বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে থাকা অণুজীবদের গোপন জগৎ
ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও এককোষী জীব পৃথিবীর চারপাশে বায়ুমণ্ডলের উচ্চ স্তরে ঘুরে বেড়ায়। এক সময় এদের অস্তিত্ব অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আজ বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে এই অণুজীবেরা কেবল পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অংশ নয়, বরং আবহাওয়া ও জনস্বাস্থ্যের উপরও গভীর প্রভাব ফেলে।
আকাশের মেঘ, যেগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের চেনা দৃশ্য, আসলে হাজারো প্রজাতির অণুজীবের অস্থায়ী আবাস। এরা আকাশে পৌঁছায় পাখি, পতঙ্গ, বীজ কিংবা ধূলিকণার সঙ্গে; আবার কখনো স্বতন্ত্রভাবে বাতাসে উঠে যায়।
১৮৬০ সালে লুই পাস্তুর প্রথম বায়ুজীবের ধারণা দেন। তিনি প্যারিস থেকে আল্পসের হিমবাহ পর্যন্ত জীবাণু সংগ্রহ করেন, যদিও অনেক সমসাময়িক বিজ্ঞানী তা বিশ্বাস করতে পারেননি। ১৯৩০ এর দশকে বিমান ও বেলুন ব্যবহার করে আকাশ থেকে অণুজীব সংগ্রহ শুরু হয়। বর্তমানে, আধুনিক ড্রোন ও ডিএনএ বিশ্লেষণ প্রযুক্তির মাধ্যমে এই গবেষণা আরও উন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কীভাবে অণুজীব উঠে আসে আকাশে
সমুদ্রের ঢেউ ভাঙলে ফোঁটা ফোঁটা জলে থাকা অণুজীব বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ভূমিতে বাতাস ধুলা ও মাটি থেকে অণুজীব টেনে নেয়, আবার বন আগুনে তৈরি হওয়া তীব্র বাতাস গাছের পাতা ও মাটি থেকে জীব তুলে আকাশে নিয়ে যায়।
কিছু জীব, যেমন ছত্রাক, শৈবাল, ফুলের পরাগ ও মস জাতীয় উদ্ভিদ, প্রাকৃতিকভাবে নিজস্ব কৌশলে আকাশে ওঠে। এদের অনেকে ফোঁটা ফোঁটা স্পোর বা পরাগ তৈরি করে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। ছত্রাকের কিছু স্পোর এমনকি স্তরবায়ুমণ্ডল পর্যন্ত উঠতে পারে।
আকাশে তাদের বিস্তার
প্রতিবছর সমুদ্র ও ভূমি থেকে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক বাতাসে ওঠে। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর প্রায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া আর ৫ কোটি টনের বেশি ছত্রাকের স্পোর আকাশে ভেসে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই হাজার কিলোমিটার দূরত্বও অতিক্রম করতে সক্ষম।
যখন কোনো অণুজীব জলকণার সঙ্গে মিশে যায়, তখন সে মেঘের মধ্যে প্রবেশ করে। ফ্রান্সের পুই দ্য দোম পাহাড়ে একটি গবেষণাগারে গত ২০ বছর ধরে এই ধরনের মেঘজল পরীক্ষা করা হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি মিলিমিটার মেঘজলে গড়ে ১ লাখের মতো অণুজীব থাকে—যাদের মধ্যে অনেকগুলোরই আগে কোনো নাম ছিল না।
মেঘে অণুজীবের জীবনচক্র ও প্রভাব
মেঘে বাস করার পরিবেশ কঠিন—সেখানে পুষ্টির অভাব এবং প্রতিটি ব্যাকটেরিয়া থাকে একা একা। তবুও গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাকটেরিয়ারা সেখানে সক্রিয় থাকে, খাদ্য ভাঙে এবং সংখ্যা বাড়ায়। কিছু প্রজাতি যেমন মিথাইলোব্যাকটেরিয়াম সূর্যের আলো ব্যবহার করে মেঘের জৈব কার্বন ভেঙে ফেলে, যা পৃথিবীর বায়ুর গঠনকেও প্রভাবিত করতে পারে। বছরে প্রায় ১০ লাখ টন জৈব কার্বন তারা ভেঙে ফেলে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মেঘের জলকণায় বরফ গঠনের জন্য ‘বীজ’ প্রয়োজন, আর অণুজীবেরা সেই ভূমিকা পালন করতে পারে। ছত্রাক, শৈবাল, পরাগ, লাইকেন ও ব্যাকটেরিয়া—সবই বরফের বীজ হিসেবে কাজ করে। উদ্ভিদের পাতা ভিজে ঠান্ডায় গেলে পসুডোমোনাস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া সেখানে বরফ জমিয়ে কোষ ফাটায় ও পুষ্টি গ্রহণ করে। গবেষকেরা মনে করেন, উদ্ভিদ-পসুডোমোনাস-মেঘ-বৃষ্টি—এই প্রাকৃতিক চক্রটি অরণ্য ও বায়ুমণ্ডলের মধ্যে একধরনের সহাবস্থানের সম্পর্ক তৈরি করতে পারে।
মানব প্রভাব, রোগ বিস্তার এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা
মেঘে ভেসে থাকা জীবগুলোর মধ্যে অনেকেই মানুষের কর্মকাণ্ডের চিহ্ন বহন করে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, মেঘে থাকা অণুজীবের ডিএনএ-তে বিপুলসংখ্যক অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জিন আছে। এগুলো মানুষের ও পশুর চিকিৎসায় অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফল।
২০১৪ সালে বিশ্বজুড়ে ৭ লাখ এবং ২০১৯ সালে ১২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ এই ধরনের সংক্রমণে মারা যান। প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া মাটি ও পানির মাধ্যমে বাতাসে উঠে মেঘে ছড়িয়ে পড়ে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ঘনমিটার মেঘজলে ১০ হাজার পর্যন্ত প্রতিরোধী জিন থাকতে পারে। এমনকি একটি মেঘে ট্রিলিয়নের বেশি এই ধরনের জিন থাকতে পারে। প্রতিবছর ২.২ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন জিন পৃথিবীতে বৃষ্টির মাধ্যমে ফিরে আসে।
এই বাস্তবতা কেবল পৃথিবীর জন্য নয়, মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। শুক্র গ্রহের মেঘস্তরে অপেক্ষাকৃত শীতল পরিবেশে অণুজীবের সম্ভাব্য বাসস্থানের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন এমআইটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী সারা সিগার।
আমরা যখন বৃষ্টিভেজা পথে হাঁটি, তখন যেন আর শুধু আবহাওয়ার কথা মনে না পড়ে। বরং এটি হয়ে দাঁড়ায় এক জটিল জীবজগতের অংশ—যেখানে অণুজীবেরা আকাশে ভেসে বেড়ায়, পৃথিবীর রসায়ন বদলায়, এবং আমরা নিজেরাই তার এক অনিচ্ছাকৃত কারিগর।
লেখক: কার্ল জিমারের নতুন বই ‘Airborne: The Hidden History of the Life We Breathe’ এখন বাজারে।