বেইজিংয়ের দূতাবাস অঞ্চলে উইলো গাছে ঘেরা একটি খালের কাছাকাছি অবস্থিত ‘সান-ই ব্যাঙ্কুয়েট’ নামের একটি নতুন রেস্তোরাঁর অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয় শুধুমাত্র একটি সূক্ষ্ম কুঁচকানো অক্ষরে লেখা জাপানি স্টাইলের সাইনবোর্ড এবং একটি নিখুঁতভাবে নির্মিত ব্রোঞ্জের দরজা।
এই রেস্তোরাঁটি এক কোণ ঘুরলেই চোখে পড়ে উজ্জ্বল নিওন আলোয় ভরা একটি বাইস্ট্রো, যা হয়তো আশপাশের বিদেশিদের আকর্ষণের উদ্দেশ্যে বানানো। কিন্তু এখন সেই পশ্চিমা ক্রেতাদের উপস্থিতি অনেকটাই কমে গেছে। যারা আগে সেখানে এসে ‘অঁত্রেকোত’ স্টেক আর রেড ওয়াইন চাইতেন, তারা অনেকেই এখন আর নেই। তাদের এই অনুপস্থিতি হলো চীন এবং কিছু পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমবিচ্ছিন্ন সম্পর্কের একটি দৃশ্যমান প্রতিফলন।
ফলে এখন অভিজাত খাওয়ার চাহিদা মূলত চীনা ক্রেতাদের দিক থেকেই আসতে হবে, বিদেশিদের থেকে নয়। কিছুদিন আগেও সান-ই রেস্তোরাঁর মালিক ছিলেন এক উদ্যোক্তা, যিনি পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাটারি ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করছিলেন এবং “৯-৯-৬” জীবনধারা (সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা, সপ্তাহে ছয় দিন কাজ) অনুসরণ করছিলেন—চীনের কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অবশেষে তিনি সেই জীবনধারা ছেড়ে দিয়েছেন এবং এখন আরও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করছেন। তিনি ব্যতিক্রম নন। বেইজিংয়ে এমন অনেক মানুষই আছেন, যারা আজ এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
চীনা জনগণের মতো অন্য কোনো জাতি গত কয়েক দশকে নিজেদের ও দেশের সমৃদ্ধির জন্য এতটা পরিশ্রম করেনি। এখন তারা নিজেদের শ্রমের ফল উপভোগ করতে চান, এবং এই নতুন রেস্তোরাঁর মালিকের মতোই, তারা আরও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন।
কিন্তু বেইজিংয়ের বার্তা ভিন্ন।
সরকারের উচিত ছিল জনগণকে উৎসাহ দেওয়া—বিদেশি বাজার থেকে আসা চাহিদার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তারা যেন তাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় খরচ করেন, যেন তারা হাঙরের পাখনা কিংবা অ্যাবালোন উপভোগ করেন, যেমনটা পার্টির অভিজাতরা সবসময় করে আসছেন। কিন্তু তার পরিবর্তে, বেইজিংয়ের বাসিন্দাদের বলা হচ্ছে, এই উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে—ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন এবং ট্রাম্পের বিচ্ছিন্নকরণ প্রচেষ্টার মধ্যে—তাদের “তিতিক্ষা” শিখতে হবে, কষ্ট সহ্য করতে হবে এবং ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
এই ধারণাটি, যে জীবন শুধু কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়, তা আংশিকভাবে কোভিডের মানসিক ক্ষতের প্রতিফলন—বিশেষ করে সাংহাইয়ে, যেখানে মাসের পর মাস চলা লকডাউন ছিল বিশেষভাবে কঠোর। যেহেতু শুধুমাত্র চীনে অনুমোদিত টিকা ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানের, এবং এক সন্তান নীতির কারণে পরিবারগুলো ছোট ছিল, তাই হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে অনেক পরিবার যখন প্রিয়জন হারায়, তখন তারা তাদের সরকারের প্রতি আস্থার বড় অংশ হারিয়ে ফেলে—যদিও সরকার অন্তত তাদের নিরাপদ রাখবে, এমন প্রত্যাশা ছিল।
