ভূমি জরিপ কেন প্রয়োজন?
ভূমি জরিপের মূল উদ্দেশ্য হলো জমির প্রকৃত মালিক নির্ধারণ এবং মালিকানার স্বীকৃতি প্রদান। জমি কেনাবেচা, মালিকানা হস্তান্তর, ভূমি বণ্টন, সরকারের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ কিংবা নতুন সৃষ্ট ভূমি ব্যবহারের জন্য জরিপ অপরিহার্য। যেমন, নদী বা সমুদ্রে নতুন চর বা দ্বীপ সৃষ্টি হলে সেই ভূমি ব্যবহার বা মালিকানা নির্ধারণের জন্য জরিপ করতে হয়।
বাংলাদেশে ভূমি জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয় ‘Survey Act, 1875’ অনুযায়ী, যার অধীনে বিভিন্ন সময়কালে সরকার জরিপ কার্যক্রম চালিয়ে এসেছে। এক বা একাধিক প্লট, মৌজা, সীমানা নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক সীমান্ত ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট করতে জরিপ করা হয়। জরিপের মাধ্যমে জমির দাগ নম্বর, ম্যাপ, নকশা, খতিয়ান, মালিকের নাম, ঠিকানা, জমির আয়তন ও প্রকৃতি সম্পর্কিত তথ্য সংরক্ষণ করা হয়।
জরিপের ইতিহাস: মুসলিম শাসন থেকে ব্রিটিশ আমল
জমি জরিপের ইতিহাস অনেক পুরনো। মুসলিম শাসনামলে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন, শের শাহ ও সম্রাট আকবর ভূমি জরিপের বিভিন্ন ধাপে অবদান রেখেছিলেন। আকবরের সময় ‘টোডরমল’ নামক একজন রাজকর্মচারী রাজস্ব ব্যবস্থায় ভূমি জরিপ শুরু করেন।
১৭৭৪ সালে জেমস রেনেল ঢাকার প্রথম জরিপ মানচিত্র তৈরি করেন। এতে ঢাকাসহ ৮টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মানচিত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপর ব্রিটিশ আমলে জমির মালিকানা ও কর নির্ধারণের জন্য একাধিক জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। জমিদার ও প্রজাদের অধিকার স্পষ্ট করতে ১৮৮৫ সালে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন’ পাস হয়।
সাতটি প্রধান জরিপ কার্যক্রম
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট সাতটি প্রধান জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে:
C.S. জরিপ (Cadastral Survey, 1888)
S.A. জরিপ (State Acquisition Survey, 1956)
P.S. জরিপ (Pakistan Survey, 1956)
R.S. জরিপ (Revisional Survey, 1938)
B.S. জরিপ (Bangladesh Survey, 1998)
City Survey (1999)
Digital Survey (ম্যাপিং ও ETS ব্যবস্থায় ২০১৩-বর্তমান)
প্রাচীন জরিপ ব্যবস্থার বিবর্তন
ব্রিটিশ আমলে জরিপ ব্যবস্থাকে আধুনিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৮৪৫-৭৮ সালের মধ্যে ‘থাক বাস্ত জরিপ’ এবং ‘রাজস্ব জরিপ’ চালু হয়। এই জরিপে মৌজা, তালুক, জমির পরিমাপ ও মালিকানা নির্ধারণ করা হয়। ১৮৮৪ সালে স্থাপন করা হয় “ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর”। পরে ১৮৮৮ সালে আলাদা “ভূমি জরিপ দপ্তর” গঠিত হয়।
জমিদারি ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও জরিপের পরিবর্তন
১৯৫০ সালে ‘প্রজাস্বত্ব আইন’ প্রণীত হওয়ার ফলে জমিদারদের ভূমি অধিকার বাতিল হয়। এই আইনের অধীনে প্রজাদের মালিকানা স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জরিপ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় S.A. জরিপ (১৯৫৬-৬৩) পরিচালিত হয়। কিন্তু এতে ভুল, অনিয়ম ও পক্ষপাতমূলক তথ্য থাকায় পরবর্তী সময়ে R.S. জরিপ শুরু হয়।
শহর এলাকায় ভূমি জরিপ
ঢাকা মহানগরসহ শহর এলাকাগুলোর জমির মালিকানা ও ব্যবহারগত জটিলতা থাকায় সেখানে বিশেষভাবে City Survey পরিচালিত হয়। এরপর আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় ডিজিটাল জরিপে, যা ETS, GNSS এবং Drone সহায়তায় করা হয়।
আধুনিক ভূমি জরিপ: ডিজিটাল ম্যাপিং
২০১৩ সাল থেকে ভূমি জরিপে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। এতে প্রতিটি প্লটের সঠিক জিপিএস লোকেশন, মালিকানা, আয়তন, ব্যবহার, নালিশ ও মামলার তথ্য একত্রিত করা হচ্ছে। GNSS/ETS ও ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত নকশা এখন গুগল ম্যাপে প্রদর্শনযোগ্য হচ্ছে। এতে জমির মালিকানার পাশাপাশি বর্তমান অবস্থা জানা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ভূমি জরিপ ব্যবস্থার একটি দীর্ঘ ও উন্নয়নমুখী ইতিহাস রয়েছে। অতীতের হাতে আঁকা নকশা থেকে শুরু করে আধুনিক ডিজিটাল ম্যাপিং পর্যন্ত, জরিপ ব্যবস্থার অগ্রগতি মালিকানা নির্ধারণ, রাজস্ব আদায় এবং জমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় অনন্য ভূমিকা রেখেছে। ভবিষ্যতে আরও স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর জরিপ ব্যবস্থাই ভূমি ব্যবস্থাপনায় গতি আনবে।