০৩:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০৯)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫
  • 6

নজরুল: পরিশিষ্ট

স্বনির্বাচিত নজরুলের এই অভিভাবকটি একদিন কোনো সভায় অভদ্র আচরণ করিয়াছিলেন। কিন্তু নজরুলের মতো তখন তাহার মানসিক বিকৃতি ঘটিয়াছে মনে করিয়া উপস্থিত সভ্যবৃন্দ তাঁহাকে সভাস্থল হইতে বিতাড়িত করেন নাই।

তখন বোধ হয় স্যার নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রিসভার আমল। কলিকাতা আসিয়া আমি একদল ছাত্রনেতার সঙ্গে প্রত্যেক মন্ত্রীর বাসভবনে গমন করিয়া নজরুলের জন্য সাহিত্যিক ভাতার ব্যবস্থা করিতে অনুরোধ করি। আফসোসের বিষয় একজন মন্ত্রী আমাদিগকে বলিলেন, “আমি শুনেছি নজরুল এখন আর লিখতে পারে না। তবে তাকে অর্থ সাহায্য করে আর লাভ কি?”

আমি তখন গভর্নমেন্টের অধীনে চাকুরি করি। আমার হাত-পা বাঁধা। মন্ত্রী সাহেবের কথার উপযুক্ত উত্তর না দিতে পারিয়া বহু বিনিদ্র রজনী যাপন করিতে হইল। অথচ এঁরাই দেশের কালচার ও কৃষ্টির অভিভাবক হইয়া স্বপদে অধিষ্ঠিত হন।

আমার সীমিত শক্তি লইয়া কবির জন্য যাহা করা সম্ভব তাহা করিয়াছি। একবার রেডিওর বোখারি সাহেবকে লইয়া গেলাম কবির অবস্থা দেখাইতে। আমার ধারণা ছিল বোখারি সাহেব তাঁহার ভ্রাতার সাহায্যে কবির জন্য কিছু করিতে পারিবেন। আর একবার পাবলিসিটির ডিরেক্টর মিস্টার ভাটিয়াকে নজরুলের বাসায় লইয়া গিয়াছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল মিঃ ভাটিয়া গভর্নমেন্টের কাছে নজরুলের জন্য কোনো সাহিত্যিক ভাতার প্রস্তাব দিবেন।

কবির সঙ্গে এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে চিরকালই আমার এক গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক রহিয়াছে। ১৯৫২ সনে আমি তাঁর উপরে যে বিস্তৃত স্মৃতি-কথা লিখি তা মাসিক বসুমতী পত্রিকায় এবং আমার লিখিত পুস্তক ‘যাঁদের দেখেছি’ ও ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’-এ যথারীতি প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতে পাঠক সহজেই বুঝিতে পারিবেন কবি এবং তাঁর পরিবারের প্রতি আমার কী গভীর সহানুভূতি রহিয়াছে।

আমি কলিকাতা থাকাকালে দেখিয়াছি, কোন সময়ে নামমাত্র কিছু টাকা দিয়া কবির বইগুলি প্রকাশ করিয়া গ্রন্থ-ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর তাহার লভ্যাংশ উপভোগ করিতেছে। কবির পরিবারকে একটিও পয়সা দেয় নাই।

তাহারা কবির নতুন-লেখা বইগুলিও কবি-পত্নীকে নানা গালগল্পে ভুলাইয়া নাম-মাত্র অর্থ দিয়া প্রকাশ করিতেছে। এই ধরনের প্রকাশকদের হাত হইতে কবিকে উদ্ধার করিতে আমি একবার তৎকালীন প্রসিদ্ধ গ্রন্থ-প্রকাশক সিগনেট প্রেসের সঙ্গে আলাপ করি। সিগনেট প্রেসের দিলীপ গুপ্ত মহাশয়কে সঙ্গে করিয়া আমি একদিন কবি পত্নীর সঙ্গে পরিচিত করাইয়া দেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পরিচিতি ফলপ্রসূ হয় নাই।

নানা লোকের দ্বারা প্রতারিত হইয়া কবিপত্নী সকলকেই সন্দেহের চোখে দেখিতেন। সিগনেট প্রেস কম রয়ালটি দেয়। কিন্তু অন্যান্য প্রকাশকদের চাইতে বহু সংখ্যক বই তারা নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি করিতে পারে। কিন্তু কবি পত্নীকে তাঁর অন্যান্য প্রকাশকেরা অন্য রকম বুঝানোর ফলে সিগনেট প্রেস কবির বইগুলি প্রকাশ করিতে পারে নাই।

দেশ বিভাগের পরে কবির বড় ছেলে আমার বাসায় আসিয়া উঠিল। আমরা তাহাকে নিজের পুত্রের মতোই আদর যত্ন করি। তাহার সঙ্গে কবির স্বহস্তে লেখা মরু-ভাস্কর বইখানি ছিল। আমি এই পুস্তকখানার জন্য প্রকাশকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলিতেছি, এমন সময় কবির অপর এক ভক্ত মাত্র ১৫% রয়ালটির বিনিময়ে কোনো প্রকাশকের সঙ্গে কবি-পুত্রকে চুক্তিবদ্ধ করান। বিনিময়ে সেই ভক্তটি কবির স্বহস্তে লেখা পান্ডুলিপিটি দখল করেন।

 

চলবে…..