যাই হোক, যখন গ্রাহকদের সান-ই’র উপরের তলায় খালদৃশ্যযুক্ত ব্যক্তিগত কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়, সন্ধ্যার অন্ধকারে উইলো গাছে আলোর খেলা দেখা যায়, তখন তারা একটি কক্ষে পেরিয়ে যান, যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত মাও-টাইয়ের বোতল সারি সারি সাজানো। মাও-টাই হলো এক প্রকার তীব্র, পাতিত অ্যালকোহল। কিছুদিন আগেও যারা সরকারি সুবিধা পেতে চেয়েছেন—ভূমি বরাদ্দ, সহজ শর্তে ঋণ, রপ্তানি লাইসেন্স, লাভজনক ব্যবসার অর্ডার কিংবা বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি—তারা মাও-টাইকেই বেছে নিয়েছেন। অন্যভাবে বললে, ব্যবসা ও প্রশাসনের অশুচি সম্পর্কের জ্বালানী হিসেবে মাও-টাই হয়ে উঠেছিল এক ধরনের প্রতীক, দুর্নীতির শর্টকাট।
সম্প্রতি, বেইজিংয়ের নির্দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে তাদের মাও-টাই সরবরাহের রেকর্ড রাখতে এবং তা সংরক্ষণাগারে তালাবদ্ধ করে রাখতে বলা হয়েছে। বিলাসবহুল হোটেলের বড় ভোজসভাগুলোতে, যেখানে কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন, আগের মতো গ্লাসে গ্লাসে টোস্টের দৃশ্য আর দেখা যায় না। এখন ‘মিতব্যয়িতা’ হলো দলের কর্মীদের জন্য একটি নতুন স্লোগান। কিন্তু এই আহ্বান সাধারণ মানুষের কাছে আর কোনো আবেদন রাখে না।
সরকার চায়, জনগণ যেন ভালো কমিউনিস্ট হয়—তারা যেন আরও কঠোর পরিশ্রম করে আরও বেশি পণ্য উৎপাদন করে। কখনও কখনও মনে হয়, সীমাহীন সরবরাহ যেন নিজের মধ্যে এক উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে—তা আর জনগণের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যম নয়। মূল ভূখণ্ড চীনে এখন ভোগমাত্রা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ৪০ শতাংশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ৭০ শতাংশ—কারও দৃষ্টিতে এটি সঠিক, কারও দৃষ্টিতে নয়।
এই সময়টি হওয়া উচিত, যখন বেইজিং তার জনগণকে তাদের পরিশ্রমের উপযুক্ত পুরস্কার দেয়—তাদের যা প্রয়োজন মনে করে তা নয়, বরং যা তারা চায় তা দেয়। এর মধ্যে থাকা উচিত আরও শক্তিশালী পেনশন এবং উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা। এই ধরনের সংস্কার পরিবারগুলোকে সঞ্চয়ের প্রবণতা কমিয়ে খরচ বাড়াতে সহায়তা করবে—একটি সময় যখন চীনের সমস্যা হলো মুদ্রাস্ফীতি নয়, বরং ডিফ্লেশন, এবং জনসংখ্যা হ্রাসের কারণে এই সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। কিন্তু বরং দেখা যাচ্ছে, বেইজিং এখন বেতন কমাচ্ছে, ব্যাংকে আমানতের সুদ কমাচ্ছে—একটি সময় যখন জনগণ বিশেষভাবে ঝুঁকিবিমুখ হয়ে উঠেছে, কারণ তারা শেয়ারবাজার এবং রিয়েল এস্টেট উভয়ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবুও, পরিস্থিতি জটিল। ভূরাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়ছে, এবং চাপ বাড়ছে সরকার এবং সাধারণ মানুষের উপর। তবে একই সঙ্গে, অনেক চীনা জনগণ তাদের সরকারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তারা আর আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের ভাষায় ‘চাষা’ নয়—তারা বহু আগেই সেই পরিচয় ছাড়িয়ে গেছেন।
অর্থাৎ, এখন সময় এসেছে—চীনের নিজের সরকার যেন নিজের জনগণকে কৃষক নয়, বরং সম্মানিত নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে।
(লেখক হেনি সেন্ডার ‘অপসরা অ্যাডভাইজরি’র প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা অংশীদার, যা একটি আর্থিক পরিষেবা বিষয়ক কৌশলগত পরামর্শদাতা সংস্থা। এর আগে তিনি ব্ল্যাকরক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।)