার পরিবেশ পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেবে বলে জানিয়েছে।

জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্রস্থলে বিপদ

দীর্ঘ দুই দশক ধরে রাজা আমপাট অঞ্চলে কাজ করা সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী ড. মার্ক আর্ডম্যান বলেন, ‘এখানটাই বিশ্বের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র।’ খনির লাইসেন্স বাতিলের খবরে তিনি ‘অভিভূত ও আনন্দিত’। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এখানকার সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা গড়ে তুলেছেন এবং হাঙর পুনর্বাসন প্রকল্প ‘রিশার্ক’ পরিচালনা করছেন। তাঁর মতে, ‘ইন্দোনেশিয়ান জনগণের ক্ষোভের কণ্ঠই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে।’

বৈশ্বিক চাহিদা বনাম স্থানীয় বাস্তবতা

বিশ্বের অর্ধেকের বেশি নিকেল এখন ইন্দোনেশিয়াতেই উৎপাদিত হয়। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি ও স্বল্প-কার্বন জ্বালানির প্রযুক্তি এগিয়ে নিতে ধাতুটির চাহিদা বাড়ছে, অথচ এর উত্তোলন স্থানীয় পরিবেশকে ঝুঁকিতে ফেলছে। ২০২৪ সালে ফরেস্ট ওয়াচ ইন্দোনেশিয়ার এক গবেষণায় দেখা যায়, খনিজসংশ্লিষ্ট বন উজাড়ের সঙ্গে স্থানীয় বন্যা ও ভূমিধস বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বড় দ্বীপ সুলাওয়েসির খনি-অধ্যুষিত এলাকায় করা আরেকটি গবেষণায় সামান্য দারিদ্র্য হ্রাস পেলেও পানিদূষণ ও বায়ুদূষণ উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। গবেষক ড. মাইকায়েলা লো বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া বিশ্ব নিকেলবাজারে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে, কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে ঠিক কী ঘটছে তা ভুলে যাওয়া যাবে না।’

সমুদ্রজীবন ও জীবিকা

স্থানীয় পরিবেশবাদী ইমাম শোয়াফওয়ান জানান, ‘নিকেলকে জলবায়ু সংকটের সমাধান বলা হলেও বাস্তবে এটি বন উজাড় ও কৃষিজমি ধ্বংস করছে।’ খনি-ঘেঁষা উপকূলীয় এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের ঊর্ধ্বগতির ঝুঁকিতে এমনিতেই নাজুক; খননের ক্ষতি তা আরও বাড়াচ্ছে। রাজা আমপাটের প্রবালপ্রাচীর মূল উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ হওয়ায় পর্যটন ও মৎস্যজীবী উভয়েই এই সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

জটিল দ্বিধা

ড. আর্ডম্যানের ভাষায়, ‘নিকেল নিয়ে দ্বন্দ্বটা সত্যিই কঠিন—খনি মানেই পরিবেশের ক্ষতি, অথচ বৈদ্যুতিকায়নও জরুরি। তাহলে কতটুকু ক্ষতি মেনে নেওয়া যায়?’ ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নচাহিদা ও পরিবেশ সংরক্ষণের ভারসাম্য রক্ষা করা সরকারি নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

সর্বোপরি রাজার আমপাটের নীল-সবুজ সাগর, চুনাপাথরের সুউচ্চ দ্বীপশিখর ও রঙিন প্রবালপ্রাচীর বিশ্বের প্রকৃতি–রসিকদের জন্য এক নিবিড় স্বর্গ। বৈদ্যুতিক গাড়ির টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে এই স্বর্গ কতটা সুরক্ষিত থাকবে, তা নির্ভর করবে আগামী দিনের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের ওপর—যেখানে পরিবেশ রক্ষার মৌলিক দায় ও অর্থনৈতিক লাভের আকর্ষণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।

বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্যে নিকেলের খোঁজে ইন্দোনেশিয়ার আমপাট দ্বীপে

১১:০০:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫

ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ–পাপুয়া প্রদেশের শত শত ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত রাজা আমপাট দ্বীপপুঞ্জ—যা ‘সমুদ্রের অ্যামাজন’ নামে পরিচিত—পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সামুদ্রিক বাসস্থান। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এখানকার নিকেল খনন দ্রুত বেড়েছে; নিকেল বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি ও স্টেইনলেস স্টিল তৈরিতে প্রয়োজনীয় একটি ধাতু। পরিবেশগত সংগঠন গ্লোবাল উইটনেস ড্রোনে ধারণ করা যেসব ছবি বিবিসির সঙ্গে শেয়ার করেছে, সেগুলোতে দেখা যায়—খনন কার্যক্রম বন উজাড় ও জলদূষণ ঘটিয়ে এই সামুদ্রিক স্বর্গকে ইতোমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত করেছে।

খনির বর্তমান চিত্র

ডিসেম্বরে ক্যাওয়াই দ্বীপে তোলা ছবিতে বন সাফ করে খোলা মাটির স্তর বের করে আনা, খনিশ্রমিক ও যানবাহনের জন্য কাঁচা রাস্তা তৈরি এবং খনির ময়লা জমে থাকা জলাধার স্পষ্ট দেখা যায়। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দ্বীপপুঞ্জের একাধিক ক্ষুদ্র দ্বীপে খনিসংক্রান্ত ভূমি ব্যবহারের পরিমাণ ৫০০ হেক্টর—or প্রায় ৭০০টি ফুটবল মাঠের সমান—বেড়েছে। পাহাড়ি খনির ঢাল বেয়ে ধুয়ে আসা বাদামি পলিমাটি নীল সমুদ্রজলে মিশে প্রবালপ্রাচীরকে ঢেকে ফেলছে, যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় হুমকি।

সরকারি পদক্ষেপ ও আশঙ্কা

এই সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার সরকার রাজা আমপাটের পাঁচটি খনন কোম্পানির মধ্যে চারটির লাইসেন্স বাতিল করেছে; পরিবেশবাদীরা সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। পরিবেশ মন্ত্রণালয় অনলাইনে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলেছে, ‘রাজার আমপাটের জীববৈচিত্র্য বিশ্ব ঐতিহ্য—এটি রক্ষা করতে হবে।’ তবু গ্রিনপিসসহ অনেক সংগঠন আশঙ্কা করছে, খনন কোম্পানিরা আইনি পথে এই সিদ্ধান্ত উল্টে দিতে পারে। গাগ দ্বীপে নিকেল মজুত সবচেয়ে বেশি; সেখানে একটি কোম্পানিকে এখনো খনন চালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে, তবে সরকার পরিবেশ পুনরুদ্ধারের নির্দেশ দেবে বলে জানিয়েছে।

জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্রস্থলে বিপদ

দীর্ঘ দুই দশক ধরে রাজা আমপাট অঞ্চলে কাজ করা সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী ড. মার্ক আর্ডম্যান বলেন, ‘এখানটাই বিশ্বের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র।’ খনির লাইসেন্স বাতিলের খবরে তিনি ‘অভিভূত ও আনন্দিত’। তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এখানকার সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা গড়ে তুলেছেন এবং হাঙর পুনর্বাসন প্রকল্প ‘রিশার্ক’ পরিচালনা করছেন। তাঁর মতে, ‘ইন্দোনেশিয়ান জনগণের ক্ষোভের কণ্ঠই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে।’

বৈশ্বিক চাহিদা বনাম স্থানীয় বাস্তবতা

বিশ্বের অর্ধেকের বেশি নিকেল এখন ইন্দোনেশিয়াতেই উৎপাদিত হয়। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি ও স্বল্প-কার্বন জ্বালানির প্রযুক্তি এগিয়ে নিতে ধাতুটির চাহিদা বাড়ছে, অথচ এর উত্তোলন স্থানীয় পরিবেশকে ঝুঁকিতে ফেলছে। ২০২৪ সালে ফরেস্ট ওয়াচ ইন্দোনেশিয়ার এক গবেষণায় দেখা যায়, খনিজসংশ্লিষ্ট বন উজাড়ের সঙ্গে স্থানীয় বন্যা ও ভূমিধস বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বড় দ্বীপ সুলাওয়েসির খনি-অধ্যুষিত এলাকায় করা আরেকটি গবেষণায় সামান্য দারিদ্র্য হ্রাস পেলেও পানিদূষণ ও বায়ুদূষণ উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে। গবেষক ড. মাইকায়েলা লো বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া বিশ্ব নিকেলবাজারে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে, কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে ঠিক কী ঘটছে তা ভুলে যাওয়া যাবে না।’

সমুদ্রজীবন ও জীবিকা

স্থানীয় পরিবেশবাদী ইমাম শোয়াফওয়ান জানান, ‘নিকেলকে জলবায়ু সংকটের সমাধান বলা হলেও বাস্তবে এটি বন উজাড় ও কৃষিজমি ধ্বংস করছে।’ খনি-ঘেঁষা উপকূলীয় এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের ঊর্ধ্বগতির ঝুঁকিতে এমনিতেই নাজুক; খননের ক্ষতি তা আরও বাড়াচ্ছে। রাজা আমপাটের প্রবালপ্রাচীর মূল উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ হওয়ায় পর্যটন ও মৎস্যজীবী উভয়েই এই সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

জটিল দ্বিধা

ড. আর্ডম্যানের ভাষায়, ‘নিকেল নিয়ে দ্বন্দ্বটা সত্যিই কঠিন—খনি মানেই পরিবেশের ক্ষতি, অথচ বৈদ্যুতিকায়নও জরুরি। তাহলে কতটুকু ক্ষতি মেনে নেওয়া যায়?’ ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নচাহিদা ও পরিবেশ সংরক্ষণের ভারসাম্য রক্ষা করা সরকারি নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।

সর্বোপরি রাজার আমপাটের নীল-সবুজ সাগর, চুনাপাথরের সুউচ্চ দ্বীপশিখর ও রঙিন প্রবালপ্রাচীর বিশ্বের প্রকৃতি–রসিকদের জন্য এক নিবিড় স্বর্গ। বৈদ্যুতিক গাড়ির টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে এই স্বর্গ কতটা সুরক্ষিত থাকবে, তা নির্ভর করবে আগামী দিনের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের ওপর—যেখানে পরিবেশ রক্ষার মৌলিক দায় ও অর্থনৈতিক লাভের আকর্ষণ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।