মৌসুমি পূর্বাভাস: ভারী বৃষ্টির ইঙ্গিত
ভারতের আবহাওয়া দফতর (IMD) ও বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর (BMD) দুʼপক্ষই জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে। IMD-র দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে জুলাইয়ে গড় বর্ষণ ‘লং পিরিয়ড অ্যাভারেজ’-এর ১০৬ শতাংশের বেশি হতে পারে বলে উল্লেখ আছে, যা পূর্ব ও মধ্য ভারতের নদী অববাহিকায় আকস্মিক পানি ঢলের ঝুঁকি বাড়াবে । একই সময়ে BMD-র মে–জুলাই মৌসুমি বুলেটিনে ‘দেশজুড়ে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের উপর’ থাকার সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে । এসব প্রবল বৃষ্টিপাতের ৩০–৪০ শতাংশ পানি উজান পথ ধরে বাংলাদেশে ঢোকে, ফলে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও কেন্দ্রীয় এলাকায় নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে।
কোন এলাকাগুলো বেশি ঝুঁকিতে
বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (FFWC)-র ১ জুলাই সকাল ৬টার বুলেটিন অনুযায়ী—
- সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকা (সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার): এই দুটি নদী ১৭–১৮৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে, এবং ৪৮ ঘণ্টা স্থবির বা আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
- ব্রহ্মপুত্র–যমুনা অববাহিকা (কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল): পানি ক্রমাগত বাড়ছে; হাটিয়া, চিলমারী, কামারজানি ও ফুলছড়ি স্টেশনে সতর্কসীমা ছুঁয়ে যেতে পারে।
- গঙ্গা-পদ্মা ধার (রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ): পাঁচ দিন পর্যন্ত পানি বাড়ার প্রবণতা থাকলেও আপাতত বিপদসীমার নিচে থাকবে ।
কোন ফসল ক্ষতির মুখে পড়তে পারে
আউশ ধান: অনেক এলাকায় পাকতে শুরু করে; জমিতে দীর্ঘদিন পানি থাকলে শীষ পচে ফলন কমে যায়।
আমন ধানের বীজতলা: ১৫–২০ দিন বৃষ্টির জলাবদ্ধতা বীজতলার সম্পূর্ণ নষ্ট করতে পারে।
পাট: ওঠানোর আগে অতিরিক্ত পানিতে গাছ ভেঙে পড়ে আঁশের মান নষ্ট হয়।
সবজি ও মসলা (লাউ, মরিচ, আদা-হলুদ): নিচু জমির চাষাবাদ ডুবে গেলে ৭–১০ দিনের মধ্যে গাছ মারা যায়।
গত বছরের দুই দফা বন্যায় ধানসহ প্রায় ১.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল নষ্ট হয়ে ৪৫ শ’ কোটি টাকার (৪৫ শ’ কোটি টাকা ৩৮০ মিলিয়ন ডলার) কৃষি ক্ষতি হয়েছিল, যেটি বর্তমান মৌসুমেও আশঙ্কা দেখা দিলে আমদানি-নির্ভরতা বাড়তে পারে ।
অর্থনৈতিক প্রভাবের চিত্র
- কৃষিখাত: বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক মূল্যায়নে বন্যাজনিত বার্ষিক গড় ক্ষতি ২ বিলিয়ন ডলারের মতো—এর অর্ধেকই কৃষি-উৎপাদন ক্ষতি এবং বাজারমূল্য পতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে ।
- যোগাযোগ ও অবকাঠামো: ২০২৪-এর শেষের বন্যায় ৩৩.৫ শ’ কোটি টাকার সড়ক, সেতু ও বাসস্থান ক্ষতি হয়েছিল; এবারের সম্ভাব্য প্লাবন ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ মহাসড়কের নিম্নাঞ্চল, সিলেটের জকিগঞ্জ-কানাইঘাট সড়ক এবং পদ্মা তীরবর্তী আঞ্চলিক সড়কগুলোতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে পারে ।
- খাদ্য-পণ্যের দাম: চাল ও পেঁয়াজ-রসুনের গ্রীষ্মকালীন যোগান ব্যাহত হলে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি জুলাই-আগস্টে ১–১.২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে কৃষি-বাজার বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস।
প্রস্তুতি ও সুপারিশ
জেলা-আধারে ধান ও পাট কাটার সময় এগিয়ে আনা—উত্তরাঞ্চলে আউশ কাটাকে ৭-১০ দিন ত্বরান্বিত করতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সুপারিশ।
বীজতলা উঁচুতে স্থানান্তর ও ভাসমান বীজতলা—বিশেষত সিলেট-মৌলভীবাজার অঞ্চলে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ পর্যবেক্ষণ জোরদার—বর্ষীয় মৌসুমে কুশিয়ারা-তিতাস ও ব্রহ্মপুত্র-যমুনার তীররক্ষা বাঁধে ফাটল সারাই আগেই সম্পন্ন করা।
স্থানীয় পর্যায়ে খাবার ও পশুখাদ্য মজুত—গত বছরের অভিজ্ঞতায় ৫–৭ দিনের শুকনা খাবার ও গবাদি পশুর জন্য খৈল-ঘাস সংরক্ষণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সচেতনতা ও আগাম বার্তা—FFWC-র অনলাইন বুলেটিন ও মোবাইল-এসএমএস-ভিত্তিক সর্তকবার্তা কৃষক-বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছে দিতে মোবাইল অপারেটর ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোর সমন্বয় জরুরি।
জুলাই মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢল মিলিয়ে বাংলাদেশের উত্তরের চরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বের হাওর-পার এবং কেন্দ্রীয় নিম্নভূমি উল্লেখযোগ্য বন্যা ঝুঁকিতে রয়েছে। সময়মতো ফসল মাঠ থেকে তুলে নেওয়া, একাধিক বার্তা-মাধ্যমে আগাম সতর্কতা এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা-ভিত্তিক ত্রাণ ও কৃষি-পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রস্তুত রাখলে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ও মানবিক ক্ষয়-ক্ষতি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।