বাংলাদেশের বর্তমান ইন্টারিম ব্যবস্থায় একজন হিন্দু উপদেষ্টা আছে। কেউ তাকে কোনোদিন দেখেছে, এমনকি কোন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তাও মনে হয় দেশের নিরানব্বইভাগ মানুষ জানে না।
এই ইন্টারিম এর প্রধান উপদেষ্টা অনেক বড় লটবহর নিয়ে প্রায় প্রতিমাসে বিদেশ সফর করেন। শেখ হাসিনারও লটবহরও এর এমনই বড় ছিলো- সেখানে টোকেন হলেও দু চারটে হিন্দু মুখ দেখা যেতো, এখন সেটা ছেঁটে ফেলা হয়েছে।
তাছাড়া এই ইন্টারিম আমলে হাইকোর্টেও অনেক বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে। সেখানেও একজন হিন্দু উপদেষ্টার মতো একজন হিন্দু বিচারপতি রাখা হয়েছে। যেহেতু বিচার বিভাগ, এর বেশি কিছু লেখা যাবে না। তবে বাংলাদেশে আমিকাস কিউরি হবার মতো বড় বড় হিন্দু আইনজীবী এখনও আছে।
সম্প্রতি হিন্দুদের প্রধান উৎসব দুর্গা পূজা শেষ হলো। খুবই শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে । কারণ, বাংলাদেশে প্রতিমা ভাঙ্গে পাগলে আর বাতাসে। তাই প্রতিমা ভাঙ্গলেও বাংলাদেশে পূজা শান্তিপূর্ণ হয়। আর এই পূজার কিছু মন্দিরের আরতি নৃত্য ও পূজারতদের উপস্থিতি দেখানো হয়েছে টেলিভিশনে। তবে এবার পূজায় সব থেকে লক্ষণীয় ছিলো- বেশিরভাগ পূজা মন্দিরে হিন্দু নারী ( যারা মূলত পূজার উৎসবে সব থেকে বেশি উপস্থিত থাকে) তাদের থেকে জামায়াত – বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বেশি উপস্থিতি। এমনকি কোন কোন মন্দিরে হেফাজতসহ অন্যান্য মাদ্রাসা নির্ভর সংগঠনগুলোর লোকদের উপস্থিতিও ছিলো।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর যে নিউজটি সব থেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, কোন জামায়াত নেতা তার কর্মীদের নিয়ে কোন কোন মন্দির পাহারা দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী’র নেতাকর্মীরা মন্দির পাহারা দিচ্ছে- আর সেখানে পূজা করতে হচ্ছে হিন্দু নারীদের, যাদের কারো কারো’র ভেতর দিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বয়ে চলে- যে দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে একাত্তরে তার কোন আত্মীয়া বা স্বজনের ধর্ষিতা হবার ঘটনা। এছাড়া, যখনই জামায়াতে ইসলামী বা অন্যান্য মৌলবাদী দলের কর্মীরা মন্দিরে আসে তখনই হিন্দু মেয়েদের তাদের পোশাক নিয়ে সজাগ হতে হয়। এই সন্ত্রস্ততা, এই গভীর দীর্ঘশ্বাসের ভেতর দিয়েই হয়েছে এবারের পূজা। আর এসব পূজাই দেখানো হয়েছে টেলিভিশনে। টেলিভিশনে অনেক হিন্দু নেতাদের বলতে হয়েছে, আমরা খুব ভালোভাবে পূজা করেছি।

