বসন্তপুর, সাতক্ষীরার উপকূল-লাগোয়া গ্রাম। মাছ ধরার মৌসুম ভেসে গেলেও জলবায়ু-ঝড়ের ক্ষত মুছতে পারেনি শিলার পরিবার। ঘরটা ভেসে গেছে ঘূর্ণিঝড় ইনানিতে; বাবার জাল-নৌকা—সব কিছুই নষ্ট। বছর পাঁচেক আগে পঞ্চম শ্রেণিতে যে মেয়েটি ছিল ক্লাসের সেরা, সেই শিলার বয়স এবার মাত্র ১৫। অকাল মূলধন জোটাতে না পেরে বাবা-মা সম্প্রতি তাকে ‘ভালো বাড়ি’ খুঁজে পেয়েছেন—পাত্রের বয়স ২৩, পেশায় অটোচালক। শিলার অনিচ্ছা বড়জোর টিন-পাতার দেয়ালে নরমভাবে গিয়ে লেগেছে; আর্থিক নিরাপত্তার খাতিরে পরিবার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে, এ নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষমতা তার নেই।
শিলার গল্পটা একমাত্র নয়—বাংলাদেশে আজ এই গল্পই নিয়ম। সাম্প্রতিক সরকারি জরিপে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়েছে ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ মেয়ের; ২০২২-এ ছিল ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০২০-এ ৩১ শতাংশের একটু বেশি। আর জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) পরিচালিত বিডিএইচএস-২০২২ জানায়, এই হার ৫১ শতাংশেরও ওপরে। অর্থাৎ উন্নয়নের গল্পের আড়ালে প্রতি দুই কিশোরীর একজন এখনো বাল্যবধূ—আর হারটা আবার ঊর্ধ্বমুখী।
কেন বাড়ছে বাল্যবিবাহ?
ক্লাইমেট শক ও দুর্যোগ-পুঁজি
দুবলারচর থেকে কুয়াকাটা—উপকূলজুড়ে ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা আর নদীভাঙনে ঘরহারা পরিবারগুলো মেয়েদের ‘একটা মুখ কমাতে’ তড়িঘড়ি বিয়ে দেন। ইউনিসেফের ২০২২-এর এক ব্রিফ স্পষ্ট করে, জলবায়ু-ঝুঁকি বাল্যবিবাহকে সহিংসতার রূপে ত্বরান্বিত করছে।
কোভিড-পোস্ট শূন্যতা ও শিক্ষাবিরতি
৫৪৩ দিনের স্কুল-বন্ধের পর কিশোরীদের বড় অংশ ক্লাসে আর ফেরেনি; পড়াশোনা ভেঙে পড়লেই ‘বিয়ে-উপযুক্ত’ তকমা লাগছে। ২০২১ সালের এক গবেষণাপত্র দেখায়, মহামারির ধাক্কায় নতুন করে ১০ মিলিয়ন মেয়ে বিশ্বজুড়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে, যার উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশে।
আইনের ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ ফাঁকফোকর
২০১৭ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ১৯ ধারা বাবা-মা ও আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ কমবয়সী বিয়ে বৈধ করে। কিন্তু কী সেই পরিস্থিতি—সংজ্ঞা অস্পষ্ট; মানবাধিকারবিদরা একে ‘ছিদ্রপথ’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
পণ-নিয়ন্ত্রিত বাজার ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা
আর্থিক অনিশ্চয়তার সময় বিয়ে মানে ভবিষ্যৎ ভাতা; ‘ভালো পাত্র-কম পণ’ পাওয়া মানেই চটজলদি সিদ্ধান্ত। সামাজিক মানসিকতায় কন্যা যেন বোঝা—এই ধারণাও প্রবল।
জনসংখ্যার চাপে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ঝুঁকিতে
শিশু-বধূরা গড়ে আরও বেশি সন্তান জন্ম দেন—বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাল্যবিবাহ বন্ধ হলে শুধু কম-জন্মহারের মাধ্যমে ২০৩০-এর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে। বাংলাদেশে যেখানে ইতিমধ্যেই প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১,২৬৫ জনের বেশি মানুষ, সেখানে অনিয়ন্ত্রিত উর্বরতা চিন্তা বাড়ায়: ঘনবসতির ওপর নতুন চাপ, ভূমি-সংকট, আবাসন-সংকট ও নগর পরিকাঠামোর অতিরিক্ত ব্যয়।
বিশ্বব্যাংকের জনসংখ্যা-ফার্টিলিটি ব্রিফ দেখায়, অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়েদের সন্তানসংখ্যা দেরিতে বিয়ে-করা মায়েদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি—এতে মাথাপিছু আয় কমে এবং দারিদ্র্য পুনরুত্পাদন হয়। অর্থাৎ বাল্যবিবাহ ও দ্রুত জনবৃদ্ধি একে অপরকে উসকে দেয়।
