১৯৭৬ সালে, প্রত্নতত্ত্ববিদেরা আধুনিক সিরিয়ার তেরকা নামক প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষে খনন চালানোর সময় এক অভাবনীয় আবিষ্কার করেন। একটি পুড়ে যাওয়া সাধারণ রান্নাঘরের ভেতর তাঁরা খুঁজে পান একটি ছোট সিরামিকের পাত্র। আর সেই পাত্রেই ছিল কিছু লবঙ্গ কুঁড়ি—যার বয়স ৩,৭০০ বছরের বেশি, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৭২০ সালের।
এটাই এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত লবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন পদার্থগত প্রমাণ। আর এই আবিষ্কার থেকে উঠে আসে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই মসলা এত বছর আগে সিরিয়ার একটি সাধারণ রান্নাঘরে কীভাবে পৌঁছাল?
লবঙ্গ: দ্বীপের জঙ্গল থেকে প্রাচীন বাণিজ্যপথে
লবঙ্গ আসে Syzygium aromaticum গাছের শুকনো ফুলের কুঁড়ি থেকে, যার জন্মস্থল ইন্দোনেশিয়ার মালুকু দ্বীপপুঞ্জ—যেটি ‘স্পাইস আইল্যান্ডস’ নামেও পরিচিত। ৩,৭০০ বছর আগে, যখন সিরিয়ায় এই লবঙ্গ পাওয়া যায়, তখন পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে লবঙ্গ পাওয়া যেত, তা ছিল এই দ্বীপপুঞ্জ।
এর মানে, ওই কুঁড়িগুলোকে প্রায় ৭,০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হয়েছিল, সম্ভবত প্রাচীন ভারত মহাসাগরীয় সামুদ্রিক বাণিজ্যপথ ধরে। এই বাণিজ্যরুট রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্য এবং সিল্ক রোডের আগের যুগের। ফলে এটি প্রমাণ করে, বিশ্বব্যাপী মসলার বিনিময় ভাবনার শুরু আরও অনেক আগেই হয়েছিল। প্রাচীন বাণিজ্যসংক্রান্ত গবেষণায় বলা হয়েছে, এমন বিনিময় সম্ভব হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার উপকূলবর্তী ব্যবসায়ীদের এবং অস্ট্রোনেশীয় নাবিকদের মাধ্যমে।
প্রাচীন মূল্য, আধুনিক ব্যবহার
লবঙ্গ চাষের জন্য নির্দিষ্ট পরিবেশ দরকার: গ্রীষ্মমণ্ডলীয় তাপ, উচ্চ আর্দ্রতা এবং সাগরপারের বাতাস। মালুকু দ্বীপপুঞ্জে এই পরিবেশ সহজেই পাওয়া যেত। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লবঙ্গ উৎপাদন হয় তানজানিয়ায়, বিশেষত জানজিবার দ্বীপে, যা এখন বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ লবঙ্গ সরবরাহ করে।
লবঙ্গ এখনো হাতে চাষ করা হয়। শ্রমিকেরা গাছে উঠে ডালের কুঁড়িগুলো তুলে নিয়ে রোদে শুকিয়ে নেন যতক্ষণ না সেগুলো কালচে ও শক্ত হয়ে যায়। “Clove” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ clavus থেকে, যার অর্থ পেরেক—এর আকারের জন্যই এই নামকরণ।
ইতিহাসে লবঙ্গের ব্যবহার ছিল বহু প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে চীনের রাজদরবারে এটি মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগের ইউরোপে এটি সোনা দামের সমান ছিল—পারফিউম, খাবার, এবং ওষুধ তৈরিতে এর চাহিদা ছিল ব্যাপক। আজও লবঙ্গ ব্যবহৃত হয় দাঁতের ব্যথা কমাতে, মসলা মিশ্রণে, এমনকি মিষ্টিজাত দ্রব্যে।
প্রাচীন বাণিজ্য থেকে আজকের মাসালাদানিতে
সিরিয়ার তেরকায় পাওয়া লবঙ্গের এই আবিষ্কার শুধু প্রাচীনতার জন্য নয়, বরং এর তাৎপর্যের জন্য তা অবিস্মরণীয়। কারণ এটি এমন এক সময়কে নির্দেশ করে, যখন বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য কেবল সাম্রাজ্য ও ধনী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তেরকার একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের রান্নাঘরে পাওয়া সেই ছোট পাত্রটি প্রমাণ করে, বিশ্বায়নের ছোঁয়া আমাদের রান্নাঘরে পৌঁছে গিয়েছিল বহু শতাব্দী আগেই।
আজকের দিনে লবঙ্গ আমাদের রান্নাঘরের এক অপরিহার্য উপাদান। বিরিয়ানি থেকে শুরু করে মাসালা চা, আচার কিংবা মিষ্টিজাত খাবারে—লবঙ্গ ব্যবহার হয় হরহামেশা। এই ছোট মসলা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সময় আর দূরত্ব পেরিয়ে, তার কত দীর্ঘ এক যাত্রা!