আসলে মিডিয়ায় তাদের ওই বক্তব্য শুনে অনেকেরই ছোট বেলার (যদিও সে প্রজন্ম এখন কমে গেছে) বানর দিয়ে খেলা দেখানোর কথা মনে পড়তে পারে। বানরকে বলা হতো, এবার তুমি রাম হও, এবার তুমি জমিদার হও। বানর তার মালিকের বা ব্যবসাদারের শেখানো অভিনয়টা করতো। শিশুরা বা সাধারণ মানুষ তাতে আনন্দ পেতো। কিন্তু একটু যাদের চোখ কান খোলা, তারা ঠিকই বানরের লেজটি দেখতে পেতো।
তারপরেও শহরের বেশ কিছু পূজা মণ্ডপকে “আনন্দ চিহ্ন” হিসেবে মিডিয়ায় আনা হয়েছে। এসব দেখার পরেও দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় থাকা একজন উচ্চ পদস্ত সম্মানী ব্যক্তি- ফোন করে জানতে চান, “ এবার ঢাকা শহরে আমাদের পূজা এত নীরব কেন? মিডিয়াও অন্যান্য বারের থেকে পূজার কভারেজ কম দিচ্ছে কেন? “ তারপর তিনি বলেন , অন্যান্যবার তাঁর ছেলে মেয়েদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের দিকে যেতেন, এবার তিনি সেখানে যাননি। তাছাড়া তিনি যাতায়াতেও বিশ্ববিদ্যালয়কে এড়িয়ে চলেন।
ভদ্রলোক বাংলাদেশের প্রগ্রেসিভ উদার মুসলিম, যারাই মূলত এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ, শুধু তিনি নন, বাংলাদেশের বিভিন্ন অবস্থানে যারা আছেন, তাদের বেশিরভাগের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্মৃতি জড়িয়ে আছে। র্যাঙ্কিং এ বিশ্ববিদ্যালয়টি যেখানে স্থানে থাকুন না কেন, এ দেশের যাবতীয় প্রগ্রেসিভ আন্দোলন, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই জন্ম নিয়েছে। আর এখন একজন প্রগ্রেসিভ বাঙালি মুসলিমও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে গাড়িতে যাতায়াতে ভয় পান।
সেখানে কর্মরত হিন্দু শিক্ষকদের অবস্থার সব দিক তুলে ধরতে গেলে তা একটি গবেষণার বই হয়ে যাবে। তবে প্রথমত তাদের ভেতর যোগ্য অনেককে ফ্যাসিস্টের দোসর হিসেবে- প্রো ভিসি বা বিভাগীয় চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। এটা অবশ্য প্রগ্রেসিভ মুসলিম শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। তবে হিন্দু শিক্ষকদের মানসিক অবস্থার বাস্তবতা হচ্ছে, মাস দুই আগে প্রগ্রেসিভ অথচ বর্তমান সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষকের সঙ্গে ফোনে নানান বিষয়ে কথার সময়ে- একজন মেধাবী হিন্দু শিক্ষকের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাই- বলি, “ও তো ফোন ধরে না। কেমন আছে সে?” এর উত্তরে সে জানায়, “ প্রায় সময় বাসার ভেতর থাকে। শুয়েই থাকে। আমি, মাঝে মাঝে তাঁর ওখানে যাই, জোর করি, চলেন একটু রাস্তায় বের হই, ক্যাম্পাসের মধ্যে হাঁটি । এভাবে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে যাবেন”।

অবশ্য এই মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বলতে গেলে, শুধু হিন্দুদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বললে মিথ্যে বলা হবে- ঠিক একই অবস্থা প্রগ্রেসিভ মুসলিমদেরও। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি সংবাদসংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অফ বাংলাদেশ ( UNB) একটি নিউজ করেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে মেয়েদের ব্যাপক হারে মানসিক সমস্যা বাড়ছে। এর মূল কারণ এখন দেশের সকলে জানে। একদিকে অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য। চাপটি মূলত গিয়ে পড়ছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ওপর। সংসার তাদের সামলাতে হচ্ছে। এছাড়া, অধিকাংশের স্বামী, সন্তান একটি অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। বাড়ি থেকে শুরু করে রাস্তা- অফিস সবই অনিরাপদ।
এই অনিরাপত্তার মধ্যে শহরের বাইরে এবারের গ্রামের দুর্গা পূজা কেমন হয়েছে তা হিসাব করতে গেলে শুধু মণ্ডপের সংখ্যা গুনলে হবে না। মানুষের মানসিক অবস্থার খোঁজও নিতে হবে। ঢাকায় চাকরি করতো একটি ছেলে, বয়স চল্লিশের মতো। ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পরে বাড়ি থেকে ঘুরে এসে চাকরি করেছিলো কয়েকদিন – পরে স্ত্রী ও সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
দুর্গা পূজার শেষ দিন অর্থাৎ বিজয়ার দিন বা তার পরের দিন বিজয়ার প্রণাম জানাতে ফোন করে। তার কাছে জিজ্ঞেস করি গ্রামে পূজা কেমন হয়েছে। “ সে উত্তরে বলে, স্যার বুঝতেই তো পারছেন, যে অবস্থা। এর ভেতর পূজা কেমন হতে পারে। মাকে তো প্রণাম করতে হয়। এছাড়া পূজার কি আর মন আছে”!
এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পুলিশের সাব ইন্সেপেক্টর পদের ট্রেনিং শেষ হয়ে যাওয়া তিনশ’র বেশি পুলিশ অফিসারকে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনে অর্থাৎ তারা নাস্তা খাবার সময় নাকি হৈ চৈ করেছে – এ কারণ দেখিয়ে চাকরিতে আর পোস্টিং না দিয়ে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাদের ভেতর ৭০ জনের ওপর হিন্দু অফিসার ছিলো। আইনজ্ঞরা বলছেন, যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের পক্ষে বিচার বিভাগে গেলে আইন তাদের চাকরিতে থাকার পক্ষেই থাকবে। কিন্তু কোনো আইনজীবীই তাদের কেস নিতে সাহস পাচ্ছে না।