অর্থনীতিতে লুকানো ক্ষতি
শিক্ষার অভাবে কর্মশক্তিতে ঘাটতি
কিশোরী পড়াশোনা ছেড়ে দিলে ভবিষ্যৎ দক্ষ শ্রমশক্তি ক্ষয় হয়। বিশ্বব্যাংকের এক গ্লোবাল ব্রিফে হিসাব—শিক্ষা অব্যাহত রাখতে পারলে এবং বাল্যবিবাহ বন্ধ হলে বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার সমমানের উৎপাদনশীলতা বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য-ব্যয়ের পাহাড়
কিশোরী মাতৃত্বে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি দ্বিগুণ, অপুষ্টির হারও বেড়ে যায়; শুধু অল্পবয়সে মাতৃত্ব ঠেকাতে পারলেই সরকার স্বাস্থ্যখাতের ব্যয়ের প্রায় ৫ শতাংশ সাশ্রয় করতে পারে।
দারিদ্র্যের প্রজন্মান্তর জাল
কম আয়, বেশি বোঝা—শিশু-বধূ পরিবারের মাথাপিছু ভোগব্যয় কমে, খাদ্য ও শিক্ষায় বাজেট সংকুচিত হয়; ফলে দারিদ্র্য কয়েক প্রজন্মে গেঁথে যায়।
সমাজ-স্বাস্থ্য ও মানসিক অভিঘাত
বাংলাদেশ স্যাম্পল ভিটাল স্ট্যাটিসটিক্স-২০২৩-এ দেখা যায়, ১৫-১৯ বছর বয়সি মেয়েদের প্রতি হাজারে ৭৩ জনই মা হচ্ছেন; গত বছর সংখ্যাটা ছিল ৭০। অপ্রস্তুত দেহ-মন নিয়ে এই মাতৃত্বে মাতৃমৃত্যুর হার দ্বিগুণ, নবজাতকের ঝুঁকিও মারাত্মক। ডাক্তারদের ভাষায়, ১৬-র আগেই দ্বিতীয় সন্তানের গর্ভধারণ অস্বাভাবিক নয়—কিন্তু তখনও দেহ বেড়ে ওঠার পথে।
বয়সভিত্তিক ক্ষমতার অসমতা গৃহ-নিপীড়নের ঝুঁকিও বাড়ায়। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি, ডিপ্রেশন, আত্মহত্যার প্রবণতা—সবই গবেষণায় প্রমাণিত। এর ঢেউ ফিরে আসে আইন-শৃঙ্খলা ব্যয় ও স্বাস্থ্যসেবায় অতিরিক্ত চাপ হিসেবে।
‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ না ‘ডেমোগ্রাফিক ডেজাস্টার’?
জাতীয় লক্ষ্য—২০৪১-এর মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ। সে পথে সবচেয়ে অস্পষ্ট স্লোডাউন হলো বাড়তে থাকা বাল্যবিবাহ। কিশোর-কিশোরী শ্রমশক্তির সর্বাধিক সুরাহা করার বদলে আমরা তাদের ক্ষমতাহীন করছি; এতে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জানালায় তালা ঝুলে যেতে পারে।
কী করা জরুরি
- ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন ও বিয়ে-নিবন্ধন সমন্বিত ভেরিফিকেশন—কাজির টেবিলে জাতীয় তথ্যভান্ডারের রিয়েল-টাইম ক্রস-চেক বাধ্যতামূলক করতে হবে।
• দুর্যোগ-ঝুঁকি এলাকায় ‘জিরো-ড্রপআউট’ প্রণোদনা ও শিক্ষা-ভাতা—বাঁচাতে হবে শিলাদের স্কুল।
• আইন প্রয়োগে জিরো-টলারেন্স—‘বিশেষ পরিস্থিতি’ ধারা ব্যবহার হলে আদালতকে প্রতিটি মামলার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে ব্যাখ্যা দিতে হবে।
• কিশোরী-কেন্দ্রিক স্কিল-ডেভেলপমেন্ট ও কর্মসংস্থান—সেলাই, আইটি এবং নবায়নযোগ্য-শক্তি উদ্যোগে ভর্তুকি দিয়ে বিকল্প আয়ের পথ খুলতে হবে।
• সামাজিক প্রচার ও পুরুষ-অংশগ্রহণ—‘মেয়ে বোঝা নয়’ বার্তাকে জনপ্রিয় করতে সাংস্কৃতিক মাধ্যম, খেলোয়াড়, ইউটিউবারসহ সবার অংশগ্রহণ জরুরি।
শিলার মতো লাখো কিশোরীকে শিশুবধূ না বানিয়ে যদি তাদের স্কুল, মাঠ ও কর্মক্ষেত্রে রাখা যায়, তবে জনসংখ্যা-চাপ সহনীয় হবে, অর্থনীতি পাবে দক্ষ শ্রমশক্তি, সমাজ পাবে সুস্থ মা ও শিক্ষিত নাগরিক। অন্যথায় বাল্যবিবাহ এমন এক অদৃশ্য সুনামি, যা আমাদের ঘরগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে উন্নয়ন-স্বপ্নের ওপরে। জরুরি সিদ্ধান্ত আমাদের হাতেই; আজই পদক্ষেপ না নিলে আগামী দশকে বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের বদলে ডেমোগ্রাফিক ডেজাস্টার দেখা দেওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার।