জন্মক্রম ও ব্যক্তিত্ব: চিরকালীন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে বিজ্ঞান
ভাইবোনদের জন্মক্রমের ভিত্তিতে ব্যক্তিত্ব গঠনের ধারণা বহুদিন ধরে পরিবার ও মনোবিজ্ঞানীদের কৌতূহলের বিষয়। অনেকেই বিশ্বাস করেন, বড় সন্তানরা দায়িত্বশীল, মধ্যরা শান্তস্বভাব, আর ছোটরা বিদ্রোহী। তবে এই ধারণার পেছনে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ জটিল এবং মিশ্র।
এই লেখার লেখিকা নিজে বড় বোন এবং তিনি দেখেছেন, তার ও ছোট বোনের ব্যক্তিত্ব একেবারে আলাদা, যদিও তারা একই পরিবারে বড় হয়েছেন। তাই প্রশ্ন ওঠে—এই পার্থক্যের পেছনে জন্মক্রমের কি ভূমিকা আছে?
শত বছরের গবেষণা, কিন্তু একক সিদ্ধান্ত নেই
গত শতাব্দীজুড়ে গবেষকরা বারবার চেষ্টা করেছেন জন্মক্রম ও ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক নির্ধারণে। কিন্তু ফলাফল এসেছে পরস্পরবিরোধী। হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী রোডিকা ডেমিয়ান জানান, অনেক গবেষণাতেই অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম ছিল এবং আত্ম-প্রতিবেদন ভিত্তিক ব্যক্তিত্ব পরীক্ষাগুলো পক্ষপাতপূর্ণ হতে পারে।
তাছাড়া পরিবারে ভাইবোনের সংখ্যা, সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা, লিঙ্গ ও বয়স—এসব ভিন্নতা জন্মক্রমের প্রভাব নির্ধারণে জটিলতা তৈরি করে। দুই ভাইবোনের পরিবার আর সাত ভাইবোনের পরিবারের অভিজ্ঞতা কখনোই একরকম হয় না।
বড় বোন সিনড্রোম: সংস্কৃতি ও প্রত্যাশার ফাঁদ?
জার্মানির লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জুলিয়া রোহরার মনে করেন, ‘বড় বোন সিনড্রোম’ অনেকাংশেই সমাজসৃষ্ট। অনেক সমাজে বড় মেয়েরা ছোটদের যত্ন নেওয়ার দায়িত্বে থাকেন, যা তাদের মধ্যে এক ধরনের পরিচর্যাশীলতা তৈরি করে। তবে এটি সর্বজনীন নয়—সব বড় বোনই এমন নন। পরিবারভেদে অভিজ্ঞতা আলাদা।
রোহরার পরিচালিত এক গবেষণায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির কয়েক হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, জন্মক্রম ব্যক্তিত্বের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে না। তবে এক জায়গায় তারা ধারাবাহিক প্রভাব পেয়েছেন—বুদ্ধিমত্তা।
বুদ্ধিমত্তায় প্রভাব: বড় ভাইবোনরা কিছুটা এগিয়ে?
গবেষণায় দেখা গেছে, বড় ভাইবোনরা গড়পড়তা বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষায় ভালো স্কোর করেন। তবে এর কারণ জটিল। গবেষকরা বলেন, সম্ভবত প্রথম সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের মনোযোগ বেশি থাকে, ফলে তারা ভাষাগত ও জ্ঞানগত দিক থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকেন। ছোট ভাইবোনদের বেড়ে ওঠার সময় এসব মনোযোগ ভাগ হয়ে যায়।
ডেমিয়ান বলেন, এটি জিনগত নয় বরং পারিপার্শ্বিক—প্রথম সন্তানদের সঙ্গে বেশি পরিপক্ব ভাষা ব্যবহৃত হয়, বেশি বই পড়ানো হয়, তাই তারা বেশি শব্দ শিখে ফেলে এবং তা পরীক্ষায় প্রতিফলিত হয়।
তবে এটি সব দেশে একরকম নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনেক সময় ছোট ভাইবোনরাই বেশি শিক্ষাগত সুযোগ পায়, কারণ বড়দের আয় পরিবারে আর্থিক স্থিতি আনে।
বয়স ও অভিজ্ঞতা: বিভ্রান্তিকর উপাদান
অনেক সময় বড় ভাইবোনের “দায়িত্বশীলতা” জন্মক্রম নয়, বরং বয়সের কারণে ঘটে। বড়জন সবসময় বয়সে বড় থাকেন, ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মাঝে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মসচেতনতা বেশি দেখা যায়। ১৪ বছর বয়সী এক ভাইবোন ১০ বছর বয়সী ভাইবোনের চেয়ে বেশি চিন্তিত বা দায়িত্ববান হবেন—এটি ব্যক্তিত্ব নয়, বয়সভিত্তিক আচরণ।
বন্ধুত্ব ও আচরণে পার্থক্য: জন্মক্রম নাকি পরিবেশ?