এরপরে বর্তমান সরকার অবশ্য নতুন করে নানানভাবে দ্রুত কিছু নিয়োগ পুলিশে দিয়েছে। সেখানে একটি বিশেষ মৌলবাদী দলের কর্মীদের নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কোন হিন্দু ছেলে সেদিকে যাবার চেষ্টা করেনি। যাদের বিবেচনা আছে তারা করবেও কেন? যেখানে ধর্মীয় মেজরিটির যিনি পুলিশ অফিসারের চাকরিতে আছেন, তিনিই বলছেন, “পুলিশের অবস্থা এখন খাঁচায় রাখা বানরের মতো”।
অন্যদিকে ব্যবসা- বাণিজ্য শুধু নয় কৃষি উৎপাদন, যেমন মাছ বা পোলট্রি এসব কাজ থেকেও সরে আসছে হিন্দুরা। কারণ, তাদের প্রতিদিন এত চাঁদা দিতে হয় -তারপরে আর এই উৎপাদন করে কোন লাভ থাকে না। গ্রামে গ্রামে এই চাঁদাবাজি একটি নীরব আর্ট হিসেবে রূপ নিয়েছে। যেমন, কৃষি পরিবারের বাড়ির গাছ, গরু ছাগল এগুলো সম্পদ। গাছটা কেটে নিয়ে যাচ্ছে- গরুটা দড়ি ধরে নিয়ে যাচ্ছে- অথচ মালিককে পাশের লোকজনকে বলতে হচ্ছে আমি বিক্রি করে দিয়েছি।

বাংলাদেশের হিন্দুদের অস্থাবর সম্পদ এভাবে ১৯৪৭ ও ১৯৭১ এ দিয়ে দিতে হয়েছিলো। কিন্তু তখন তাদেরকে মিথ্যে বলতে হয়নি। তখন তারা ভারতে চলে যেতে পেরেছিলো, প্রাণ নিয়ে। আর এখন শুধু গাছ নয়, মেয়েকেও বাবার কাছে ভিডিও পাঠাতে হচ্ছে, বাবা আমি ভালো আছি ও স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি।
সর্বোপরি, একটি দুর্গাপূজা হলো, পূজামণ্ডপে সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে অনেকেই গেলেন। কিন্তু হিন্দুরা তাদের কাছে বা সম্মিলিতভাবে বিবৃতি দিয়ে বলতে পারলো না – হিন্দুদের অধিকার আদায়ের নেতা চিন্ময় প্রভু’র ( চিন্ময় দাস) মুক্তি চাই- তাকে ছাড়া আমাদের পূজা সম্পূর্ণ হবে না। তাকে মিথ্যে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক। চিন্ময়ের নামটি মুখে নেওয়াও এখন ভয়ের বিষয়।
এরপরে কি বলা যাবে বাংলাদেশে হিন্দুরা ভিসিবল? বরং এটাই কি সত্য নয়, একটি খাঁচায় রাখা অদৃশ্য নাগরিক- বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়।
লেখক: বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.
(লেখাটি শ্রীলংঙ্কার The Island পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটা তার বাংলা অনুবাদ । The Island এর ই- পেপার কপি লেখার ভেতরে দেয়া হলো)

স্বদেশ রায় 


