জুলাইয়ে সম্ভাব্য বন্যা: কোন এলাকায় বেশি ঝুঁকি

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০৯)

১১:০০:৫৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫

নজরুল: পরিশিষ্ট

স্বনির্বাচিত নজরুলের এই অভিভাবকটি একদিন কোনো সভায় অভদ্র আচরণ করিয়াছিলেন। কিন্তু নজরুলের মতো তখন তাহার মানসিক বিকৃতি ঘটিয়াছে মনে করিয়া উপস্থিত সভ্যবৃন্দ তাঁহাকে সভাস্থল হইতে বিতাড়িত করেন নাই।

তখন বোধ হয় স্যার নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রিসভার আমল। কলিকাতা আসিয়া আমি একদল ছাত্রনেতার সঙ্গে প্রত্যেক মন্ত্রীর বাসভবনে গমন করিয়া নজরুলের জন্য সাহিত্যিক ভাতার ব্যবস্থা করিতে অনুরোধ করি। আফসোসের বিষয় একজন মন্ত্রী আমাদিগকে বলিলেন, “আমি শুনেছি নজরুল এখন আর লিখতে পারে না। তবে তাকে অর্থ সাহায্য করে আর লাভ কি?”

আমি তখন গভর্নমেন্টের অধীনে চাকুরি করি। আমার হাত-পা বাঁধা। মন্ত্রী সাহেবের কথার উপযুক্ত উত্তর না দিতে পারিয়া বহু বিনিদ্র রজনী যাপন করিতে হইল। অথচ এঁরাই দেশের কালচার ও কৃষ্টির অভিভাবক হইয়া স্বপদে অধিষ্ঠিত হন।

আমার সীমিত শক্তি লইয়া কবির জন্য যাহা করা সম্ভব তাহা করিয়াছি। একবার রেডিওর বোখারি সাহেবকে লইয়া গেলাম কবির অবস্থা দেখাইতে। আমার ধারণা ছিল বোখারি সাহেব তাঁহার ভ্রাতার সাহায্যে কবির জন্য কিছু করিতে পারিবেন। আর একবার পাবলিসিটির ডিরেক্টর মিস্টার ভাটিয়াকে নজরুলের বাসায় লইয়া গিয়াছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল মিঃ ভাটিয়া গভর্নমেন্টের কাছে নজরুলের জন্য কোনো সাহিত্যিক ভাতার প্রস্তাব দিবেন।

কবির সঙ্গে এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে চিরকালই আমার এক গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক রহিয়াছে। ১৯৫২ সনে আমি তাঁর উপরে যে বিস্তৃত স্মৃতি-কথা লিখি তা মাসিক বসুমতী পত্রিকায় এবং আমার লিখিত পুস্তক ‘যাঁদের দেখেছি’ ও ‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’-এ যথারীতি প্রকাশিত হইয়াছে। তাহাতে পাঠক সহজেই বুঝিতে পারিবেন কবি এবং তাঁর পরিবারের প্রতি আমার কী গভীর সহানুভূতি রহিয়াছে।

আমি কলিকাতা থাকাকালে দেখিয়াছি, কোন সময়ে নামমাত্র কিছু টাকা দিয়া কবির বইগুলি প্রকাশ করিয়া গ্রন্থ-ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর তাহার লভ্যাংশ উপভোগ করিতেছে। কবির পরিবারকে একটিও পয়সা দেয় নাই।

তাহারা কবির নতুন-লেখা বইগুলিও কবি-পত্নীকে নানা গালগল্পে ভুলাইয়া নাম-মাত্র অর্থ দিয়া প্রকাশ করিতেছে। এই ধরনের প্রকাশকদের হাত হইতে কবিকে উদ্ধার করিতে আমি একবার তৎকালীন প্রসিদ্ধ গ্রন্থ-প্রকাশক সিগনেট প্রেসের সঙ্গে আলাপ করি। সিগনেট প্রেসের দিলীপ গুপ্ত মহাশয়কে সঙ্গে করিয়া আমি একদিন কবি পত্নীর সঙ্গে পরিচিত করাইয়া দেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পরিচিতি ফলপ্রসূ হয় নাই।

নানা লোকের দ্বারা প্রতারিত হইয়া কবিপত্নী সকলকেই সন্দেহের চোখে দেখিতেন। সিগনেট প্রেস কম রয়ালটি দেয়। কিন্তু অন্যান্য প্রকাশকদের চাইতে বহু সংখ্যক বই তারা নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি করিতে পারে। কিন্তু কবি পত্নীকে তাঁর অন্যান্য প্রকাশকেরা অন্য রকম বুঝানোর ফলে সিগনেট প্রেস কবির বইগুলি প্রকাশ করিতে পারে নাই।

দেশ বিভাগের পরে কবির বড় ছেলে আমার বাসায় আসিয়া উঠিল। আমরা তাহাকে নিজের পুত্রের মতোই আদর যত্ন করি। তাহার সঙ্গে কবির স্বহস্তে লেখা মরু-ভাস্কর বইখানি ছিল। আমি এই পুস্তকখানার জন্য প্রকাশকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলিতেছি, এমন সময় কবির অপর এক ভক্ত মাত্র ১৫% রয়ালটির বিনিময়ে কোনো প্রকাশকের সঙ্গে কবি-পুত্রকে চুক্তিবদ্ধ করান। বিনিময়ে সেই ভক্তটি কবির স্বহস্তে লেখা পান্ডুলিপিটি দখল করেন।

 

চলবে…..