লস অ্যাঞ্জেলসের পাহাড়ি গলি থেকে গানের জগতে বিপ্লব
১৯৬৪ সালে দ্য বার্ডস ব্যান্ডের বেস গিটারবাদক ক্রিস হিলম্যান একটি কক্ষ ভাড়া খুঁজতে গিয়ে পৌঁছান লরেল ক্যান্ট্রি স্টোরে। লস অ্যাঞ্জেলস শহরের ওপরে পাহাড়ি পথের মাঝে থাকা এই ছোট মুদি দোকানটি এখন একটি ঐতিহাসিক স্মারক, যেখানে ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে বসবাসকারী রক শিল্পীদের স্মৃতি আজও জ্বলজ্বল করে। দোকানের দেয়ালে সেসময়ের বিখ্যাত ব্যান্ডগুলোর ছবি সাজানো। এমনকি কাঠ বিক্রির পাত্রেও জিম মরিসনের বিখ্যাত গান থেকে অনুপ্রাণিত বার্তা লেখা: “Come on, baby, light my fire”।
তরুণ শিল্পীদের অভয়াশ্রম
লরেল ক্যানিয়নে আশ্রয় নেওয়া শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন জোনি মিচেল, দ্য মামাস অ্যান্ড দ্য পাপাস, জ্যাকসন ব্রাউন, দ্য ঈগলস এবং ক্রসবি, স্টিলস, ন্যাশ অ্যান্ড ইয়ং (CSNY)। তারা তৈরি করেছিলেন এক অনন্য সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট, যা সান ফ্রান্সিসকোর হেইট অ্যাশবেরির বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে লস অ্যাঞ্জেলস হয়ে ওঠে বিশ্ববিখ্যাত বিনোদন কেন্দ্র। আজও এই শিল্পীদের গান মাসে ৪ কোটিরও বেশি বার শোনা হয় স্পটিফাইতে।
কেন এই ক্যানিয়নে ছুটে এসেছিলেন তারা?
লরেল ক্যানিয়ন ছিল এক অদ্ভুত মিশ্র বাস্তবতা—নিচে ওয়েস্ট হলিউডের ক্লাবগুলোতে রাতের পারফরম্যান্স, আর ওপরে ক্যানিয়নের নির্জন শান্ত পরিবেশ। সস্তা ভাড়া, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার সুযোগ এবং হিপি আন্দোলনের আবহ ছিল এর আকর্ষণ। ‘হুটেন্যানি নাইট’-এ গান গাইতেন নতুন শিল্পীরা, আশা করতেন কোনো রেকর্ড কোম্পানির লোক হয়তো দর্শকসারিতে আছেন। এমনকি গাড়ির জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে পাহাড় থেকে গাড়ি গড়িয়ে নিচে নামিয়ে কিছু পয়সার জ্বালানি দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যেত ওয়িস্কি আ গো গো বা ট্রুবাডর ক্লাবে—বলেন মাইকেল ওয়াকার, “Laurel Canyon” বইয়ের লেখক।
সৃষ্টিশীলতার জ্বালানি ছিল মাদক
ফোক সংগীতশিল্পী এবং লরেল ক্যানিয়ন দৃশ্যের অনানুষ্ঠানিক আলোকচিত্রী হেনরি ডিল্টজ বলেন, “সব শিল্পীই গাঁজা খেত, আমি একে বলি ঈশ্বরের ভেষজ।” এলএসডিও ছিল সৃষ্টিশীলতার অংশ। ডিল্টজ বলেন, “কেউ কেউ মজার জন্য নিত, কিন্তু আমি আর আমার বন্ধুরা একে নিতাম খুব গুরুত্ব দিয়ে।”
নতুন এক সঙ্গীতধারার উন্মেষ
লরেল ক্যানিয়নের শিল্পীরা লোকগানের গভীর কথামালার সঙ্গে মিশিয়েছিলেন ইলেকট্রিক গিটার, ব্লুজের আবেগ আর হংকিটংক সুর। দ্য বিটলস, বব ডিলান, ও দ্য বিচ বয়েজ থেকে তারা প্রভাব নিয়েছিলেন। ব্যাকইয়ার্ডে তিন বা চার কণ্ঠে সুর মিলিয়ে তারা সৃষ্টি করেছিলেন নতুন এক ধারা। জোনি মিচেল “Ladies of the Canyon” (১৯৭০) অ্যালবামটি লেখেন সেই বাড়িতে, যেখানে তিনি থাকতেন গ্রাহাম ন্যাশের সঙ্গে। তিনি বলতেন, “লরেল ক্যানিয়নে সবচেয়ে পাগলদের বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে সবাই বলত লুকআউট মাউন্টেন—তাই আমি সেখানে একটা বাড়ি কিনেছিলাম।”
ঐতিহ্য বহন করছে নতুন প্রজন্ম
লরেল ক্যানিয়নের সংজ্ঞা স্পষ্ট না হলেও কিছু শিল্পী স্পষ্টভাবে এই ধারার প্রতিনিধি। স্পটিফাইতে “Laurel Canyon Legends” নামে একটি প্লেলিস্ট আছে, যেখানে আছেন ক্যারোল কিং, কার্লি সায়মনসহ আরও অনেকে। ফ্লিটউড ম্যাক-এর স্টিভি নিক্স ও লিন্ডসে বাকিংহাম ক্যানিয়নের মূল সময়ের পরে আসেন, তবে তাদের সুরেও সেই ঐতিহ্যের ছায়া। আধুনিক শিল্পীদের মধ্যে ফিবি ব্রিজার্স, ফাদার জন মিস্টি এবং টম পেটি এই ধারায় পড়ে। এমনকি ভ্যালির তিন বোনের ব্যান্ড হাইম ছোটবেলা থেকে মিচেলকে পূজা করত। তাদের তৃতীয় অ্যালবামের “Hallelujah” গানটি লস অ্যাঞ্জেলসের লোকধারার প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। ২০ জুন মুক্তি পাওয়া তাদের নতুন অ্যালবাম “I Quit”-এ একটু কঠিন সুর আছে, তবে “Take me back” গানটি সেই পুরনো ক্যানিয়ন সুরের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
সহিংসতার ছায়ায় এক স্বপ্নভঙ্গ
১৯৬৯ সালে ম্যানসন পরিবার কর্তৃক সংঘটিত খুনের ঘটনার পর লরেল ক্যানিয়নের শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তি চূর্ণ হয়ে যায়। হেনরি ডিল্টজ বলেন, এরপর তিনি আর হিচহাইকাদের তুলতেন না। সময়ের সঙ্গে শিল্পীরা বিখ্যাত ও ধনী হয়ে এই ক্যানিয়ন ছেড়ে চলে যান। আজও জায়গাটি দেখতে অনেকটা আগের মতোই, তবে বাড়িগুলো বড় হয়েছে, ভাড়াও অনেক বেশি। এখন এখানে গিটার নয়, শোনা যায় পেঁচার ডাক—শুধু ক্যান্ট্রি স্টোরের স্পিকারে বাজা পুরনো গান ছাড়া।