গবেষণায় দেখা গেছে, বন্ধুমহলের প্রভাবও বড়। যদি বড় ভাইবোনের বন্ধুরা বিধি ভাঙার প্রবণতায় থাকে, তবে তারাও অনুরূপ আচরণ করতে পারে। সুতরাং, শুধু জন্মক্রম নয়, পরিবেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
‘স্বার্থপর’ একমাত্র সন্তান: ভুল ধারণার অবসান
প্রচলিত বিশ্বাসে, একমাত্র সন্তানেরা স্বার্থপর হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে স্বার্থপরতা বা আত্মকেন্দ্রিকতা বড়জোর সাধারণ শিশুদের চেয়ে সামান্যই বেশি—অনেক সময় সেটা বয়সের সাথে হারিয়েও যায়।
কানাডার ব্রক ও ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মনোবিজ্ঞানী ২০২৫ সালের এক গবেষণায় দেখান, একমাত্র সন্তানদের ব্যক্তিত্ব অন্যান্যদের সঙ্গে তুলনামূলক। তাদের গবেষণায় ৭ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক অংশগ্রহণ করেন। সেখানে দেখা যায়, মাঝখানের ও ছোট ভাইবোনরা “Honesty-Humility” ও “Agreeableness” স্কোরে বড় ভাইবোনদের চেয়ে সামান্য এগিয়ে। তবে পার্থক্য ছিল খুবই ছোট।
পেশাজীবনে বড়দের সুবিধা? বাস্তবতা ভিন্ন
আগে ধারণা ছিল বড় ভাইবোনরা বেশি একাডেমিক বা বৈজ্ঞানিক পেশায় যুক্ত হয়, ছোটরা সৃজনশীল পেশায়। কিন্তু ডেমিয়ানের দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, বাস্তবে বড় ভাইবোনরাই বেশি সৃজনশীল পেশায় যান।
জন্মক্রম: আজও বিতর্কিত, কিন্তু গুরুত্বহীন নয়
তাহলে জন্মক্রম নিয়ে আলোচনা কি স্রেফ ‘জম্বি থিওরি’? গবেষক রোহরার বলেন, “না, বিজ্ঞান এখনও উন্নতির পথে।” জন্মক্রমের অভিজ্ঞতা অনেকের জন্য বাস্তব ও সম্পর্কিত, কিন্তু তা বৈশ্বিক নিয়ম নয়।
ডেমিয়ান বলেন, “ব্যক্তিত্বে বিশ্বজনীন প্রভাব না থাকলেও পরিবার বা সংস্কৃতিভেদে জন্মক্রমের বাস্তব সামাজিক প্রভাব থাকতে পারে।” যেমন—ইংল্যান্ডে আগে বড় ছেলেই উত্তরাধিকার পেতেন, ২০১৩ সালের রাজকীয় আইন বদলানোর আগ পর্যন্ত। এটি জন্মক্রমের সামাজিক গুরুত্বেরই উদাহরণ।
জন্মক্রম ও ব্যক্তিত্বের সম্পর্ক এখনও একেবারে নিশ্চিত নয়। তবে গবেষণা বলছে, বড় সন্তান কিছু ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা পেতে পারেন, বিশেষ করে মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে। তা সত্ত্বেও, ব্যক্তিত্বের গঠন কেবল জন্মক্রম নয়, পরিবার, সংস্কৃতি, সামাজিক সম্পর্ক, বয়স ও অভিজ্ঞতার সমন্বিত ফল।
আর তাই লেখিকার মতো কেউ যদি ভাবেন বড় বোন হিসেবে তিনি একটু বেশি ‘স্মার্ট’, তবে সেটা হয়তো কিছুটা বাস্তব—আর কিছুটা মজা!