উঁচু শুল্কের বাস্তবত
বাংলাদেশের জাতীয় শুল্ক তালিকা (২০২৪-২৫ অর্থবছর) অনুযায়ী ‘Printed Books, Brochures, Leaflets’ (এইচএস ৪৯০১১০০০) আমদানিতে মোট করভার পৌঁছেছে ৭৩.৯৬ শতাংশ—এর মধ্যে কাস্টমস ডিউটি ২৫%, সম্পূরক শুল্ক ১০%, ভ্যাট ১৫%, অগ্রিম আয়কর ৫%-সহ একাধিক স্তরের কর ধরা রয়েছে। তুলনামূলকভাবে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা-সংক্রান্ত লাইনে (এইচএস ৪৯০১৯৯১০) করভার মাত্র ১০% রাখা হলেও সাধারণ পাঠকের হাতে পৌঁছাতে হয় যে ‘Other books’ শাখা—সেখানে মোট করভার ১৫.২৫% থেকে ৩৯.৪০% পর্যন্ত।

কতটা প্রভাব পড়ছে বাজারে?
• সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD)-এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে, ৭৩.৯৬% মোট করভার বইয়ের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে গড়ে দ্বিগুণেরও বেশি, যা SDG-৪ (সবার জন্য গুণগত শিক্ষা) অর্জনে বড় বাধা সৃষ্টি করছে।
• ২০২৪-এর বাজেট বিশ্লেষণেও একই হার উল্লেখ করে সতর্ক করা হয়েছে যে উচ্চ শুল্ক বই ক্রয়ে ‘মধ্যবিত্ত পরিবারের উপর অতিরিক্ত চাপ’ তৈরি করছে।
• ঢাকার শীর্ষস্থানীয় প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে মতে , ২০২৩-এ বিক্রি ১৫-৩৫% কমে গেছে; ক্রেতারা আনন্দদায়ক বা অনুবাদ সাহিত্য থেকে সরে যাচ্ছেন। ২০২৪-২৫ এই হার আরো বেশি
সীমিত সম্ভাবনা, বিস্তৃত ক্ষতি

মূল্যস্ফীতি বনাম পাঠকবৃত্ত
উচ্চ কাগজ-দাম ও ডলার সংকটের সঙ্গে ৭৪%-এর কাছাকাছি শুল্ক বইয়ের চূড়ান্ত মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রায় ১.৮ গুণ। এর ফলে আন্তর্জাতিক গবেষণা, দার্শনিক বা সমসাময়িক সাহিত্যের অনুবাদ—সবই সীমিত সার্কেলে আটকে যাচ্ছে।
প্রকাশক-বই ব্যবসায়ীদের টিকে থাকার লড়াই
অগ্রিম আয়কর (AIT) ও সারচার্জ দিতে গিয়ে বই আমদানিকারকের কমিশন মার্জিন নেমে এসেছে ৩-৫%-এ (পূর্বের গড় ১০-১২% থেকে)। অনেক বাণিজ্যিক প্রকাশক এখন বিদেশি শিরোনাম আনতে দ্বিধায় পড়ছেন, ফলে বাজারে অননুমোদিত পিডিএফ বা পাইরেটেড সংস্করণ বেড়েছে – রাজস্ব যেমন হারাচ্ছে, তেমনি লেখক-অনুবাদকরাও ন্যায্য সম্মানী থেকে বঞ্চিত।
পাঠক-শিক্ষকদের সীমিত রেফারেন্স
ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে বিদেশি টেক্সট-বইয়ের ওপরই করভার ৭৩.৯৬%। বিদ্যালয়গুলো বলছে, বই প্রতি গড় বাড়তি ব্যয় ৩০-৪০% – ফলে গার্ডিয়ানদের ফি বাড়ছে, আর অনেক স্কুল পুরনো সংস্করণ বা ফটোকপি দিয়ে চালাচ্ছে।

মৌলবাদী মানস গঠনের নীরব সহায়ক
ইউনেস্কোর ‘Preventing Violent Extremism through Education’ নির্দেশনায় বলা হয়েছে – বৈচিত্র্যপূর্ণ, সমালোচনামূলক ভাবনার অনুশীলন ও গ্লোবাল সিটিজেনশিপ শেখানো না গেলে শিক্ষাব্যবস্থা উল্টো “বহিষ্কারমুখী বিশ্বদৃষ্টিকে জোরদার করতে পারে।”
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, বিদেশি ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব বা দার্শনিক গ্রন্থের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ছাত্র-যুবাদের পাঠভ্যাস ক্রমে সীমিত হচ্ছে স্থানীয়, প্রায়-একঘেয়ে ধারায়; সেই শূন্যস্থানে সক্রিয় মৌলবাদী গোষ্ঠী বিনা খরচে অনলাইন পিডিএফ, লিফলেট বা প্রচারপুস্তিকা সরবরাহ করছে। পরিণামে –
• সমালোচনামুখী পাঠের বদলে একমাত্রিক ব্যাখ্যা জনপ্রিয় হচ্ছে,
• ভিন্নমত ও বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানার সুযোগ কমে যাচ্ছে,
• উগ্র বা ষড়যন্ত্রময় বয়ান প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মৌলবাদী হামলা-সংক্রান্ত গবেষণাতেও (যেমন অধ্যাপক আবুল বারকাতের ‘Fundamentalism in Bangladesh’) দেখা যায়, “সীমিত পাঠ-বাস্তবতা ও গুরুভক্তি নির্ভর ব্যাখ্যা-শিক্ষা মৌলবাদকে পুষ্ট করে”—যা বহুমূল্য বিদেশি বই সহজলভ্য না হলে আরও ঘনীভূত হয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















