বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে সাম্প্রতিক কিছু স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও গত দশ মাসে শিল্পখাতে উল্লেখযোগ্য কোনো বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) আসেনি। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি রাজনৈতিক রদবদলের পর থেকে একটি অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। সরকার পরিবর্তনের ফলে নীতিগত অনিশ্চয়তা এবং ইউটিলিটি খাতের অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনাই এ বিনিয়োগ স্থবিরতার প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিনিয়োগ স্থবিরতা
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা ত্যাগের পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এই রূপান্তরের সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা বেড়েছে। বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদি নীতির নিশ্চয়তা না পেলে বড় আকারের শিল্প স্থাপনে আগ্রহী হন না।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত নতুন কোনো বড় শিল্পখাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ অনুমোদিত হয়নি। যদিও প্রাথমিকভাবে ইউরোপ, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক কয়েকটি কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছিল, তবে রাজনৈতিক এবং ইউটিলিটি ঝুঁকির কারণে তারা সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতির হাল
বিদ্যুৎ খাতে বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন প্রায় ১৫,০০০ মেগাওয়াট, যা সর্বোচ্চ সক্ষমতার তুলনায় (২৮,০০০ মেগাওয়াট) অনেক কম হলেও লোডশেডিং (বিদ্যুৎ বিভ্রাট) আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ ও ইউটিলিটি সংশ্লিষ্ট সচিব (ভারপ্রাপ্ত) ফাওজুল কবির খান এক বিবৃতিতে জানান, “শিল্পাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে স্থানভেদে পৃথক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
গ্যাস খাতে বর্তমানে দেশীয় উৎপাদন ২,২০০ মিলিয়ন ঘনফুট দৈনিক, যেখানে চাহিদা ৩,৫০০ মিলিয়নের বেশি। ঘাটতি পূরণে সরকার এলএনজি আমদানিতে নতুন কৌশল নিয়েছে। গত ডিসেম্বর থেকে শেল, BP, আরামকো ও গ্লেনকোর মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রে অংশ নিয়ে গ্যাস সরবরাহ করছে, যা বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা এনেছে এবং দাম কমেছে।
ঋণ এবং দায় সংকট
ভারতের আদানী গ্রুপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তির বিল পরিশোধে বিলম্ব হয়েছে। ফলে বকেয়া বিল ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ছাড়িয়েছে। এই ঋণের চাপ সামলাতে অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বাজেট ও দায়িত্ব কাঠামো সংস্কার করছে।
শিল্প সচল, কিন্তু আস্থাহীনতা রয়ে গেছে
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “আমরা বিদ্যুৎ ও গ্যাসে আগের চেয়ে কিছুটা উন্নতি পেয়েছি। অনেক কারখানাই পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে। তবে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য শুধুমাত্র ইউটিলিটি নয়, দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির স্থায়িত্ব প্রয়োজন।”
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি
ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (EIB) বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নজর রেখে দেশের পরিবেশবান্ধব অবকাঠামোতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা পরিকল্পনা করছে। এ ব্যাংক ২ বিলিয়ন ইউরো পর্যন্ত বিনিয়োগ সম্ভাবনা দেখছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে নির্বাচনী রোডম্যাপ ও নীতির ধারাবাহিকতার ওপর।
চীনভিত্তিক একাধিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে রেলপথ, গ্যাস-গ্রিড ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে তারা ইউটিলিটি প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও সময়মতো অর্থ পরিশোধ নিশ্চিত হয়েছে কি না, তা দেখতে চায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি শিল্পখাতের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও, রাজনৈতিক ও নীতিগত অনিশ্চয়তা এখনো বড় বাধা। অন্তর্বর্তী সরকার ইউটিলিটি খাতে নীতিগত সংস্কার ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারনীতি বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে, তবে বিদেশি বিনিয়োগ ফিরে পেতে আরও সময় লাগবে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।